গল্প- কাঁধ

কাঁধ
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

 

 

কি গো অনেক আশা করে তোমার কাছে কথাটা পারলাম কিন্তু। আশাকরি নিরাশ করবে না। কি গো কিছু তো বলো? আর কতক্ষণ এই নীরবতা?

অভিজিৎ বাবু তার স্ত্রী অনুরিমার মুখ থেকে ‘হ্যাঁ’ এই শব্দটুকু শোনার জন্য তীর্থের কাকের মতো তার মুখের পানে চেয়ে বসে রইলো।

অনুরিমা কোন উত্তর না দিয়ে চুপচুপ রুটি সেঁকতে লাগলো। ছয়টা রুটি করে একটা সাদা কাপড়ে মুড়ে একটা স্টিলের থালায় রেখে তার ওপর আরেকটা থালা ঢাকা দিয়ে রাখল। কতবার ভেবেছে রুটি গরম রাখার জন্য একটা হটপট কিনবে। ঠিক যেমন তার বড়-জার ঘরে। কি সুন্দর দেখতে ছিল! লাল রঙের বডিটা আর তার ওপর সাদা ঢাকনা।আহা দেখলেই মন ভরে যায়।

তবে আজকাল আর অতিরিক্ত কোনো জিনিসই কিনতে ইচ্ছে করে না অনুরিমার। ওই সব ইচ্ছে হতো আজ থেকে অনেক বছর আগে। বড় জায়ের ঘরের সুন্দর সুন্দর জিনিসপত্র দেখে মন ভরানো ছাড়া তখন তার আর অন্য কোন উপায় ছিল না। বড় জায়েদের দু’ দুটো ইঞ্জিন সংসার নামক শকটখানিকে টেনে নিয়ে যায় সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য ও বৈভবের সাথে।

হ্যাঁ, অনুরিমার বড় জা তমালী সরকারি হসপিটালের নার্স এবং বড় ভাসুর প্রলয় পোস্ট মাস্টার। আজ থেকে সাতাশ বছর আগে অনুরিমা যখন অভিজিৎ-এর বৌ হয়ে আসে তখন কিন্তু প্রথমে ভাসুরের ঘরেই ওঠে।

আসলে অভিজিৎ-এর পৈত্রিক বাড়িখানা ছিল খুব ছোট। দুটো মাত্র ঘর। তাও আবার টালির ছাদ দেওয়া। তাই তার দাদা পৈত্রিক ভিটেতেই স্বতন্ত্র দুতলা বাড়ি বানিয়ে থাকে।

অভিজিৎ-এর বাবার দূর্গাপুর স্টেশন চত্বরে একটা ছোট গুমটি ছিল। দুই ছেলে, দুই মেয়ে, স্বামী- স্ত্রী এই ছয়টা পেট প্রতিপালন করতেই ওনার আয়ের অধিকাংশ ব্যয় হয়ে যেত।

তবে অভিজিৎ-এর বাবা ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে খুব যত্নশীল ছিলেন। ভদ্রলোক অভাব অনটন এইগুলোর সঙ্গে লড়াই করে ও চার ছেলেমেয়েকে কলেজের গন্ডী পার করিয়েছিলেন।

তার বড় ছেলে ও বড় বৌমা উভয়েই চাকুরিজীবি। তার দুই মেয়ে ও জামাইরা সু- রোজগেরে। শুধু একটু কমজোর হয়ে পড়েছে তার ছোট ছেলে অভিজিৎ। বেসিক ট্রেনিং থাকা সত্ত্বেও প্রাইমারি স্কুলের চাকরি খানা তার কপালে জোটে নি। তাই সে আজও টিউশনির টিচার।

অভিজিৎ-এর বিয়ের পর তার বড় বৌদি তাদেরকে নিজেদের বাড়ির একতলার একটা রুম ছেড়ে দিয়েছিল। অনুরিমার বিয়ের পর মাস ছয়েক বেশ তার স্বপ্নের মতো কেটেছিল। বড়জা তমালীর শিফটিং ডিউটি। তাই অনুরিমাই বেশিরভাগ সময়টা রান্না ঘরের দিকটা সামলানোর চেষ্টা করতো।বড় জা নাইট ডিউটি করে এলে অনুরিমা যথেষ্ট ভালোবেসে তার মুখের সামনে তুলে ধরতো তার অপটু হস্তের বিভিন্ন দেশের মানচিত্রের ন্যায় গড়া রুটি ও ফোড়ন আলুর তরকারি।

তমালী যদিও রুটির আকার নিয়ে অনুরিমাকে ব্যঙ্গ করলেও পরক্ষণে মুখটি বুজে খেয়ে নিত। নাইট ডিউটি করে বাড়ি ফিরে তো আর কষ্ট করে নিজেকে খাবার বানাতে হলো না। এটাই কি কম?

