Site icon আলাপী মন

গল্প- ভালোবাসা ফিরে যায়, ভালোবাসা ফিরে ফিরে আসে

ভালোবাসা ফিরে যায়, ভালোবাসা ফিরে ফিরে আসে
-সুনির্মল বসু

 

 

স্কুলে ফার্স্ট বয় ছিলাম, উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করে বঙ্গবাসী কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছি। ট্রেনে যথেষ্ট জায়গা থাকলেও, পাদানিতে ঝুলে কলেজে যাই। বন্ধুদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে সিগারেট খাই। একটা হিরো হিরো ভাব মনের মধ্যে সব সময়। কলেজ ম্যাগাজিনে লিখি। কলেজ পালিয়ে আলেয়া সিনেমায় “চাঁপা ডাঙ্গার বউ” সিনেমা দেখি।
সেকেন্ড ইয়ারে পড়বার সময়, একদিন ট্রেনে ভাস্বতী সান্যালের সঙ্গে আলাপ। ও পড়ে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে, ইংরেজিতে অনার্স।
কলেজ ছুটির পর, মাঝে মাঝে দেখা হয়। তখন মনটা ভীষণ ভালো হয়ে যায়। ও খুব সপ্রতিভ। একদিন বসুশ্রীতে ওর সঙ্গে “কখনো মেঘ” সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম।

বরাবরই আমি একটু বেশি ইমোশনাল। ওকে নিয়ে মনে মনে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। নিজেদের পড়াশুনা নিয়ে মাঝে মাঝে আলোচনা হয়। কিন্তু ওর কথাবার্তা বা আলাপ-আলোচনায় কখনো ভালোবাসার কথা ওঠেনি। অথচ, একতরফা আমি ওকে মনে মনে ভালোবেসে চলেছি।
বুঝতে পারছি, অনার্সের পড়াশুনোর দফারফা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার কোনো হুঁশ নেই।
ওর সঙ্গে একদিন দেখা না হলে, কলকাতার রাস্তাঘাটে যেন যানজট হয়, ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে পড়ে বিপন্ন এম্বুলেন্স।

একদিন কলেজ ছুটির পর ওর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। বললাম, একটা কথা বলবার ছিল..
-কি?
-ভালবাসি তোমাকে,
-কিন্তু আমি তো আপনাকে দাদার মতো দেখি।
-এই বন্ধুত্ব কি ভালোবাসা রূপ নিতে পারে না?
-আমি এভাবে কখনো ভাবি নি।
ফিরে এলাম। আর কখনো ওর সঙ্গে দেখা করিনি। এত বড় অপমান ভুলতে দীর্ঘ সময় লেগে গিয়েছিল।
দূর থেকে দেখলেও, ওর সঙ্গে কথা বলবার মতো ইচ্ছে জাগে নি কখনো।

পরবর্তীকালে শুনেছি, কে এম ডি-এর এক বড়কর্তার সঙ্গে ভাস্বতীর বিয়ে হয়েছে। ভদ্রলোক বয়সে ওর চেয়ে অনেক বড়। পয়সাওয়ালা লোক। বুঝতে পারলাম, ভাস্বতী অংকটা ভালো বোঝে। আমার মত চালচুলোহীনের সঙ্গে জীবন জুড়ে দেওয়ার কোনো মানে হয় না, প্রবল বুদ্ধিমতী ভাস্বতী সেটা সঠিকভাবে বুঝেছিল।

সময় সবচেয়ে বড় চিকিৎসক। সময় সব ভুলিয়ে দিতে পারে। মনের উপর কত পলি পড়ে। জীবনের প্রবল দুঃখগুলো মানুষ একসময় ভুলে যায়। ভুলে যেতে হয়। তা না হলে, বাঁচা যায় না।
ঘুরে দাঁড়িয়ে আমি আবার নতুন যুদ্ধ শুরু করলাম। প্রতিটি পরীক্ষায় ভালো ফল করলাম। কলেজে অধ্যাপনার কাজ পেলাম।

