বেকারের জ্বালা
-শচীদুলাল পাল
মুর্শিদাবাদ জেলার কোদলা গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে রেল লাইন চলে গেছে। গ্রামের অন্যপ্রান্তে গঙ্গা। ১৮ কিমি দূরে শহর বহরমপুর।
২৭ বছর বয়সী চঞ্চল এম.এ. পাশ করে হন্যে হয়ে ঘুরে সরকারি, বেসরকারী কোনো চাকরি যোগাড় করতে পারেনি। বিশাল তার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেলো। চাকরি তো পেলই না। সাধারণ কোনো আয়ের সন্ধান পায়নি।
বাবা মা বেকার ছেলের প্রতি যে সহানুভূতি দেখাতো তাও কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। বৌদি দিনরাত বেকার, কর্মহীন বলে খোঁটা দেয়। দাদা তো বৌদির কথায় ওঠ বোস করে।দাদা প্রথম প্রথম হাত খরচের দু’ পাঁচ টাকা হাতে দিত। এখন বৌদির প্ররোচনায় তাও বন্ধ। ভাইঝি ভাইপোরা মায়ের শেখানো “অকর্মণ্য” বলে কথা শোনায়। সবার তীব্র শ্লেষাত্মক কথার আঘাতে কর্মহীন যুবক চঞ্চল জর্জরিত।
খেতে বসে একদিন চঞ্চল বললো- বৌদি একটু তরকারি বা ডাল দাও।
বৌদি ঝেঁকিয়ে উঠে বললো- আর নেই বিধবা মেয়ের মতো বসে বসে খাচ্ছো, লজ্জা করে না!
কাঁদো কাঁদো স্বরে দাদাকে জানালো সব কথা। দাদা মোটা বেতনের সরকারি চাকরি করে। অনেক দুনম্বরী ইনকাম।
দাদা সব শুনে বললো- ঠিকই তো। দু’টাকা রোজগার করবার মুরোদ নেই, ভাতের সাথে তরকারি জুটবে কোথা থেকে। আমি আর তোর খাওয়া খরচের ভার সামলাতে পারছি না। আমরা ভাবছি অন্যত্র কোথাও চলে যাব।
মা বাবাও আর আগের মতো নেই। বাবা বলেই দিল- লেখাপড়া শেখালাম, ভাবলাম কিছু একটা কাজ জুটিয়ে নিবি। বৃদ্ধ বয়সে মা বাবাকে দেখবি। সে আশায় জল ঢেলে দিলি।
-বাবা আমাকে কিছু টাকা দিও ব্যাবসা করবো।
-আবার টাকা! এস এস সি তে স্কুল টীচারের চাকরির জন্য ঘুস দিতে গিয়ে তোর জন্য অনেক টাকা ঢেলেছি। চাকরিও হলো না, টাকাটাও জলে গেলো। অপায়া কোথাকার। আমি আর টাকা বার করতে পারবো না।
প্রাইমারি স্কুল থেকে ভাব। ভাব থেকে বিশাখার সাথে ভালোবাসা। এখন কুড়ি বছরের বিশাখা অনেক সুন্দরী, আকর্ষণীয় রূপ, লাবন্যময়ী। সেও আর পাত্তা দেয় না।
একদিন পুকুর পাড়ে দেখা। জিজ্ঞেস করলো -আজকাল আর দেখা করো না কেন?
