একাদশী
-জয়তী মিত্র
ও বৌমা আমাকে একটু সাবু মেখে দেবে, আজ একাদশী, সাবু আর ফলমূল ছাড়া আজ আমি আর কিছু খেতে পারবো না।
তানিয়া বললো, কেন মা, একাদশী পালন না করলে কি হবে? তোমার শরীর খারাপ হবে মা, তোমাকে কিছু পালন করতে হবে না। তোমাকে নিজের জন্য আমাদের জন্য এখনও অনেকদিন বাঁচতে হবে মা। আমি রোজকার মত মাছের ঝোল আর ডাল ভাত রান্না করেছি। তুমি আজ তাই খাবে।
তানিয়ার শাশুড়ি মা গৌরী দেবী বললেন, তুমি কি ভুলে গেছো বৌমা, আমি বিধবা, আমাদের একাদশী পালন করতে হয়। না হলে যে তোমার বাবার আত্মা শান্তি পাবে না মা। আর সমাজ কি বলবে? বিধবা মানুষ একাদশী পালন না করে মাছ, ভাত খাচ্ছে। আত্মীয় স্বজনরা আগে কটু কথা শোনাবে বৌমা।
তানিয়া বললো, শোনো মা, আমি ওসব আত্মীয় স্বজনদের আর সমাজের কথা তোয়াক্কা করি না। যেদিন বাবা রাতে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, হাসপাতালে নিয়ে যাবার সময় কোন প্রতিবেশী, আর কোন আত্মীয় আমাদের পাশে ছিল বলো তো? আমি আর তোমার ছেলে যখন বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম তখন বাবা আর নেই। চিকিৎসা করাবার সুযোগটুকুও আমাদের দেয় নি। হার্ট অ্যাটাকে বাবা চলে গেলো। সেই মুহূর্তে আমাদের পাশে, তোমার ছেলের দুজন কলিগ ছাড়া আর কেউ ছিল না মা। আত্মীয়রা দু’দিন পরে তোমার সাথে দেখা করতে এলো। একটু দুঃখ প্রকাশ করলো । তারপর নানা রকম বিধি নিষেধ তোমার ওপর চাপিয়ে তারা চলে গেল। তোমার দুঃখের দিনে কজন তোমার পাশে ছিল বলো তো?
দেখো তো মা মাছের ঝোলটা কেমন হয়েছে? তোমার মত হয়েছে? তুমি তো আমাকে রান্না করতে শিখিয়েছ। তোমার কাছে কত রকম সাবেকি রান্নার পদ শিখেছি। মাছ দিয়ে ভাত মেখে জোড় করে মায়ের মুখে তুলে দিল তানিয়া।
-ভালো হয়েছে বৌমা। তবে আজ আমি বিরাট পাপ করলাম মা।
-কিছু পাপ হয়নি মা। সমাজ এখন অনেক আধুনিক হয়েছে। এখন সবাই মাছ, মাংস খায়। ঠিক করে। স্ত্রী মারা গেলে কি পুরুষ মানুষরা মাছ, মাংস, ডিম খাওয়া বন্ধ করে দেয়? দেয় না, বাবাকে তুমি খুব ভালোবাসতে, আর বাবাও তোমাকে খুব ভালোবাসত। ওপর থেকে বাবা, খুশি হবেন এই দেখে যে তুমি ভালো আছো। আর তুমি সারাদিন উপোস করে সাবু খেয়ে থাকলেই বাবার আত্মা কষ্ট পাবে।
পুরুষ মানুষদের বউ মারা গেলে সমাজ তাদের আবার বিয়ে করার বিধান দেয়, কিন্তু একজন মহিলার স্বামী মারা গেলে তাকে সাদা শাড়ি পড়ে নিরামিষ খেয়ে বিধবা সেজে থাকতে হবে কেন? আমরা মেয়ে তাই। অবশ্য মেয়েরাই মেয়েদের সবচেয়ে বড় শত্রু। আমরা মেয়েরাই মেয়েদের ওপর চিরকাল নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে এসেছি। কখনো কারোর সমস্যার সমাধান না করে সেটা নিয়ে জল ঘোলা করি।
বৌমার কথাগুলো শুনতে শুনতে কখন যে ভাতের থালা শেষ হয়ে গেছে সেটা বুঝতেও পারেনি গৌরী দেবী। বৌমার জিন্স কুর্তি পড়ায় আপত্তি থাকলেও কোনোদিন মুখে কিছু বলেন নি। আজ গৌরী দেবী বুঝলেন, বৌমা শুধু পোশাকে নয়, মানসিকতায়ও আধুনিক।
ঠিকই সমাজে নিয়মের বেড়াজাল থেকে আমরা মেয়েরাই মেয়েদের মুক্ত করে তাদের ডানা মেলে ওড়ার সাহস জোগাতে পারি। তানিয়ার মত মেয়েরা আমাদের সমাজের সম্পদ। এই নতুন প্রজন্মের মেয়েরাই সমাজের কুসংস্কারগুলো সরিয়ে সকলকে আশার আলো দেখাতে পারবে।