চির পথের সাথী
-সুমিতা দাশগুপ্ত
-“ঈশ্, কী যে বিচ্ছিরি লাগছে, এবারের পঁচিশে বৈশাখটা, কেমন মাঠে মারা গেল, বলো দাদু! না কোনও সেলিব্রেশন, না একটু গান বাজনা, কেবলই মনখারাপ করে ঘরে বসে থাকো।”
-“গান! সে তো তুমি ঘরে বসেও গাইতে পারো”।
-“দূর্ আমি কি গাইতে পারি নাকি? সুর ভুল হয়ে যায়।
-“তুমি তো অন্যকে শোনানোর জন্য গাইছো না, গাইবে নিজের জন্য, সেখানে তোমার মনের সুরই আসল সুর। শুধু কথাগুলো ভালো করে বুঝে গেও, তাহলেই হবে।”
-“ধুর কী যে বলো না! কোথায় সবাই মিলে মজা করে হৈ চৈ করবো, তা- না ঘরের কোণে চুপচাপ বসে থাকো।”
-“তা বটে, তোমাদের মজাটাই তো আসল, সেটাই তো ঠিক জমলো না।”
-“তবেই বলো। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে দাদু, ছোটবেলায় আমাদের রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন! একমাস ধরে সে কি আনন্দ, হৈ চৈ! স্কুল থেকে ফিরে কোনওমতে নাকে মুখে গুঁজেই দে ছুট্ —রিহার্সালে। আবৃত্তি, গান নৃত্যনাট্য, আরও কতো কী। তারপর রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিনে কতো লোক, ফুল, মালা, আলো, হাততালি, আহা! কী যে আনন্দের দিন ছিলো সেসব।”
-“হুম্”
-“কী-ই তখন থেকে শুধু হুঁ হুঁ করেই যাচ্ছো। আচ্ছা তুমি সবসময় এতো কুল থাকো কী করে বলো তো? তুমিই তো বলো রবিঠাকুর তোমার জীবনের একমাত্র ঠাকুর! তাঁর জন্মদিনটা এইভাবে চলে গেল,খারাপ লাগছে না তোমার?
-“না তো, আসলে আমার ঠাকুরের যে প্রতিদিনই জন্মদিন।”
-“কী যে হেঁয়ালি করো না তুমি! রোজ কারও জন্মদিন হতে পারে নাকি?”
-“পারে বৈকি। প্রতিদিনই আমি যে তাঁকে নতুন রূপে পাই, আমার মনে তাঁর নিত্য নতুন উদ্ভাস।”
-“বুঝলাম না ঠিক।”
-“না বোঝার তো কিছু নেই দিদিভাই, তিনি রোজ আমার মননে নতুন ভাবে ধরা দেন, তাই তিনি নিত্যই নূতন।”
-“আর, তুমি যে বলো তিনিই তোমার একমাত্র ঠাকুর, মানুষ কখনও ঠাকুর হয় নাকি?”
-“হয় বৈকি। একলা রাতের অন্ধকারে, মানুষ যখন নিজের সঙ্গে নিজে একা, সংসারের অকূল পাথারে দিশাহারা, তখন তিনিই তো এসে হাতখানি বাড়িয়ে দেন, একলা পথের সঙ্গী হতে।”
-“আচ্ছা তিনি কি কেবল তোমারই ঠাকুর?”
-“তেমন করে চাইলে তিনি সবারই ঠাকুর, শুধু তাঁর মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করার অপেক্ষা।”
-“পাবো কোথায় সেই মন্ত্র?”
-“গীতবিতানের পাতায় পাতায়, তাঁরই পূজার গানে।”
-“দাদু একটা গান গাও না প্লিজ।”
-“বেশ লাইটটা নিভিয়ে এসে বোসো, আমার সাথে গলা মেলাও।”
-“আমার যে গলায় তেমন সুর নেই!”
-তাতে কী, মনপ্রাণ ঢেলে গাইলে, সুর আপনি এসে ধরা দেবে তোমার প্রার্থনায়।”
-“কোন গান দাদু?”
-“চিরসখা হে ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না….”