পরিবর্তনের পটভূমিতে
-শচীদুলাল পাল
অপরাজিতা মুখার্জি ডাক নাম অপু। সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের ক্লার্ক। বিটি রোডের মোতিঝিলে ব্যাঙ্ক লোনে ফ্ল্যাট কিনে বছর পাঁচেক হলো চলে এসেছে। সাথে হাসব্যান্ড দীপক, নয় বছরের মেয়ে লাবনী। বালিতে শ্বশুর শাশুড়ী থাকেন। এখান থেকে তার অফিস কাছেই হবে। দীপকের ( দীপু) সাথে প্রেম করে বিয়ে। দীপক আগে কম বেতনে এক প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতো। অবস্থা ভালো ছিল না। পরে নানান জায়গায় এপ্লাই, পরীক্ষা, ইন্টারভিউ দিতে দিতে অপরাজিতা ব্যাঙ্কের চাকরিটা পেয়ে গেল। বছর খানেকের মধ্যে তাদের মেয়ে লাবনীর জন্ম হলো। বাচ্চার দেখভাল, অফিস, ঘর সংসার করা ভীষণ অসুবিধা। তাই অপরাজিতা একদিন দীপককে বললো, – তোমার চাকরি করার দরকার নেই। প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি। ওই কটা টাকা বেতন। আমি যা বেতন পাই তাতে সংসার চলে যাবে। তুমি ওই চাকরিটা ছেড়ে দাও।
-বেশি বেতনের চাকরির জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। হয়নি। কি করবো বলো।
-ও আর হবেও না। তার চেয়ে বরং লাবনীকে দেখভাল করো। ঘর সংসারের কাজকর্ম করো। আমাদের একমাত্র মেয়ে আদরে-যত্নে মানুষ হবে, বড়ো হবে। তাকে নিয়মিত স্কুলে নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসা করো। আমাকে একটু অফিস থেকে এসে জিরোতে দাও।
-বেতন কম হলেও মাসে মাসে টাকা কিছু তো ঘরে আসছে। সেটা বন্ধ হয়ে যাবে।
– তোমার বেতনের কথা আর বলো না। রান্নার লোককে তার চেয়ে বেশি দিতে হয়।
দীপক হালকা প্রতিবাদ করবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু অপরাজিতার ধমকে তাকে সায় দিতে বাধ্য হতে হলো।
চাকরি ছেড়ে দীপক ঘর সংসারের কাজকর্ম দেখাশোনা, অপরাজিতা আর লাবনীর দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করাতে মন দিল।
চৈত্র মাসের গরমে ভোরের বেলাটা বড়ো স্নিগ্ধ, মিষ্টি। দক্ষিণ খোলা জানালায় মলয় বাতাস। আগের রাতে অনেকক্ষণ টিভিতে খেলা দেখায় শুতে দেরি হয়ে গেছিল। তাই দীপকের ঘুম ভাঙতে বেশ দেরি হয়ে গেছে আজ। ঘুম ভাঙলো দরজায় কলিং বেলের আওয়াজে। দীপক ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠে দেখলো ঘড়িতে- ৬ঃ৫৫। দীপক দরজা খুলে দেখলো ঝন্টুর বাপ সদাই এসেছে।
দীপক বললো, -সদাই, তুমি তাড়াতাড়ি বাসনগুলি মেজে দাও। আমি চায়ের জল বসিয়ে দিই।
সদাই কাজের লোক। অপরাজিতাকে দিদি বলে আর দীপককে জামাইবাবু বলে।
সে সিঙ্কে এক গাদা বাসন ধুতে ধুতে বললো, -জানেন জামাইবাবু, আজ একটু দেরী হয়ে গেলো। ভীষণ গা হাত পায়ে ব্যাথা।
-কেন? কি হয়েছে?
-কাল ঝন্টুর মা আমায় মেরেছে।
-কেন। নিশ্চয়ই কিছু দোষ করেছো?
-না। কাল এ বাড়ি সে বাড়ির কাজ শেষে ফেরার পথে ধর্ম বোনের বাড়ি গিয়েছিলাম দেখা করতে। ঝন্টুর মা ভীষণ সন্দেহবাতিক। ধর্মবোনের সাথে আমি নাকি লটঘট করি। বেলনা দিয়ে প্রচন্ড মারলো। সারারাত ঘুমাতে পারিনি।
-ঠিকই করেছে। অমন কাজ কেন করো?
