গল্প- টক ঝাল মিষ্টি সম্পর্ক

টক ঝাল মিষ্টি সম্পর্ক
-জয়তী মিত্র

 

 

বলি ও ছোট বৌমা ছাদ থেকে আচারের শিশিগুলো নিয়ে এসো, আজ আমার বাতের ব্যথাটা খুব বেড়েছে, আমি আনতে পারবো না। সারাদিন ফোন না হলে সিরিয়াল এই নিয়েই পড়ে থাকো কাজে একদম মন নেই। বড় বৌমা স্কুল থেকে চলে এলে আজ চা’টাও তোমাকেই করতে হবে। মুখের সামনে চা না পেলে আবার ওনার মেজাজ গরম হবে। এই বয়সে এসে এত ফাই ফরমাস আর খাটতে পারি না। সারা জীবন সংসার, দুই ছেলে মানুষ করা তারপর এখন বৌমাদের ফাইফরমাস খাটতে খাটতে জীবনটা শেষ হয়ে গেল। এই পড়ন্ত বেলায় এসেও নিজের দিকে তাকাবার সময় নেই। যে দিক না দেখবো সেইখানেই সমস্যা সৃষ্টি হবে।
ছোট বৌমা তিথি বললো, এই নাও তোমার আচারের শিশি, তোমার জ্বালায় একটু সিরিয়াল দেখার জো নেই, এখন আবার তোমার আদরের বৌমার জন্য চা বানাতে হবে। মাঝে মাঝে অসহ্য লাগে। কি আর করা যাবে,আমি তো আর চাকরী করি না, আমাকে তো কাজ করতেই হবে।

মলিনা দেবী বললেন, এমন কেন বলছো ছোট বৌমা, আমি তো সংসারের রান্নাবান্না সবই করি, তুমি আমাকে সাহায্য করে দাও। ছেলেরা রান্নার লোক তো রাখতে বলে, এবার ভাবছি তাই করবো আর পারছি না। তিথি বললো দিদি ভাইয়ের সামনে তো চুপ করে থাকো, আমাকে যত কথা শোনাও।আমার ঘাট হয়েছে বৌমা আর আমি তোমাকে কিছু বলবো না।
তিথি বললো, অমনি রাগ হয়ে গেল তাই না। আমি কিছু বললেই তোমার রাগ হয়, আর দিদিভাইয়ের মুখ ঝামটা খুব ভালো লাগে তাই না মা?
তিথি আর মলিনা দেবীর মধ্যে এমন মাঝে মাঝেই চলতে থাকে, দুদিন দুজনের কথা বন্ধ তারপর নিজেরাই কেউ কারোর সাথে কথা না বলতে পেরে হাঁপিয়ে ওঠে, আবার গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসে দুজনে।

মলিনা দেবীর বড় বৌমা কবিতা খুব
অহঙ্কারী। চাকরী করে বলে মাটিতে তার পা পড়ে না। পান থেকে চুন খসলেই তার মেজাজ শুরু হয়। মলিনা দেবী তাকে একটু সমীহ করে চলেন। তিথিও তার সাথে একটু দুরত্ব বজায় রেখে চলে।
মলিনা দেবীর স্বামী অমল বাবু সরকারী চাকরী করতেন কিন্তু বড়ো সংসারে তাকেই বেশি টাকা দিতে হতো, দুই বোনের বিয়েতে মোটা টাকা খরচ করতে হয়েছে, নিজের দুই ছেলেকে লেখাপড়া শেখাতে গিয়ে নিজের জন্য কিছুই করতে পারেন নি। রিটায়ার করার পর যা পেয়েছিলেন তার অনেকটাই ওনার অসুখের পেছনে খরচ হয়ে গিয়েছিল। তাদের পৈতৃক বাড়িটাতে অনেক শরিকি ঝামেলা ছিল, তাই তিনি জমি কিনে রেখেছিলেন, পরে বাড়ি করবেন বলে। কিন্তু ওনার সে আশা পূরণ হয় নি। বাড়ি করার আগেই তিনি পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যান।
তারপর বড়ো ছেলে সুদীপ সেই জমিতে লোন নিয়ে বাড়িটা তৈরি করে। অমল বাবুর দুই ছেলেই সরকারী চাকরী করে। সুদীপ যেহেতু বাড়িটা করেছে তাই তার বউয়ের খুব দাপট ছিল সংসারে। ছোট ছেলে সুব্রত তখন নতুন চাকরী পেয়েছে।
তারপর তিথির সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর দুই বছর ছিল সবাই একসাথে ছিল। সুব্রতর বদলির চাকরী। বদলি হবার সময় তিথিকে নিয়ে তার কর্মস্থলে চলে যায়। তবে প্রতি মাসে মায়ের জন্য টাকা পাঠাতো, তিথিও শাশুড়ি মায়ের খুব খোঁজ খবর নিত।