বড় জায়ের একমাত্র মেয়ে নিশা তখন ছিল বছর ছয়েকের। সব সময়ের জন্য কাকিমুনিকে পেয়ে সে খুব খুশি।

তবে অনুরিমা ফাঁক পেলেই তার শ্বশুরের পুরানো বাড়িতে চলে আসতো। শাশুড়ির হাতে হাতে কাজ করে দেওয়ার চেষ্টা করতো। একদিন অনুরিমার শাশুড়ি তাকে বলে, বড়লোক ভাসুরের ঘর ছেড়ে গরীব শ্বশুর শাশুড়ির কাছে এসে থাকতে কি তোমার খুব অসুবিধা হবে?
অনুরিমা যেন আকাশ থেকে পড়েছিল সেদিন। সে মনে মনে কিছুটা লজ্জিত হয়ে বলে, মা যতদূর আমি জানি আপনার ইচ্ছাতেই আমি বড়দার ঘরে থাকি। সেই রকম কথাই আমাকে বলেছিল আপনার ছেলে।

অনুরিমার শাশুড়ি অভিজিৎ-এর উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, ওটা তো একটা আহাম্মক। চিরকালই জোড়াতালি দিয়ে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কোনোদিন স্পষ্ট কথা বলার সৎ সাহস ওর হলো না।

-আমি ঠিক বুঝলাম না মা। প্লিজ একটু খুলে বলবেন।
-তোমাকে বিয়ে করে বাবার এই ভাঙাচোরা ঘরে কিভাবে তুলবে সেই চিন্তায় অভি অস্থির ছিল। তখন আমার বড় মেয়েই প্রলয়কে বলে তোমাদের ওখানে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়।
-ওওও তাই বলুন। মা আমি কিন্তু অতি সাধারণ ঘরের মেয়ে। আমার কোনো অসুবিধা হতো না এই ছোট্ট ঘরে থাকতে।

অনুরিমার শাশুড়ি স্নেহাতুর কন্ঠে বলে, ছোটো বৌমা যেদিন মন চাইবে তোমার এসে থেকো। আমি অপেক্ষায় থাকবো।

তবে অনুরিমার শাশুড়িকে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয় নি। তমালীর স্বভাবই হচ্ছে অনুরিমাকে কথায় কথায় ছোটো দেখানো। তবে সেদিনের ঘটনার পর অনুরিমা আর তার বড়লোক ভাসুরের বাড়িতে থাকতে চায় নি।

ঘটনাটা ছিল, অনুরিমার দিদি, জামাইবাবু এসেছিল তার সঙ্গে দেখা করতে। অনুরিমাও যথারীতি চা, বিস্কুট দিয়ে তাদের আপ্যায়ন করে।

তারা চলে যাওয়ার পর তমালী বলে, অনু এবার থেকে আলাদা বিস্কুটের প্যাকেট, চিনি, চা পাতা, গুঁড়ো দুধ কিনে তোর রুমে আলাদা করে রেখে দিস। আমাদের তো এখন পাঁচ জনের হিসাবে মাসকাবারি বাজার আসে। অতিরিক্ত লোক হলে তখন আবার মাসের রেশন নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে।

অনুরিমা বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারে তার বড় জায়ের কথার মর্মার্থ।

সেদিন রাতে অভিজিৎ টিউশনি পড়িয়ে বাড়ি ফিরে এলে, অনুরিমা সন্ধ্যা বেলার সমস্ত কথা তাকে খুলে বলেছিল এবং অনুরিমা জানিয়েছিল, আগামীকালই সে বড় জায়ের বাড়ি পরিত্যাগ করে শ্বশুর শাশুড়ির কাছে চলে যাবে। মাসের পর মাস বড়লোক ভাসুরের বাড়িতে গলগ্ৰহ থাকা উচিত হবে না। সংসার যখন পেতেছি তখন তার ব্যয় ভার আমাদেরকেই ওঠাতে হবে।

যদিও অনুরিমার এই সিদ্ধান্তকে তমালী পূর্ণ মাত্রায় সমর্থন করে বলেছিল, চিরকাল কি অন্যের ঘাড়ে বসে খাওয়া উচিত?