-এসব কথা কাউকে বলতে পারিনা। একমাত্র আপনাকে বললাম।
-এসব কথা কি বলা যায়। লোকে হাসাহাসি করবে।
দুরন্ত এক্সপ্রেসের গতিতে ঝন্টুর বাপ বাসন মেজে ঘর মুছে অন্য বাড়িতে কাজ করতে চলে গেল।
-দীপক চা তৈরি করে কাপে ঢেলে অপরাজিতার বেডরুমে ঢুকে দেখলো মা-বেটিতে জড়াজড়ি করে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। দীপক গায়ে হাত দিয়ে ডাকলো। অপু তোমার চা রেডি। অপু পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে বললো, -আমি আর একটু ঘুমাবো।
-অফিস যেতে দেরি হয়ে যাবে।
-না। আমি এখন উঠছি না। তুমি চা’টা ডাইনিং টেবিলে রেখে দাও।
দীপক দেখলে আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে। কখন যে মেয়েকে রেডি করে স্কুলে, বউকে অফিসে পাঠাবে।
গতকাল এমনি দেরি হওয়ায় অপুর ভালো করে স্নান খাওয়া হয়নি। সে একটা বুদ্ধি খাটিয়ে বললো -তোমাদের এবার পে স্কেল বৃদ্ধির টাকাটা দেবে লিখেছে কাগজে।
-কোথায় দেখি।
-ব্যালকনিতে পেপার আছে। পড়ো গিয়ে চা খেতে খেতে।
অপরাজিতা অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিছানা থেকে উঠে পেপার পড়তে পড়তে বললো, -কই! কোথায়?
মুচকি হাসি হেসে দীপক বললো, -মিথ্যে না বললে তুমি কি আর বিছানা ছেড়ে উঠতে! তোমরা দুজনেই ফ্রেশ হয়ে নাও, আমি চট করে বাজার থেকে সবজি আর মাছটা নিয়ে আসি।
দীপক আধঘন্টার মধ্যে ফ্রেশ সবজি, টাটকা, সামুদ্রিক মাছ, আর কিছু ছোট মাছ কিনে ঘরে যখন পৌঁছালো দেখলো অপু চা খেয়ে শুয়েই পড়েছে। লাবনী একবার চোখ মেলে আবার পাশ ফিরে শুয়েই পড়লো। দুজনকে আদর করে টেনে তুলে দিয়ে রান্নাঘরে রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ব্রেকফাস্টে গরম গরম পরোটার সাথে বেগুন ভাজা আলুর দম, প্লেট ভর্তি ফল।
অপরাজিতা এতসব দেখে বললো, -এতসব খেয়ে ভাত খাব কখন?
একটা পরোটা খাব। তুমি বরঞ্চ ভাত ডাল মাছের ঝোল সবজি রান্না করে দাও শিগগির।
দীপক রান্না ঘরে ওভেনে একটাতে ভাত অন্যটাতে ডাল বসিয়ে সবজি কাটতে ও মাছ ধুতে ধুতে ভাবছে, লাবনী স্নান করে আসলে তার জামা পরিয়ে দেওয়া, চুল আঁচড়ানো, ফিতে বেঁধে দেওয়া ইত্যাদি কাজ করে স্কুটিতে করে স্কুল পৌঁছে দিতে যেতে হবে।
সে হাত চালিয়ে সবজি আর মাছের ঝোল করে প্লেট সাজিয়ে ডাইনিং টেবিলে রেখে মেয়ের ব্যাগ গোছাতে গেল। মেয়ের জুতার ফিতে বেঁধে স্কুলে পৌঁছে দিতে বেরোতে যাবে দেখলো অপরাজিতা ( অপু) মোবাইল নিয়ে চ্যাট করছে।
দীপক বললো, মোবাইল রাখো।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখো কটা বাজে।
-ওসব তোমাকে দেখতে হবে না। তুমি নিজের চরকায় তেল দাও।
মেয়ে বললো- বাপি। তাড়াতাড়ি চলো। দেরি হয়ে গেছে।
দীপক গ্যারেজ থেকে স্কুটি বের করে মেয়েকে স্কুল পৌঁছাতে বেরিয়ে গেল। মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে ঘরে এসে দেখে অপু এখনো অফিসে বের হয়নি। সে বাথরুমে স্নান করছে। অপু ঝটপট বাথরুম থেকে বেরিয়ে তৈরী হতে হতে বলে,
শাড়ীগুলো ইস্ত্রী করে রাখোনি কেন। পাট পাট শাড়ি ছাড়া আমিতো পরিই না তুমি জানো। আজ কোন শাড়ি পরে যাব?
