গল্প- লোকে শুনলে বলবে কি

লোকে শুনলে বলবে কি
-শম্পা সাহা

 

 

“আমি কালই বাপের বাড়ি চলে যাবো! এই লোকের সঙ্গে থাকবো না, থাকবো না, থাকবো না! এই শুনছোওওওওওও…”

“ঘর ঘর ঘর ঘ‍্যাঁ ঘ‍্যাঁ ঘ‍্যাঁ..”

“বজ্জাৎ লোক, হতচ্ছাড়া নাক ডাকছে দেখো। নাক না মেশিনগান! ধুস্, সংসারে ক‍্যাতায় আগুন।”

বালিশ নিয়ে ঈষৎ পৃথুলা নিমকি রানী মানে নিভৃতবাসিনী গিয়ে শুলো ড্রয়িং রুমের সোফায়। তার আগে অবশ‍্য দুই চারক্ষেপ বালিশ চালিয়ে এসেছেন গন্ডার, হিপোপটেমাস, উষ্টুম ধুষ্টুম ঘন্টুর বাবার ভুঁড়ির উপর।

সে কুম্ভকর্ণ তো এখন গায়ের ওপর দিয়ে হাতি চলে গেলেও টের পাবে না, সেখানে বালিশ তো পালক!

বেচারা ঘন্টু, মা বাবার এই রোজকার লড়াই দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে সেঁধিয়েছে দোতলার খুপড়ি মত ঘরটায়। বেজায় গরম কিন্তু মাঝরাতের ধুন্ধুমার যুদ্ধ শুনে তো আর ঘুম চটকে যায় না!

এ প্রায় রোজকার ঘটনা। সেই লাস্ট কবে ঘন্টুর বাবা এট্টু সেন্টু হয়ে রোমান্টিক হয়েছিল! তারপর থেকে তো ব‍্যাঙের মাথা, নিজেই ফুলতে ফুলতে একটা মস্ত কোলা ব‍্যাঙ!

নিমকি রানীও যে খুব দুবলিপাতলি এমন নয়! তা মোটা বলে কি একটু ভাব ভালোবাসা থাকতে নেই? এই তো শ‍্যামার বর নিখিল, কৃষ্ণার বিয়ে হয়ে গেল, তাও কেমন পেছনে রোমান্টিক মিউজিক বাজিয়ে ভেজা ভেজা বক্ষ ভেদ করা চোখে চায়। এমনকি শ‍্যামার শাশুড়ি শ্বশুরেও কত ভাব ভালোবাসা! সে তুলনায় ঘন্টুর তো বিয়েই হয়নি। এতো তাড়াতাড়ি কি জীবন ফুরিয়ে গিয়ে করুণাধারায় আসতে হবে? নো নেভার! রস কস সিঙ্গারা বুলবুলি কিছুই এতো তাড়াতাড়ি ফুরোতে দিলে চলবে না। কালই একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে!

সোফায় শুয়ে নিমকি রানী উসখুস করতে থাকে। মরণ! ব‍্যাটাচ্ছেলে! কুঁড়ের হদ্দ! এট্টু ইয়ে করতেও যেন গা গতরে ব‍্যথা! হুঃ! ফুঁসতে থাকে নিমকি।
“নিমকি!”
গা জ্বলে যায়। ঘন্টুর বাবাই তো ভালোবেসে এই নামটা দিয়ে ছিল বিয়ের পর পর।বলেছিল, “নিভৃতবাসিনী, তুমি যেমন মুচমুচে তেমন সুস্বাদু, আর আমার সব থেকে প্রিয়।তাই তুমি আমার নিমকি রানী” মরণ! বয়স পঞ্চাশ হতে এখনো ঢের দেরি আর এর মধ‍্যেই নিমকি যেন জিভেগজা! ওনার নোনতা মুখে আর রোচেনা!

সাপ্তাহিক নারীবাদী পত্রিকা পড়ে পড়ে কত রকম প‍্যাঁয়তারা অ্যাপ্লাই করেছে সে, বগল কাটা নাইটি থেকে, হংকংয়ের তেল কিছুই বাদ যায়নি‌! কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি!মেশিন পত্রে যেন জং। ব‍্যাটা মেশিনগানের যেন গাদা বন্দুকে ট্রান্সফরমেশন। সব প‍্যাঁচ পয়জার ফেল।

বিছানায় পড়লে যেন নাকের ভেতর ঘূর্ণিঝড় ঢুকে পড়ে, আর সে ঝড়ে বেচারা নিভৃতবাসিনীর রোমান্টিক বিবাহিত মধ‍্য জীবনের তেইশ ঠান্ডা। কভি নেহি! কাল এসপার কি ওসপার! এই পড়ন্ত যৌবন কিছুতেই এভাবে বিফলে যেতে দেবে না, আরে বাবা, খাবার পর হাত না চাটলে কি ঠিকঠাক পেট ভরে না তৃপ্তি হয়?
“কালই কথা বলবো, হয় জাগো নয় ভাগো থুড়ি আমিই বাপের বাড়ি ভাগবো” এই পণ করে চোখ বোজে নিভৃতবাসিনী!