অনুরিমাকে কাছে পেয়ে অভিজিৎ-এর বাবা মা খুব খুশি হয়েছিল। অনুরিমা সংসারের কাজ সামলেও তার পুরানো টিউশনিগুলো আবার শুরু করে। বড় জায়ের সংসারের মতো বৈভব না থাকলেও স্বাধীন ভাবে শ্বাস নেওয়ার আনন্দ এখানে পেয়েছিল।

ননদরাও যথেষ্ট সাহায্য করে অনুরিমা, অভিজিৎ-কে। ছুটির দিনগুলোতেই তারা সবাই মিলে একসাথে খাওয়া দাওয়া করে রাতে যে যার বাড়ি ফিরে যেতো।

শুধু ননদরা নয় ছুটির দিনগুলোতে বড়জা, বড় ভাসুর, তাদের মেয়ে সকলকেই নেমন্ত্রন্ন করতো অনুরিমা। অনুরিমার দৃষ্টি ভঙ্গিতে কোন দ্বিচারিতা ছিল না কোনোদিনই।

এইভাবে বছর দুয়েক অক্লান্ত পরিশ্রম করে সংসারের শ্রী ফেরাতে উদ্যত হয়েছিল অভিজিৎ ও অনুরিমা। দু’ কামরা ঘরে খুব অসুবিধা হতো। তাই লোন নিয়ে আরো দু’টো ঘর বানায় ছাদ ঢালাই করে। এখন ননদরা বাপের বাড়িতে এলে নিশ্চিন্তে রাত কাটায়।

বছর তিনেকের পর অনুরিমা মা হয়েছিল। তাদের কোল আলো করে জন্মায় এক পুত্রসন্তান। অনুরিমা তার ছেলের নাম রাখে অরিত্র। অনুরিমার ছেলে হওয়ার পর থেকেই তার বড়জার ব্যবহারের আমূল পরিবর্তন ঘটে। তমালী সবসময় ভাবতে থাকে এবার বোধহয় তার মেয়ের আদর সব কমে গেল।তমালীর মনের গভীরে কোথাও যেন হিংসার ক্ষেত গড়ে উঠেছিল।

মাঝে মধ্যেই তমালী অনুরিমাকে হাবেভাবে বোঝাতে চাইতো, একজন সাধারণ গৃহবধূর থেকে একজন ওয়ার্কিং ওম্যানকে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়। একজন চাকুরিরতা মহিলার কাছে সময় প্রচন্ড মূল্যবান। আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী নিয়ে সব সময় হৈ হৈ করার সময় থাকে না।
বাড়িতে টিউশনি পড়ালেও ছাত্র ছাত্রীদের কাজ দিয়ে নিজের কাজও কিছুটা সেরে নেওয়া যায়। এইসব নানা মনগড়া যুক্তি অনুরিমার বড়জায়ের ঠোঁটে লেগেই থাকতো।

তবে অনুরিমার সহনশীলতা অনেক বেশি। সে কখনো প্রত্যুত্তর করার কথা ভাবতো না। কিন্তু সবার অলক্ষ্যে তার চোখের জল সে মুছে নিত সংগোপনে।
সত্যিই তো তার বড় জা, ভাসুর আর্থিক দিক থেকে তাদের থেকে অনেক বেশি স্বাবলম্বী।এই সত্যটুকু মেনে নেওয়ার মধ্যে তো কোন লজ্জা থাকা উচিত নয়। কিন্তু তা বলে বড় জায়ের অনুরিমাকে সর্বদা দুখী ভাবার কারণ নেই। মোটা ভাত, মোটা কাপড়ের অভাবও তার নেই।
কিছু মানুষ অল্পে তুষ্ট হতে জানে। আর অনুরিমা সেই দলেই পড়ে।