দাম্পত্য জীবন শুরু হলো। মা-বাবার ইচ্ছে এবং পছন্দ মতো সুমিতাকে বিয়ে করলাম। আমার ব্যক্তিগত জীবন মোটের উপর সুখের। আমাদের একমাত্র ছেলে অভিলাষ খুব কৃতী ছাত্র। সে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। এরই মধ্যে একটা কর্পোরেট হাউসে ভালো চাকরি জুটিয়ে নিয়েছে।
আমি বা আমার স্ত্রী সুমিতা ছেলের বিয়ের কথা এখনই ভাবিনি। নিজের পায়ে দাঁড়াক, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হোক, আমরা দুজন এটাই চেয়েছিলাম।

আমার কলেজে এখনো পাঁচ বছর চাকরি আছে। সেদিন কলেজ থেকে বাড়িতে ফিরেছি। তখন সন্ধ্যেবেলা। ল্যান্ড ফোনটা বেজে উঠলো, সুমিতা ফোনটা ধরে আমাকে বললো, এক ভদ্রমহিলা তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন।
আমি ফোন ধরলাম- হ্যালো,
ও প্রান্ত থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, আমি ভাস্বতী বলছি, আমাকে চিনতে পারছেন,
বহু বছর পর শরীরের মধ্যে বিদ্যুতের শিহরণ খেলে গেল। বললাম, কি ব্যাপার,
ভাস্বতী বললো, আমার একমাত্র মেয়ে মিলি, আপনার ছেলে অভিলাষকে খুব ভালোবাসে, এ ব্যাপারে আপনার অভিমত জানতে চাই,
আমার মাথাটা কেমন ঘুরে গেল। এসব কবে কখন ঘটে গেল, আমি বা আমার স্ত্রী সুমিতা কিছুই জানিনা। বললাম, এ ব্যাপারে আমার কিছুই জানা নেই, আমি অভিলাষের মায়ের সঙ্গে কথা বলবো, আমার ছেলের সঙ্গেও আমাকে কথা বলতে হবে।
ভাস্বতী বলল, আপনার শরীর ভালো তো, কতদিন আপনাকে দেখি না।
আমি পরিষ্কার সেই অপমানের দিনটাতে পৌঁছে গেলাম। আমি আপনাকে দাদার মতো দেখি, এভাবে কখনো ভাবি নি।

অপমানটা দেখলাম, আজও আমি একটুও ভুলিনি। অতীত স্মৃতি ডুবো পাহাড়ের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়ালো।
এবার আমি অতীত অপমানের বদলা নিতে পারি।
আমি সুমিতাকে বললাম, তোমার ছেলে একটা মেয়েকে ভালোবাসে, কই আমাকে তো কখনো বলোনি!
ও বলল, অভিলাষ আমাকে বলেছে, অনেকদিন হলো, মিলি বলে একটি মেয়ে ওকে ভালোবাসা জানিয়ে আসছে, ও এখন নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত, তাই হ্যাঁ, না কিছু বলেনি।
বললাম, ছেলের সঙ্গে কথা বলো, ওর মতামত আমাকে জানাও।
দুদিন পরে সুমিতা বললো, মিলি মেয়েটা অভিলাষের পছন্দের।

ভেবেছিলাম, ভাস্বতীকে একটা শিক্ষা দেবো, কিন্তু ভালোবাসা ফিরিয়ে দিলে, বুকের মধ্যে যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়, তা আমার মতো কে আর জানে!
পরদিন সকালে ভাস্বতী আমাদের বাড়ি এলো। সঙ্গে ওর স্বামী। ভাস্বতী, অয়ন দেব মুখার্জির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল। ওরা ওদের মেয়ে মিলিকে সঙ্গে করে এনেছেন।

মিলি যথেষ্ট মিশুকে। এর মধ্যেই আমার স্ত্রী সুমিতার সঙ্গে রান্নাঘরে লুচি ভাজার কাজে নেমে পড়েছে।
খাওয়া দাওয়া চলছে, এমন সময় অভিলাষ গাড়ি গ্যারেজ করে ঘরে ঢুকলো।

সুমিতা বললো, ওদের দুজনকে মানাবে খুব।
ভাস্বতী বলল, আমাদের মেয়েকে গ্রহণ করা সবটাই আপনাদের ইচ্ছে।
আমার মনে হলো, সেদিন যে দুঃখ আমি পেয়েছিলাম, আমার ছেলে সেই দুঃখ পাক, আমি চাই না।
আমি আড়ালে ডেকে সুমিতাকে বললাম, ওদের বলে দাও, আমরা আপনাদের প্রস্তাবে রাজি।

Exit mobile version