বিশাখা- আমাকে তুমি ভুলে যাও চঞ্চলদা।
-আমি কিন্তু তোমাকেই ভালোবাসি।তোমাকেই বিয়ে করব।
-বাড়ি থেকে আমার অন্যত্র বিয়ে ঠিক করেছে। ছেলে উঁচু বেতনের চাকরি করে। অনেক ধনী আভিজাত্যপূর্ণ পরিবার।
তুমি আমাকে আর ডাকবে না। যেখানে সেখানে কথা বলবে না। কথাটা বলেই বিশাখা ত্রস্ত পায়ে বাড়ি চলে গেলো।
একদিন সত্যি সত্যি বিশাখা বিয়ে করে চলে গেলো। চঞ্চলের দীর্ঘদিনের ভালবাসা, ঘর বাঁধার স্বপ্ন, সবকিছুকে ধূলিস্যাৎ করে অন্যের অঙ্কশায়ী হয়ে গেলো বিশাখা।
বিশাখার প্রত্যাখ্যান, বউদির অত্যাচার, পরিবারের সবার অবহেলায় জর্জরিত, নির্যাতিত বেকার চঞ্চল মনে মনে ঠিক করলো, এ জীবন সে রাখবে না।
বিনিদ্র রজনী শেষে চঞ্চল ঘর থেকে বের হয়ে রেল লাইনের ধারে এসে বেঞ্চে বসে রইলো। ট্রেনের আসার আশায় অনেকক্ষণ কেটে গেলো। রাত শেষে ভোর হচ্ছে। ভোরের আলো এসে পাখিদের চোখে লেগে ঘুম ভেঙে কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত। প্রভাত সূর্যের লাল আভা ঠিকরে পড়েছে ঝিলের জলে। জলচর পাখিরা জলকেলিতে মগ্ন।যতদূর দৃষ্টি চলে শুধু সবুজের সমারোহ। ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়া ধান ক্ষেতে দোলা দিয়ে যাচ্ছে। দূরে দুই বলদের মাঝে চাষা চাষে নিমগ্ন।
প্রকৃতির এই অপুর্ব শোভায় সে উদাস হলো। প্রকৃতি কত সুন্দর। মনের পরিবর্তন হলো।কানের সামনে এক দৈববাণী হলো। “আত্মহত্যা কাপুরুষতা।”
নাহ্ সে আত্মহত্যা করবে না। অনেকক্ষন পর একটা এক্সপ্রেস ট্রেন এসে থামলো। ট্রেনটা সিগনাল না পেয়ে এসে থেমে গেছে। ট্রেনের অনেক দরজা খোলা। চঞ্চল একটা কম্পার্টমেন্টে উঠে পড়লো।
ট্রেন ছুটে চলেছে পূর্ণ গতিতে। চঞ্চলের মন ছুটে চলেছে দূর্বার গতিতে অজানার উদ্দেশ্যে। ক্ষুধার জ্বালায় ও অবসন্ন শরীরে কখন যে সে ট্রেনের মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল নেই। সম্বিত ফিরে পেতে দেখলো টিকিট কালেক্টর সামনে দাড়িয়ে আছে। টিকিট চাইছে। তার কাছে তো টিকিট নেই অগত্যা জরিমানা। কিন্তু তার কাছে কানাকড়ি নেই। অর্থাৎ নির্ঘাত জেল। তাকে জেলে পুরে দিল। অভুক্ত চঞ্চলের ভালোই হলো। খাবার পাওয়া গেল। খুব খুশি। কিন্তু তাও সইলো না। তাকে দিন কয়েক রেখে জেল থেকে বের করে দিল।
জেল থেকে বের হয়ে কোথায় যাবে কি করবে কিছুই বুঝতে না পেরে স্টেশনেই ফিরে এলো।
উত্তর বঙ্গের বিভিন্ন স্টেশন ঘুরে বেড়ালো।
ক্ষিদের জ্বালায় দু’ দিন কেটে যাওয়ার পর কোনো উপায় না দেখে ভিক্ষে করতে শুরু করলো।
কিন্তু সুন্দর সুঠাম যুবককে ভিক্ষা কে দেবে? ভিক্ষাও জুটলো না। দু’দিন অনাহারে কাটলো। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।জীর্ণ পোশাক।
অনাহারে পেটের জ্বালা। অবসন্ন শরীর। কোথাও খাবার না পেয়ে পেটের জ্বালায় এক চায়ের দোকানে গেলো।
খাবার কেনার কোনো কানাকড়ি নেই।দেখলো একজন রুটি- সবজি খাচ্ছে। চঞ্চল এঁটো রুটি ছিনিয়ে নিয়ে দিল চৌঁচা দৌড়। পিছনে জনতা ছুটছে আর চীৎকার করছে
-চোর চোর চোর …
জনতার হাতে ধরা পড়ে বেদম মার খেয়ে অবসন্ন রক্তাক্ত চঞ্চল মাটিতে পড়ে বললো -আমি চোর নই। আমাকে মেরো না। কদিন থেকে কিছু খাইনি। মারমুখী জনতাকে হাতের রুটির টুকরো দেখিয়ে জ্ঞান হারালো।
জ্ঞান হতে চঞ্চল দেখলো সে এক তক্তাপোশে শুয়ে আছে। সামনে পরিচর্যারতা এক মধ্যবয়সী মহিলা। চঞ্চল উঠে বসতে গেলে মহিলা বাধা দিয়ে বললো, -মারের চোটে সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এখন কেমন লাগছে? তুমি জনতার হাতে মার খেয়ে পড়েছিলে। বাবু তোমাকে জনতার হাত থেকে বাঁচিয়ে এখানে আশ্রয় দিয়েছে। মাথায় হাত দিয়ে আদর করে শুশ্রূষা করতে লাগলো।
একটু সুস্থ হতে সে জানলো সে এক মাফিয়ার আশ্রয়ে। বিশাল বাড়ি। এখানে প্রবেশ করা যেমন কঠিন। বের হওয়া আরও অনেক কঠিন। এখানে সে প্রাণে বেঁচে আছে তাই নয়, সে বেশ আছে। এখানে থাকা খাওয়া দাওয়ার কোনো অভাব নেই। বস শিল্টুর নির্দেশ মেনে চলতে হয়। যখন যা বলবে তাই মেনে চলতে হয়। প্রভুভক্ত হতে হয়।
সপ্তাহ শেষে বস, নাম শিলটু একদিন চঞ্চলকে তার দরবারে ডেকে পাঠালো। জিজ্ঞেস করল -কি নাম তোর?