-আজ সালোয়ার স্যুট পড়ে যাও।
-আমি কি পরে যাব সেটা আমি বলবো। তুমি এখনই এই শাড়ীটা ইস্ত্রী করে দাও। কাচা রুমাল দাও একটা।
অগত্যা দীপক তাই করে, তার ভ্যানিটি ব্যাগ গুছিয়ে হাতে দিয়ে বললো, আর কি?
-ওহো। টিফিনের খাবার প্যাক?
-এই তো। ডাইনিং টেবিলে রেডি করে রেখে গেছি।
-ওই সেই পরোটা আর আলুর দম খেতে খেতে জিভে চড়া পড়ে গেলো।
-ঠিক আছে। কাল থেকে নতুন কোনো রেসিপি করে দেব। এগরোল, গাজরের হালুয়া, চিঁড়ের পোলাও। লুচি আর চিলি চিকেন। দইবড়া। স্যান্ডউইচ। লুচি ঘুঘনি। যা চাইবে তাই। আমি টি ভি দেখে অনেক রেসিপি শিখেছি। আসলে তোমার যা ভালো লাগে তা লাবনীর ভালো লাগে না। লাবনীর যা ভালো লাগে তা তোমার ভালো লাগে না।
অপু মনে মনে ভাবলো, দীপু রান্নবান্নাটা ভালোই করে, যেকোনো পাক্কা গিন্নীকে হার মানিয়ে দেবে। তবু সে বললো,
– তোমার রান্নার যা ছিরি? যাই হোক। এখন চলি।
অপু অফিসে বেরিয়ে গেলে দীপু বাথরুমে গিয়ে দেখলো মেয়ের জামাকাপড় ও অপুর শাড়ি, গতকালের নাইটি, ব্লাউজ, অন্তর্বাস সব একপাশে ঢিপ হয়ে পড়ে আছে। এখন এগুলো সব কেচে মেলতে হবে। একবার বেরিয়ে নিউ মার্কেট থেকে কিছু ঘর সাজানো জিনিসপত্র কিনে আনতে হবে।
এবাড়িতে অপুর কলিগ বন্ধু বান্ধবী যারা এসেছে তারা শুধু সুস্বাদু রান্নার নয়, সবাই ঘর গোছানো, টিপটাপের খুব প্রসংশা করেছে। অনেক বান্ধবী বলেছে, অপরাজিতার হাসব্যান্ড এত কাজের, এত সুন্দর রান্না করতে পারে আর আমাদের হাসব্যান্ডরা একদম যেন কেমন নাদুস নুদুস মার্কা। কুড়ের হদ্দ।
ঝন্টুর বাপের ঘর মোছা তার একদম পছন্দ নয়। সে ঝন্টুর বাপ চলে গেলে আবার সব ঘর নিজে হাতে মুছবে। আজও তাই করলো। বিছানা ঠিকঠাক করতে গিয়ে দেখলো অপুর গলার একটা সরু চেন পড়ে আছে। এটাতো নতুন ঠেকছে। কখন কিনেছে কে জানে! গয়না পড়তে সব মেয়ে ভালবাসে কিন্তু অপু গয়না পড়েই অফিসে যায়। একটু বেশি সৌখিন। অফিস ফেরত জিমে যায়। শরীরটা বেশ ফিট রেখেছে। আকর্ষণীয় চেহারা। দীপু কখনো বাধা দেয়না। নিজের ইনকাম, যা খুশি তাই করবে।
ঘর গুছিয়ে স্নান খাওয়া সেরে ব্যালকনিতে রোজকার মতো আড্ডা দেবে। সুখ দুঃখের কথা বলবে। আজ সৈকত আগে এসেছে। সেও শুধু ঘর সংসারের কাজ দেখাশোনা করে তার মিসেস চাকরি করে বেশ উঁচু পদে।দু-নম্বরী ইনকামও আছে। পার্টিতে ড্রিংক করে অনেক রাতে ঘরে ফেরে। বলতে গেলেই ঝগড়া।
দীপু সৈকতকে জিজ্ঞেস করলো, -কাল রাতে কি হয়েছিল? খুব চীৎকার চ্যাঁচামেঁচি হচ্ছিলো।
-ও তেমন কিছু নয়। মিসেস মদ খেয়ে বন্ধুটির হাত ধরে টলতে টলতে ঘরে ঢুকলো। আমি চুপচাপই ছিলাম। দেখলাম বেডরুমে কাপড় বদল করার সময় এক অপ্রীতিকর জঘন্য দৃশ্য। তাই অবজেকশন করেছিলাম। তাই দুজনে মিলে আমাকে হেনস্থা করলো।
-আপনি চুপচাপ থাকলেন?