একে একে শ্বশুর, শাশুড়ি পরলোকগমন করেছেন। অনুরিমাই ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে অভিজিৎ-দের বাড়ির এক মজবুত স্তম্ভ। অভিজিৎ-এর বোনেরা আজও বাপের বাড়ি বলতে বড় ভাইয়ের ঘরখানি না ছোট ভাইয়ের ঘরখানিই বোঝে। অনুরিমা জানে তার শ্বশুরের ভিটেখানি তার ননদদের কাছে কত প্রিয়। মেয়েদের শৈশব থেকে মেয়েবেলার কত স্মৃতি জড়িয়ে থাকে বাপের বাড়ির প্রতিটা কোণে।

তবে অভিজিৎ-দের উঠানটা আজ দ্বি-বিভক্ত। এতকাল বাড়ি আলাদা হলেও উঠানখানি ছিল এক। এক উঠানের দুই প্রান্তে দুটো বাড়ি মনে হতো একটি পৃথিবীর দুটি প্রান্ত। কিন্তু যখন থেকে উঠানের বুক চিড়ে লম্বা, উঁচু একটা পাঁচিল উঠে গেল তখন থেকেই অনুরিমার মনে হতো সে ও তার বড় জা দুটো অনেক আলাদা জগতের মানুষ।

তবে এই পাঁচিল কিন্তু সহজে ওঠে নি। এর পিছনেও আছে একটা অধ্যায়। অভিজিৎ -এর ছেলে অরিত্র যখন থেকেই হামা টানতে শিখেছিল তখন থেকেই সে হামা দিয়েই যখন তখন বড় জেঠিমার বাড়িতে হানা দিত নিশা দিদির সান্নিধ্য লাভের আশায়।নিশাও সারাদিন ভাই ভাই করে বেড়াতো। ‌অরিত্রকে ঠিক করে কোলে নিতে পারতো না তবুও কোনরকমে কাঁখে তুলে টলমল পায়ে গোটা উঠানময় ছুটে বেড়াত।

তমালীর অরিত্রের প্রতি নিশার এই অতিরিক্ত টানখানা মোটেই ভালো লাগতো না। নানা অছিলায় নিশাকে অরিত্রের থেকে দূরে রাখাতে চাইতো। তবুও ছোট্ট নিশাকে আটকে রাখতে পারতো না। তমালী হসপিটালে গেলেই নিশা হাজির হয়ে যেত তার কাকীমনি ও ভাইয়ের কাছে।
যখন পড়াশোনার অজুহাত, বকাবকি করেও নিশাকে আটকে রাখা যাচ্ছিল না তখন তমালী এই পাঁচিল তোলার স্বিদ্ধান্তটা নেয়। যদিও তারা স্বামী স্ত্রী সকলকে জানিয়েছিল, আমরা তো দু’জনেই কাজে বেরিয়ে যাই। মেয়ে বড় হচ্ছে। তাই ওর নিরাপত্তার কথা ভেবেই এই পাঁচিল তোলার ব্যবস্থা। তবে পাঁচিলের মাঝে অবশ্যই একটা ছোট গেট রাখা হয়। দুই বাড়ির মধ্যে যাতায়াতের জন্য।

তবে এই যাতায়াতের সুবিধার জন্য লোহার গেট খানি বছর খানেকের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছিল অনুরিমার বড় জা ও ভাসুরের কাছে। তারা লোহার গেটটাতে একটা বড় তালা ঝুলিয়ে দিল।রোদে,জলে স্নাত হয়ে গেটটাতে মরচে পড়ে গেছে। লোহার গেটটার গা বেয়ে কত নাম না জানা আগাছাও জন্মে গেছে। তবে লোহার গেটটার দিকে তাকালে মনে হয় সে যেন অনেক কিছুর বোবা সাক্ষী।
পাঁচিল তোলার সময় অভিজিৎ একটু আধটু আপত্তি করলেও পরে ভাবে ভাই ভায়াদের বিবাদ তো অনিবার্য। আজ আপত্তি করলে কাল যদি আমার নিজেরই পাঁচিল তোলার দরকার পড়ে। এত বড়ো উঠানে পাঁচিল দেওয়ার খরচাও অনেক। আর সেই সঙ্গতিও তার নেই। আসলে চিরকালই দূর্বলরা সবলদের অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে আসছে। অভিজিৎ-দের দুই ভাইয়ের মধ্যেও তাই হয়েছিল।