-চঞ্চল।
-থাকিস কোথায়?
-গাছতলায়।
-বাড়ি কোথায়?
-মূর্শিদাবাদের কোদলা।
-বাড়িতে কে কে আছে?
-মা বাবা, দাদা বউদি, ভাইপো ভাইঝি।
-বাড়ি ফিরে যেতে চাস?
-না।
-কেন?
-আমার কোনো আয় নেই। বেকার। তাই আমি সবার চোখের বিষ। সবার গলগ্রহ।
-মা?
-মা কেবল ভালোবাসে।
-এখানে থাকতে তোর কেমন লাগে?
-খুব ভালো।
-এখানে থাকতে গেলে আমি যা বলবো তাই তোকে শুনতে হবে।
-শুনবো।
-পিস্তল রাইফেল চালানো শিখতে হবে। বোমা মারতে হবে। পারবি?
-পারবো।
-যাকে বলবো তাকেই মার্ডার করতে হবে। পারবি?
-পারবো।
-তোলাবাজি করতে হবে?
-করবো।
-নির্মম, নির্দয় হতে হবে। পারবি?
-পারবো।
-বিশ্বাসঘাতকতা করলে গুলি খেয়ে মরতে হবে।
-মরবো।
বস শিলটু ডেকে পাঠালো গালুকে।
-গালু এই এক নতুন মাল। একে আজ থেকে তোর আন্ডারে পিস্তল, রাইফেল, একে ৪৭ চালানো, বোমা বাঁধা, বোমা মারা, সব রকমের গাড়ী, মোটর সাইকেল চালানো ইত্যাদি ট্রেনিং এর জন্য দিলাম। একে পাক্কা সাগরেদ তৈরি করবি। এর ক্ষিদে আছে।
কিছু দিনের মাধ্যে চঞ্চল পাক্কা গুন্ডা হয়ে মাফিয়ার চামচা হয়ে গেল। ১২ টি মার্ডার ও ৩৬ টি সফল অপারেশন করে শিলটু বসের সেনাপতি হয়ে গেলো। এখন সে বসের ডানহাত। পুলিশের খাতায় মোষ্ট ওয়ান্টেড। মাথার দাম দশ লাখ টাকা।
একদিন রাতে স্থানীয় এক মাফিয়া কাম ব্যাবসায়ীকে মার্ডার কেসে পুলিস শিলটুর বাড়ি রেড করলো। এনকাউন্টার। তুমুল লড়াই হলো। সেই লড়াইয়ে পুলিশের গুলিতে শিলটু বস একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে গেলো।
চঞ্চলের বাঁচার আর কোনো চান্স নেই। এবার পুলিশের দল তাকে খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে আসছে।
সে বিদ্যুৎ বেগে বুদ্ধি করে এক পুলিশের ঘাড়ে এক রদ্দা মেরে শুইয়ে দিল। টানতে টানতে পুলিসটাকে এক ঘরে ঢুকিয়ে তার ইউফর্ম খুলে নিজের সাথে বদল করে নিল। আর একটা মুখোশ পরে পুলিশের দলে ভীড়ে গেল।
বিশাল বাড়িটি পুলিশ দিয়ে ঘেরা। চঞ্চল পুলিশের বেশে অন্দরমহলে প্রবেশ করলো।বাইরে তখন গুলি বিনিময় চলছে। অন্দরমহলে এক বিলাসবহুল কামরায় দেখলো একটা মহিলা ঠকঠক করে ভয়ে কাঁপছে। মেয়েটি এগিয়ে এসে বললো, -আমাকে বাঁচান। আমাকে মারবেন না। আমি বসের বিবি।
চঞ্চল এগিয়ে গিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষন স্থির হয়ে গেলো। খুব চেনা চেনা লাগছে। জিজ্ঞেস করলো -কি নাম তোমার?