-দুজনের সাথে পেরে উঠা যায়! হেরে গেলাম। কিছুটা ইচ্ছা, কিছুটা অনিচ্ছায় হারতে বাধ্য হলাম। অবলা হয়েই আমাকে থাকতে হবে। আমি যে সুখে আছি সেই সুখ থেকে বঞ্চিত হতে চাই না। পাখির বাসাটা ভেঙে দিতে চাই না। এই যে খাচ্ছি দাচ্ছি ঘুমাচ্ছি বউয়ের টাকায় শুয়ে বসে আয়েস করছি। এতো গড গিফটেড। ব্যাঙ্ক শেয়ার সবই তো জয়েন্ট। বাগুইহাটিতে বিশাল জমির আমি মালিক। ইনকাম ট্যাক্স-এর ঝামেলা থেকে, ভিজিল্যান্স থেকে অব্যাহতি দিয়েছি।
-তা বলে অনাচার সহ্য করবেন?
-অনাচারের কথা বললে বলে, ডিভোর্স দিয়ে দেব। তার হুমকির কাছে ভয়ে আমি ঠিক করেছি আর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবো না।
-তা বলে মদ খাওয়া?
-সেখানেও আমি বাধা দিইনি। বলেছি বাইরে না খেয়ে খাবার জিনিস, ঘরেই তো খেতে পারো।তখন থেকে আমি নিজেই পেগ বানিয়ে দিই। মদের সাথে খাবার চিকেন পকোড়া, ফিস ফ্রাই, মাটন কষা আমি নিজের হাতে বানিয়ে দি।
-আর আপনি? নিজে খান?
-প্রথম প্রথম খেতাম। এখন খাই না। আমার ফ্যাটি লিভার। আর কিডনির সমস্যাও আছে।
-আর ছেলে?
-বি.এইচ.ইউ. তে পড়ে।
-কি পড়ছে?
-ফিজিক্সে এম.এস.সি।
-আজ এ পর্যন্ত থাক। আমার সময় হলো স্কুল থেকে মেয়েকে আনতে যাবার। সে তো অনেক দেরী।
-আসলে একটু আগেই বেরিয়ে কয়েকটি সৌখিন জিনিসপত্র কিনতে নিউ মার্কেট যাব। কেনাকাটা সেরে মেয়েকে নিয়ে আসবো।
এইভাবেই চলতে থাকে। অপু অফিস থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে সোফায় বারান্দায় বেতের চেয়ায়ে বসে গা এলিয়ে দেয়। সেদিন কস্টলি চা পাতার সুস্বাদু চায়ে চুমুক দিয়ে দীপুকে বললো, তোমাকে যে বলেছিলাম পান আনতে। এনেছো?
-হ্যাঁ। এই নাও। পান দিয়ে বললো, আমি রান্নাঘরে ব্যস্ত। আজ মাটন কষা আর লুচি হবে।
কিছুক্ষণ পর অপু ডাকলো- দীপু! দীপু! কি শুনতে পাচ্ছ না?