একদিন সকালে সুদীপ আর বড়ো বৌমা এসে মলিনা দেবীকে বলে, তোমার জন্য একটা ভালো বৃদ্ধাশ্রম পেয়েছি, ভাবছি ওখানেই তোমাকে রেখে আসবো, আমরা দুজনেই চাকরী করি, বাড়িতে থাকি না, আর তোমার রাত দিন অসুখ লেগেই থাকে, তোমার দেখভাল করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
ছেলের মুখে এই কথা শুনে দু’ চোখ ছাপিয়ে নোনা জল পড়তে লাগলো মলিনা দেবীর। এ তার ছেলের নয়, বৌমার কথা। বৌমা কদিন ধরে তাকে আকারে ইঙ্গিতে বাড়ি ছাড়ার কথা বলছিল। বড়ো ছেলে, আর বৌমা অফিস বেরিয়ে যেতেই ছোট ছেলেকে ফোন করে সব কথা বলে মলিনা দেবী। ছোট বৌমা তিথি স্বামীর মুখে সব শুনে বলে, মা’কে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এইখানে নিয়ে এসো। সুব্রত বললো, মাকে আমি কিছুতেই বৃদ্ধাশ্রমে যেতে দেব না, তবে তোমার সাথে তো আবার দিনরাত মায়ের ঝগড়া হয়। তুমি মায়ের সাথে আর কোন বিষয়ে ঝামেলা করবে না।
তিথি বললো, আরে ওসব আমাদের মা, মেয়ের খুনসুটি। একটু দুজনের মন কষাকষি হয়, আবার ঠিক হয়ে যায়। মা’কে যে আমি ভালোবাসি সেটা উনি খুব ভালো বোঝেন তাই না তোমাকে ফোন করেছে।
এই হলো টক,ঝাল,মিষ্টি সম্পর্ক। সব ভালো হলে আবার তাহলে কোনো রোমাঞ্চ থাকে না। এই ঝগড়া তো এই ভাব। উনি আমাদের কাছেই থাকবেন। আমি তো দিদিভাইকে খুব ভালো চিনি, জানতাম মা’কে উনি বেশিদিন রাখতে পারবেন না।
তারপর ছোট ছেলের কাছে এলো মলিনা দেবী। ছেলে আর বৌমার যত্নে খুব ভালোই আছে। তিথি বলে, তোমার সাথে ঝগড়া না হলে না আমার ভালো লাগে না মা। মলিনা দেবী হেসে বলেন, পাগলী মেয়ে একটা। আমার সাথে ঝগড়া না করে এবার আমাকে একটা ছোট্ট মিষ্টি নাতনি এনে দে তার সাথে হাসি মজা করে দিন কাটাই।
বাচ্চার কথা শুনে লজ্জা পেয়ে তিথি সেখান থেকে চলে গেল।
কয়েক মাস বাদে তিথি সন্তানসম্ভবা হলো। শাশুড়ি মা তাকে খুব যত্নে রেখেছিল। যথাসময়ে একটা কন্যা সন্তান হল তিথির।নাতনি পেয়ে ঠাকুমা খুব খুশি। তাকে নিয়ে বেশ ভালই দিন কাটছে মলিনা দেবীর।

Loading

One thought on “গল্প- টক ঝাল মিষ্টি সম্পর্ক

Leave A Comment