-আমার নাম বিশাখা। আমাকে এই নরক থেকে উদ্ধার করুন।
চঞ্চলের মনে আর দ্বিধা রইলো না। সে মুখোশ খুলে বললো, আমি চঞ্চল।
-আমি তোমার কন্ঠস্বরে আন্দাজ করেছিলাম। এখন আর কোনো সন্দেহ রইলো না। এখান থেকে বের হতে হবে। নাহলে আমার আরও দুটি সতীন বা পুলিশ আমাকে মেরে দেবে। নাহলে শিলটুর সঙ্গী সাথীরা আমাকে ছিঁড়ে খাবে। বা অসংখ্য লাশের ভীড়ে আমি হারিয়ে যাব। আমাকে বাঁচাও চঞ্চলদা।
বাইরে তখন ক্রশ ফায়ারের আওয়াজ। সাথে লুটতরাজ।
– তাইতো। কিভাবে বেরবো?
-শোন চঞ্চলদা। এই ঘর সংলগ্ন এক সুড়ঙ্গ পথ আছে। সেটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে এক গুপ্তকক্ষ আছে সেখানে অনেক মুখোশ, পুলিশের পোশাক অস্ত্র আছে। আছে ধন দৌলত আর সাউন্ডলেশ মোটর সাইকেল।
এখান থেকে বেরতে সফল হলে অনেক দূর দেশে গিয়ে তুমি আমি আবার নতুন করে ঘর বাঁধবো। কি পারবে?
-সবই ভাগ্য। ভাগ্যচক্রে তোমাকে হারিয়ে আবার এই দূরদেশে খুঁজে পেয়েছি। আই লাভ ইউ বিশাখা। ভালোবাসার কখনো মৃত্যু হয় না। চলো।
-গোপন সুড়ঙ্গ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে বিশাখার পরিকল্পনায় সফল হয়ে একেবারে মুক্ত বিহঙ্গের মতো দুজনে এক অজানার উদ্যেশ্যে পাড়ি দিল…
অনেক দূর দেশে গিয়ে চঞ্চল-বিশাখা ঘর বেঁধে বসবাস করতে লাগলো। তারা বেশ সুখেই ছিল।
একদিন মধ্যরাতে জেব্রা নামে এলাকার এক বেতাজ বাদশা একটা মেয়েকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে দেখে চঞ্চল বাধা দিল। গুলি বিনিময়ও হলো। জেব্রার পরিকল্পনা বানচাল করলো। তার এলাকায় অন্য কেউ মাস্তানী মারুক এটা তার সহ্য হয়নি।
একদিন মধ্যরাত্রিতে দল বল নিয়ে চঞ্চলের উপর চড়াও হলো। মারপিট ধ্বস্তাধস্তি শেষে জেব্রা গুলি চালালো। বিশাখা চঞ্চলকে রক্ষা করার জন্য বুক পেতে দিল। গুলি লাগলো বিশাখার বুকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো। চঞ্চল বিশাখাকে শুশ্রূষার জন্য এগিয়ে যেতেই জেব্রা তার সাঙ্গপাঙ্গরা অতর্কিতে চঞ্চলকে আঘাত করল চাকু ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে। দুটি হাত ও একটা পা রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত হলে চঞ্চল অত্যধিক রক্তক্ষরণের ফলে জ্ঞান হারালো।
জ্ঞান যখন ফিরলো, দেখলো সে হাসপাতালের বিছানায়। চঞ্চলের এক হাত ও এক পা নেই। amputed. কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে। বিশাখা তাকে ছেড়ে পরপারে চলে গেছে।
বেকার চঞ্চলকে এই সংসার ভালোভাবে বাঁচতে দিল না। আবার সে বিশ্ব নিখিলে এক বোঝায় পরিণত হলো।
ভিক্ষা ছাড়া আর কিছু সম্বল রইলো না।
পাড়ার মোড়ে সে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে বসে থাকে। কখনো ট্রেনে ভিক্ষে করে ফেরে।
কোনো দিন খাবার জোটে কোনো দিন জোটে না।
কেউ ভিক্ষা দিলে, সে সবাইকে এক কথা বলে- “ভাগ্যম ফলতি সর্বত্রম, ন বিদ্যা ন পৌরুষম।”
———— ———— ———-