দীপু রান্না ঘর থেকে সাড়া দিল, -যাচ্ছি।
-পানের জর্দা আর পিকদানিটা দিয়ে যাও।
দীপু রান্নাঘর থেকে ছুটতে ছুটতে এসে জর্দা আর পিকদানি দিয়ে গেল।
ফাই ফরমাস খাটতে খাটতে অভ্যেস হয়ে গেছে। প্রতিবাদ করবে সে ভাষাও নাই। গতকাল সৈকতের কাছ থেকে তাদের পারিবারিক ঝামেলার কথা শুনে যা জানতে পেরেছে তাতে তার চক্ষু চড়কগাছ।
যদি ঐরকম ডিভোর্স করে দেবো বলে ধমকি দেয়, তাহলে কি উত্তর দেবে? কোথায় যাবে? কি করবে? এই বয়সে আরেকটা বিয়ে! এই অকর্মণ্য বেকার পুরুষকে কেউ করবে না। সেটা সে ভাল করেই জানে। সুতরাং অপু যা যা বলছে, সেগুলো মেনে চলা, ফাইফরমাশ খাটাটাই যুক্তিযুক্ত।
ফিলজফিতে এম.এ. করে দু’ একটা কম্পিউটারের কোর্স করেছিল। চাকরির চেষ্টা করলে হয়ত হয়ে যেত। ধরে রাখলে বেতন হয়তো কিছু বাড়তো। আরও যাদের চলে তারও তাদের মতো চলতো। কিন্তু সে অনেকটা পথ চলে এসেছে। এখান থেকে ফেরার কোনো রাস্তা নেই।
রাত হলো। ঠিক দশটায় লাবনীর পড়া শেষে ডিনার সার্ভ করলো দীপু। মা বেটিতে একসাথে খেয়ে নিলে লাবনী শুয়ে পড়লো।
সবকিছু গুছিয়ে দক্ষিণ খোলা এই ছোট্ট রুমটায় জানালার ধারে শুয়ে পড়েছে দীপক। সারাদিন খাটাখাটুনি শেষে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই ঘুম নেমে আসে। এই সময় অপরাজিতা হোয়াটসঅ্যাপে চ্যাট করে। মাঝে মাঝে দেখেছেও। তাও আবার শরীর নিয়ে। দীপক মাথা ঘামায় না। তার আর কি বলার আছে। কাল সকাল থেকে অনেক কাজ। মেয়েকে সাঁতারের ক্লাবে নিয়ে যাওয়া।
কিছু ড্রেস ম্যাটেরিয়াল কেনা সপিং মল থেকে। অপুর কাল সেকেন্ড স্যাটারডে ছুটি। ছুটির দিনে স্পেশাল ডিশ তৈরি করতে হবে। দুরের মার্কেট থেকে খাসির মাংস আনতে যেতে হবে।
মাটন বিরিয়ানি করতে হবে। রাতে ইলিশ পাতুরি। কিম্বা ভাপা ইলিশ। অসময়ে ইলিশ চড়া দাম। তা যতই দাম হোক সাইজ যেন বড়ো হয় বলে দিয়েছে অপু। এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে দীপক।
হঠাৎ তার ঘুমটা ভেঙে গেলো। জানলা দিয়ে চীৎকারের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কোথাও যেন ঝগড়া ঝাঁটি হচ্ছে। দীপু ঘুম থেকে উঠে দেখল অপু ও লাবনী গভীর ভাবে ঘুমাচ্ছে।
দীপু পা টিপে টিপে ব্যালকনিতে এলো। এখান থেকে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে তাদের মাথার উপরের ফ্ল্যাটে স্বামী- স্ত্রী সুমি-মদনের ঝগড়া। মাঝে মাঝেই মধ্য রাত্রিতে শোনা যায় ওদের কলহ। সুমিটা কি একটা কাজ করে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। আর মদন একদম বেকার। খুব একটা শিক্ষিত নয়। সুমি যখন থাকে না সেইসময় সকালবেলা একটা মেয়ে আসে। সে নাকি পিসতুতো বোন। আর এই মেয়েটার আসার ব্যাপারটা ফ্ল্যাটে আসার সাথে সাথে সিকিউরিটি গার্ড মারফৎ সব জেনে সুমি ঝগড়া করে।
আজ একেবারে রণং দেহি।
-তোমাকে আজ মেরেই দেব।
-আমি কি করেছি!