সকাল থেকেই বাড়ি থমথমে। ঘন্টু বুঝেছে আবার যশ-এর মেঘ জমেছে ঈশাণ কোণে।ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস টের পেয়ে সে কোনো রকমে সকালের খাবার খেয়েই মানে মানে ওদের তেলকলের দেখভালে কেটে পড়ে। কি জানি বাবা কখন ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ে?আর টার্গেট মিস করলে তার আর রক্ষা নেই!

“নিমু, নিমু” কোমরের কষি আলগা করে বেঁধে, লুঙ্গি হাঁটুর ওপর তুলে সোফায় বসে ঘন্টুর বাবা অরণ‍্যেরোদন খাসনবিশ মিহি গলায় ডাক ছাড়ে,”নিমকি রানী আমার চা টা দাও!”

যদিও বিছানায় পড়ারর পরের কোনো ঘটনাই অরণ্যেরোদনের অবগত নয়, তবু রান্নাঘরের ধুপুর ধাপুর শুনে বোঝে,”কুছ গড়বড় তো হ‍্যায় দয়া! “কিন্তু কি? সেটাই আবিষ্কার করতে এই মধু মাখা হরিনাম মানে গিন্নীর নাম!

ধুপ করে টেবিলের ওপর প্লেট এসে পড়ে, আর রাখার তোড়ে কাপ চলকে চা, প্লেট আর প্লেটে রাখা নোনতা বিস্কুটদুটো ভেজায়।ছেলে নেই তাই সুরেলা গলায় অরণ্যেরোদন ব‍্যাপারটা বুঝতে চায়,”কি হলো নিমু ,রেগে আছো যেন? কি হয়েছে?”এই সুযোগটাই তো খুঁজছিল নিমকি। সঙ্গে সঙ্গে সামনের সোফায় ধমাস করে বসে, জানে কি হবে আর কত সময় লাগবে, তাই আগে থেকেই রান্নাঘরে গ‍্যাস বন্ধ করে এসেছে।

“বলছি তোমার মেশিনগান কি একেবারেই জং পড়ে গেছে?”
“মেশিনগান?”
এ শব্দব্রহ্মে বেশ ভেবড়ে অরণ্যেরোদন চমকে ওঠেন,
“মানে, সে কি?”
চোখ নাচায় নিমকি, “জানো তোমার নামে ডাইভোর্স কেস করলে এক্ষুণি ডাইভোর্স পেয়ে যাবো!” চায়ের কাপে হাত বাড়াতে গিয়েও হাত পেছিয়ে আসে,”কিন্তু তুমি খামোখা আমায় ডাইভোর্সই বা দেবে কেন?আমি আবার কি করলাম?”
পুরো বোল্ড আউট অরণ্যে রোদন।
“কিছু করো না, তুমি কিচ্ছু করোনা। আর সেই জন‍্যেই আমার ডাইভোর্স চাই!”
“কেন, আমার অতবড় তেলকল”,
“ধুত্তোর তেলকল!” মাঝপথেই থামায় নিভৃতবাসিনী,
“যদি নিজের মেশিনপত্তরেই না তেল দিতে পারো ও তেল কলের কি দরকার? একটু শখ আল্লাদ নেই, ভাব ভালোবাসা নেই, রোমান্টিক হবার নাম নেই, রাত্তিরে বিছানায় পড়ে যেন তেলকল চালাচ্ছে,ঘরঘর ফরফর!”
কথার মাঝখানে নিজের অধুরা যৌবনের দুঃখে ফ‍্যাঁচ করে কেঁদে ওঠে নিভৃতবাসিনী!

“আহাহা, এতে কাঁদছো কেন? আসলে বোঝোই তো, সারাদিনের খাটাখাটনি, আর বয়সও তো হয়েছে!”,
“তা কে বলেছিল, হাঁটুর বয়সী মেয়ে বিয়ে করতে। তোমার জন‍্য আমার জীবনটাই বরবাদ হয়ে গেল। দিদির দেওর ঘনশ‍্যামকে বিয়ে করলেই ভালো হতো!”
এই বলে অজানা ঘনশ‍্যামের হয়েও হলোনা অনতীত, চিরস্থির অনাস্বাদিত অপ্রাপ্ত প্রেম কল্পনা করে কেঁদে ভাসায় নিভৃতবাসিনী!

