গল্প- জীবন

জীবন
-অঞ্জনা গোড়িয়া

 

 

না না না..কিছুতেই না। এই টুকু মেয়ে। তার এত স্পর্ধা হয় কী করে? মুখে মুখে চোপা। কী দিন কাল এল শুনি? গুরুজনদের একটু মেনে চলবে না?
ঠাকুমা গালে পান চিবাতে চিবাতে বকেই চলেছে। এর একটা বিহিত না করলে এ মেয়ে যে কাউকে মানবে না।
কথাগুলো বলে মুখ থেকে পানের পিচ ফেললো উঠানের কোণে।
তা দেখে মনি আরও রেগে খাপ্পা।
মেনে চলবো নাকি? কোথায় পিচ ফেললে দেখেছো? এই তোমাদের জ্ঞান। উঠান ভর্তি করছো? আমার গায়েও ঠিকরে এলো। কেন একটা পিচ ফেলার পাত্র রাখতে পারো না? যেখানে সেখানে ফেলছো? যেখানে সেখানে থুতু, সর্দি, কফ, এসব ফেলতে নেই জানো না? আমি কিছু বললেই বলবে চোপা করছিস।
ঠাকুমা রেগে বলে উঠলো, যত বড় মুখ নয়, তত বড় কথা। আমাকে কথা শোনাচ্ছিস। যা খুশি বল, কিন্তু তোর আজ যাওয়া চলবে না। ঘর থেকে বের হবি না বুঝলি। এই টুকু মেয়ে নাকি! আমি ভাবতেই পারছি না। এখনো বিয়ে হলো না। ছেলেপুলের মুখ দেখলো না সে দেবে কিনা রক্ত? কত দিন খেয়েদেয়ে ওই রক্তটা তৈরি করতে হয়েছে জানিস? মা গো মা একবার হাত কেটে গিয়ে সে কি রক্ত?তোর কী কান্না! আর সেই তুই কিনা এক বোতল রক্ত দিবি। একটুও কষ্ট হবে না?
মেয়েমানুষদের এসব দেওয়া চলবে না। এমনিতেই প্রতি মাসে কত রক্তক্ষয় হচ্ছে। মনে নেই বুঝি?
এতক্ষণ পর বুঝলো মনি। ঠাকুমা কেন এত রেগে যাচ্ছে?
রবিবার আজ ক্লাবে রক্তদান শিবির। চারিদিকে রক্তের হাহাকার। তাই মনি নিজে উদ্যোগ নিয়ে ক্লাবের ছেলেদের দিয়ে শিবিরের আয়োজন করেছে। ভেবেছে মনি প্রথম রক্ত দেবে। তাই দারুণ উৎসাহিত। মনে মনে ভেবেও রেখেছে ভালো করে একটা ফোটো তুলবে। রক্তদান করার সময়। কী আনন্দ মনে। কিন্তু বাড়ির কেউ রাজি নয়।

বাড়ি সুদ্ধ লোক চিৎকার চেঁচামেচি। মা শুধু বলে, সাহস করে দে মা। অনেকের কত উপকার হবে। কিন্তু ঠাকুমা বাবা বলে ওঠে, মেয়েমানুষ দেবে রক্ত? এখনো বিয়ে হয় নি। কোথায় কী রোগ এসে যাবে। কিছুতেই দেওয়া চলবে না।
মনিও রাগে দু’চার কথা শুনিয়ে দিল।
মনি কারোর কথা শুনলো না। জোর করে দিয়ে এল রক্ত। উপযুক্ত ফলমূল খেয়ে এখন বেশ সুস্থ।
সে দিনের পর থেকে কেউ কথা বলে না মনির সাথে। ঠাকুমা ছিল মনির প্রাণ। এখন মনিকে দেখলেই মুখ ঘুরিয়ে নেয়। বাবা উঠতে বসতে নিজের মেয়েকে যা খুশি বলে। পাড়ার ক্লাবের ছেলেদেরও গালাগাল দেয়।
মনি আগেই বলে রেখেছিল, কেউ যেন বাবা ঠাকুমার কথায় রাগ না করে।

হঠাৎ এক ঝড় জলের রাত। ঠাকুমার স্ট্রোক। বাথরুমে পড়ে জ্ঞানশূন্য।
মনিই ক্লাবের দাদাদের ডেকে গাড়ির ব্যবস্থা করলো। ছুটে চললো গাড়ি হসপিটালের দিকে। রাত তখন ১-৩০, রাস্তাঘাট শুনসান। ভর্তি করা হলো ঠাকুমাকে। ডাক্তার দেখেই বললো, এখুনি রক্ত লাগবে। ব্যবস্থা করুন।
ব্লাড ব্যাঙ্কে যেতেই বললো, আগে রক্ত দিন তবেই রক্ত পাবেন। মনি কার্ডটা বের করে ধরিয়ে দিল হাতে। আর কিছু বলতেই পারলো না। ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে পেয়ে গেল নির্দিষ্ট গ্রুপের রক্ত।
ঠাকুমাকে সপ্তাহ খানেক পর বাড়ি আনা হলো।
এখন ঠাকুমার ঠিক আগের মতো খুশি খুশি মন। মনিকে কাছে ডেকে একগাল ফোকলা দাঁতে হেসে বললো, এই দেখ পানের পিচ রাখার পাত্র। আরও কিছু দিন বাঁচতে চাই তোর বিয়েটা দেখে যেতে হবে তো। ভাগ্যিস সেদিন আমার কথা শুনিস নি। তোর রক্তেই আমি জীবন ফিরে পেলাম। এরপরের বছর যখন রক্তদান শিবির হবে আমাকে বলিস। আমি রক্ত দেব। কী বলিস?
সবাই খিলখিল করে হেসে উঠলো।

Loading

One thought on “গল্প- জীবন

Leave A Comment