-মেয়েটা কেন আসবে?
-সে আমার পিসতুতো বোন। বোন আসলেও তুমি সন্দেহ করো।
এক চড় মেরে- বোন! এক পবিত্র নামের অবমাননা করো না। মোবাইলে ভিডিও দেখবে। এই দেখো তোমাদের দুজনের অপকর্ম।
—
-কই দেখি দেখি বলে মোবাইল কেড়ে নেয়। সাথে সাথে সুমি মদনকে ছড়ি দিয়ে পেটায়। মোবাইল ছিটকে পড়ে যাবার শব্দ হয়।
-হারামি। আমার মোবাইল ভেঙে দিলি।কিনে দেবার মুরোদ নাই। পারবি এত দামী মোবাইল কিনে দিতে। আরও পেটায়।
-ও মাগো। কে কোথায় আছো বাঁচাও। বলতে বলতে এক সময় চুপ হয়ে যায়।
মনে হয় অজ্ঞান হয়ে গেছে। ভাবতে ভাবতে দীপক শুতে চলে যায়। কাল তার অনেক কাজ। সকালে উঠতে হবে। কাজের লোক ঝন্টুর বাপ আসবে। তাকে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। আবার দীপক ঘুমিয়ে পড়ে।
আজ দীপক বাইরের কাজ, কেনাকাটা, মেয়ের সুইমিং ক্লাব থেকে ফিরে ঘরের যাবতীয় কাজ শেষে রান্নাঘরে ব্যস্ত।
অপরাজিতা ঘরেই মৌজ করবে। ছুটির দিন। সকাল থেকে শুধু ফোন। চ্যাট। গান শোনা। টিভিতে মুভি। একবার পার্লারে গিয়ে আপাদমস্তক ফেসিয়াল, হেয়ার রিমুভিং করে অবাঞ্ছিত রোম তোলার কাজ, পেডিকিওর চুলের ছাঁট, ম্যাসেজ করিয়ে এসেছে। সুন্দরী অপুকে আরও সুন্দরী লাগছে। আজ বাথ টাবে স্নান করতে নেমে দেখে বাথটাবের ফেনার স্পেশাল সোপ নেই।
মেজাজ বিগড়ে সে দীপুকে আচ্ছা করে ঝেড়েছে। কি দেখো ঘরসংসারে।
-ভুল হয়ে গেছে। এর পরে যখন যাব তখন এনে দেব।
কতদিন থেকে বলছি, একটা ওয়াশিং মেশিন কিনে দাও। তা গা করছ না কেন?
-ওয়াশিং মেশিন কিনবো না। জামাকাপড়ের কালার ফেড হয়ে যায়। তাছাড়া তোমার গতর দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। ভুড়ি বেড়ে যাচ্ছে। একটু গায়ে গতরে খাটো।
-আমি তো উদয়াস্ত খাটছি। আর কত খাটাব।
-কথায় কথায় তর্ক করবে না। গরমে পড়ার জন্য একটা ফিনফিনে কটন ট্রান্সপারেন্ট সামনে টিপ বোতাম নাইটি কিনতে বলেছিলেম। কিনেছো?
-ভুলে গেছি।
-খেতে তো ভোলনি। মনটা আজকাল কোথায় থাকে। যাও এখুনি কিনে নিয়ে আসো।
-এখন কিনতে গেলে রান্নাবান্নার দেরি হয়ে যাবে।
দীপু বাক্স ঘেঁটে একটা পুরানো ওইরকমই নাইটি বের করে বলে,দেখো তো এটা পচ্ছন্দ কিনা?
-এটা কার? কোথায় পেলে?