অরণ‍্যে রোদন অনেক বুঝিয়েবাঝিয়ে, বেশ কথাটথা দিয়ে কাজে বের হলো। আজ সন্ধ‍্যা থেকেই বেশ খুশি খুশি ভাব। আজ আর নিভৃতবাসিনী নামটা মনে আনতেও ইচ্ছে করছে না, আজ নিমকি রানী পুরো মুচমুচে খাস্তা মেজাজে।

ঘন্টু ভয়ে ভয়ে ফোন করে জানালো আজ বন্ধুর বাড়ি ফিস্টি। অন‍্যদিন হলে নিভৃতবাসিনী নানান তদন্ত করেন, “কে, কার বাড়ি, কোথায়, কখন ফিরবি?” আজ সেসব কিছুই না করাতে ঘন্টুও অবাক,
“যাচ্ছলে! এই সকালে মেঘ, আর এই রোদ্দুর। বাব্বা! মেয়েদের মেজাজ, কে বুঝতে পারবে? শিবের বাবাই ফেল তো ঘন্টু!”
ঘন্টু আরো একবার প্রতিজ্ঞা করে এ জীবনে সে কোনোদিন বেলতলা থুড়ি ছাদনাতলায় যাবে না। সারাদিন বাড়িতে বাবা যা হ‍্যাটা হয়! তার বৌ-ও দেখে দেখে ঠিক এসব শিখবে।

তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া শেষ। নিমকি রানীর বুক বহুদিন পর ফুলশয্যার রাতের মত দুরুদুরু। ওদিকে অরণ‍্যে রোদন বেশ একটা হলুদ গেঞ্জি আর লালকালো ছাপছাপ লুঙ্গিতে রেডি! ভুঁড়িটা বেঢপ। যাক! ওদিকে তাকাবে না নিমকি।

বেশ এগিয়ে গিয়ে পাশে বসে অরণ্যে রোদনের। অরণ‍্যে রোদন ভাব বুঝে দুই হাত বাড়িয়ে মুখটা এগিয়ে নিয়ে যায় নিমকি রানীর কাছে, আহা কি অপূর্ব মুহূর্ত! এই ঠোঁটে ঠোঁট মিলতে যাবে, নিমকি রানীর বুকে হাঁপড় পড়ছে, মুখে বেশ লাজুক লাজুক ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছে যথাসাধ্য, কতদিন পর বলে কথা! এই এই সবে ঠোঁটে ঠোঁট লেগেছে,

“হ‍্যাঁচ্ছো..”প্রবল এক হাঁচিতে নাকের থেকে বেশ কিছুটা তরল কণা উড়ে গিয়ে পড়লো নিমকির চোখেমুখে‌। ছিটকে অনেক দূরে সরে গিয়ে দেখে, অরণ‍্যে রোদন নাক লুঙ্গি দিয়ে চেপে হেঁচেই যাচ্ছে, হেঁচেই যাচ্ছে, হেঁচেই যাচ্ছে!

অত‍্যন্ত রাগে, বিরক্তিতে নিমকি জিজ্ঞাসা করে “হঠাৎ হাঁচছো যে? ইচ্ছে করে,বলো?”
এক ক্রূর জিঘাংসা ফুটে ওঠে নিভৃতবাসিনীর চোখেমুখে।
“এ ঠকানো, এ প্রতিশোধ, মানসিক অত্যাচার, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ!”
আই পি সির কড়া কড়া ধারা যেই হানতে যাবে, ভাঙা গলায় অরণ‍্যে রোদনের স্বীকারোক্তি,
“বল্টা, আমাদের দোকানের, ওর জ্বর, কাশি, আর হাঁচিও ছিল। এতোবার করে বাড়ি যেতে বললাম, কিছুতেই গেলো না! সেই দুপুর থেকে আমারও শুরু হয়েছে!হ‍্যাঁচ্ছো,হ‍্যাঁচ্ছো…”,আবার শুরু হাঁচির মনোরেল!

এখন ঘন্টু যথারীতি ওপরের ঘরে, আর অরণ‍্যেরোদন নিভৃতবাসে! সে ব‍্যবস্থা অবশ্য নিভৃতবাসিনী স্বেচ্ছায়ই করেছে।

“পুরুষ মানুষগুলো কি রকম দেখেছো, বৌ কুড়ি কি বুড়ি! কিছুতেই মুখে রোচে না! তার জন‍্য করোনা পর্যন্ত হওয়াতে পারে! পামর, নরাধম, ইতর, ইল্লত”, ইত্যাদি গালাগাল অরণ‍্যে রোদনকে দিতেই থাকে মনে মনে নিভৃতবাসিনী! কি আর করবে? এ অবস্থায় তো আর জোরে জোরে স্বামীকে গাল দেওয়া যায় না! লোকে শুনলে বলবে কি?

Loading

Leave A Comment