-এটা তোমারই। বিয়ের পর আমার ইনকাম থেকে আমি তোমায় কিনে দিয়েছিলাম। ট্রাস্পারেন্ট। পড়ো ভালো লাগবে।
আয়নায় নিজেকে দেখে অপু খুব খুশি হলো মনে মনে। তাদের সেই পুরানো দিনের উচ্ছল উদ্দাম মিলনের স্মৃতি মনে পড়তে লাগলো।
কিন্তু সে একি ভাবছে! অপু খুশিটা চেপে রেখে বললো, -তুমি কিনে দিয়েছো! হতেই পারে না। তোমার ওই তো ইনকাম ছিল। শ্বশুর শাশুড়ীর সামনে এগুলি আমি পড়তেই পারি না। তুমি মিথ্যা বলছো।
-নাইটি। রাতেই শোবার সময় পড়তে।
-যাই হোক আজকের মতো পড়ি, কালই আমার জন্য কিনে নিয়ে আসবে।
দীপক আবার রান্না ঘরে ব্যস্ত হয়ে গেল। বাইরে কলিং বেল বেজে উঠলো। অপু দরজা খুলে দেখলে সিকিউরিটি গার্ড দাঁড়িয়ে। অপুর দিকে তাকিয়ে আছে। গিলছে।
-ম্যাডাম। আপনার হাসব্যান্ড স্কুটির চাবি স্কুটিতেই ছেড়ে চলে এসেছেন। এই নিন।
পিছনে পিছনে দীপু।
অপু চাবি নিয়ে দরজা বন্ধ করে দীপুকে আচ্ছা করে ঝাড়লো।
-কি করো? কোন দুনিয়ায় থাকো? অকর্মণ্য আহাম্মক। কেউ যদি চুরি করে নিত তাহলে কি হত। এত দাম দিয়ে কিনে দিলাম। সেটাকে পর্যন্ত রক্ষা করার মুরোদ নেই।নিজের টাকায় কিনতে তাহলে বুঝতে।
-সিকিউরিটি গার্ড আছে না।
-তারা কি করবে? এই বিলডিং-এর কোনো আবাসিক যদি বার করে নিয়ে যেত রাতে, কিছু বুঝতে। ইডিয়ট। কমন সেন্স নেই।
-ভুল হয়ে গেছে। স্বীকার করছি।
-তোমার এই ভুলের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকার গাড়ীটা চোরে নিয়ে পালাতো। তোমার কোন বাপ এনে কিনে দিত? শুনেছি মেয়ে দেখলেই ছুকছুক কর। আজ কোন মেয়ে ছিল?
-আজেবাজে বলবে না। তুমি ছাড়া অন্য কাউকে আমি স্পর্শ করিনি। তা তুমি এই নাইটি পরে দরজা খুলতে কেন গেলে? আয়নায় দেখো সব দেখা যাচ্ছে। মনেই হচ্ছে না তুমি কিছু পরে আছো।
-তুমি আমাকে বলবে? তোমার সাহস তো কম নয়। আমি কত্রী, মালকিন। যা খুশি তাই করবো। তোমার বাপের কি?
এবার দীপু চুপ করে গেলো। রান্নাঘরে গিয়ে চোখের জল ফেলতে লাগলো।
ভারাক্রান্ত মন নিয়ে রান্না করে সার্ভ করলো। নানান উৎকৃষ্ট পদের রান্না। মা ও মেয়ের আলাদা আলাদা চয়েস মতো রান্না।
ইলিশ পাতুরিতে একটু ঝাল বেশি হয়ে গেছে তাই নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দিল। এত দামী মাছ। এ কী রান্না করেছো। না কি আমাকে টাইট করার জন্য। অপদার্থ। তলে তলে এত বুদ্ধি।
লাবনী এবার চুপ থেকে বললো- কই দেখি মা তোমার ইলিশ পাতুরি চেখে।
-কি সুন্দর ডেলিসিয়াস। খুব বেশি ঝাল হয় নি। তুমি মা অনর্থক বাপিকে বকছো।
-তুই শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল?
আমি এই বাড়ির মালকিন আমি যা বলবো তাই হবে। আমি যদি বলি ছয় তাহলে ছয়। যদি বলি নয়, তাহলে নয় বলবি দুজনে। বুঝলি। অগত্যা দুজনেই চুপ করল।
দক্ষিণ দিকের ঘরে তার শোবার ঘরে এলো দীপক। মানসিক দিক থেকে খুব ভেঙে পড়েছে। ল্যাম্প নিভিয়ে নাইট ল্যাম্প জ্বালিয়ে দিপু বিছানায় এলো। শরীর মনে বড়ো ক্লান্তি। মাথাটা টিপটিপ করছে। হঠাৎ অনুভব করলো অপু এসেছে তার বিছানায়।যখন তার মর্জি হয় তখন আসে নিজে থেকে। আজ এসে পাশে শুয়ে কাঁধ ধরে টানছে। দীপু এক ঝটকা দিয়ে সরে গেল।
অপু জড়িয়ে ধরে- এখনো রাগ করে আছ?
দীপু কোনো উত্তর না দিয়ে পাশ ফিরে শুলো। জানো, গতকাল অফিসের হেড বস আমাকে খুব ধাতানি দিয়েছে।
-ও এই ব্যাপার! আমি তো ডাস্টবিন। বাইরের যত রাগ অপমান আক্রোশ সব আমার গায়ে ছুঁড়ে দাও।
অপু আরও ঘন হলো, নাইটির টিপ বোতাম সব খোলা। তপ্ত উদ্ধত নারী মাংস ছুঁয়ে যাচ্ছে শরীর। সরীসৃপের মতো অপুর কোমল হাতের আঙ্গুলগুলি বুকের উপর খেলা করছে।
দীপু ঝাঁঝালো স্বরে- আহ! ঘুমোতে দাও।
-ওমন করছো কেন? এসো না।
-আমার মাথা ব্যথা করছে। ভালো লাগছে না।
অপু দীপুর চুলে হাত বুলিয়ে- ঠিক আছে অন্যায় হয়েছে আর বকবো না।
-সত্যি মাথা ব্যথা করছে।
-এসো টিপে দিচ্ছি।
জোর করে নিজের দিকে মাথাটা ঘোরালো। কপালে ঠোঁটে চুমু খেতে লাগলো।
আর উপায় নেই। মাথা ধরুক আর যাই হোক, সব শরীর খারাপ এখন শিকেয় তুলতে হবে। দীপুর ভালোলাগা মন্দলাগা, এখন সব মূল্যহীন।
কাঁপা কাঁপা গলায় দীপু বললো- এত করেও তোমার মন পাইনা। উদয়াস্ত খাটছি তোমার সংসার ছাড়া কিছুই ভাবি না। কতদিন বাবা মাকে দেখতে যাইনি ।তবু তোমার মুখ ঝাপটানি।
রাতের স্তিমিত আলোতে দেখলো এক বিবস্ত্রা সিংহিনী তার শরীরের উপর উঠে তাকে ন্যস্তনামুদ করে ছাড়ছে। তাকে ছিঁড়ে খাচ্ছে। খলখল উচ্চকণ্ঠে হাসছে।
দীপু যেন এক যন্ত্র। ঘরের আলো ছায়ায়
হঠাৎ দীপু দেখলো তার সামনে শুধু অপু নয় অন্য অজস্র নারী খলখল করে হাসছে। তারা সমস্বরে বলছে—
হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের অনেক সহ্যের কাল শেষ। এবার তোমাদের পালা।
দেখো কেমন লাগে….
অপূর্ব সুন্দর অসাধারণ, ছবির মতো চোখে ফুটে উঠল আধুনিক নারীর অধিকার ।
ধন্যবাদ প্রিয় কবি।
আপনার মন্তব্য ও মুগ্ধতায় প্রাণিত হলাম।
ধন্যবাদ প্রিয় শিল্পী
Darun likhechen
অসংখ্য ধন্যবাদ প্রিয় শিল্পী।
আপনার মন্তব্য ও মুগ্ধতায় খুশি হলাম।
Darun likhechen
আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। আমার লেখনী সার্থক হলো। প্রাণিত হলাম। আন্তরিক ধন্যবাদ প্রিয় কবি।
আপনার মন্তব্যে ও মুগ্ধতায় আমার লেখনী সার্থক হলো। ধন্যবাদ অফুরন্ত প্রিয় কবি।
অসংখ্য ধন্যবাদ প্রিয় সাহিত্যিক।
Darun!
অসংখ্য ধন্যবাদ ও শুভকামনা