এখন অনুরিমার চুলে পাক ধরেছে, চোখে চশমা সঙ্গে হাঁটু ব্যথা। বয়স শরীরকে ঠিক জানান দিয়ে যায়। অভিজিৎও এখন বাড়িতে বাড়িতে পড়াতে যায় না। বাড়ির একটা রুমেই খুলেছে কোচিং সেন্টার। অরিত্র এখন স্থল বাহিনীর একজন সৈনিক। সারা দেশময় ঘুরে বেড়াতে হয় তাকে।

এখন একখানা ঘরেই কাজ চলে যায় অনুরিমার। আরো দুখানা ঘর অতিরিক্ত লাগে তাদের।পূবের দিকের আম গাছটাতে বেশ আম ধরেছে। তারই একটা পাকা আম কেটে একটা থালায় রাখে। তার পাশে চারটে রুটি ও আলুভাজা দিয়ে অভিজিৎকে জলখাবার পরিবেশন করে অনুরিমা। তারপর নিজেও দুটো রুটি আর আলুভাজা নিয়ে প্ল্যাসটিকের ডাইনিং টেবিলে খেতে বসে।

অভিজিৎ আবার জিজ্ঞেস করে, কি গো কখন তোমার কাছে আমি কথাখানা পারলাম। এখনও কিন্তু উত্তর দিলে না।

অত্যন্ত বেদনা মিশ্রিত গলায় অভিজিৎ বললো, তুমি তো জানো বড়দা চলে যাওয়ার পর বড় বৌদি কত একা হয়ে গেছে। আগে তবু হসপিটালের চাকরিটা ছিল তখন সময় কেটে যেত। কিন্তু অবসরের পর সময় কাটানো দুরহ হয়ে গেছে।

নিশাও অস্ট্রেলিয়াতে এখন। কবে দেশে ফিরবে তার কোন ঠিক নেই। বড় বৌদির শরীর আজকাল মোটেই ভালো থাকে না। রান্না মাসি আর ঠিকে মেয়েটা কাজ করে চলে যাওয়ার পর এত বড় বাড়িটা খাঁ খাঁ করে। জানো তো বড় বৌদি তাই বলছিল, আবার আমরা যদি একসাথে থাকি।

এতক্ষণ বাদে অনুরিমা মুখ খুললো। সে মুখে একটু হাসি এনে বলে, আমার তো একসাথে থাকতে কোনদিনই অসুবিধা ছিল না। তবে বড়দি যদি এখন একসাথে থাকতে চায় তাহলে আমিও রাজি।

অভিজিৎ এক গ্লাস জল এক নিমেষে খেয়ে একটা স্বস্তির ঢেঁকুর তুলে বলে, আঃ বাঁচালে আমায় তুমি। বড় বৌদির করুণ মুখটা দেখে বড্ড মায়া হচ্ছিল গো। তাহলে বলো কবে তুমি বড়দার বাড়িতে আবার যেতে চাও?

অনুরিমা যেন আকাশ থেকে পড়লো। সে চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি এনে ভ্রু কুঁচকে বলে, বড়দার বাড়িতে মানে?

অভিজিৎ একটু আমতা আমতা করে বলে, হ্যাঁ এটাইতো বড় বৌদি চাইছে যে আমরা সবাই মিলে বড় বৌদির অট্টালিকায় থাকি।বড় বৌদি বলছিল, বুঝলে ভাই লোকজন না থাকলে কি আর ঘর বাড়ি মানায়।

তাই আমিও ভাবলাম ঠিক বিয়ের পর আমরা যেমন বড়দার বাড়িতে থাকতাম সেইরকম আবার থাকবো। আর এখন তাহলে আমাদের দুটো ঘর হয়ে যাবে বলো।

অনুরিমা প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বলে, তোমার যে কবে সাংসারিক বুদ্ধি হবে কে জানে? তোমার বড় বৌদির আমাদের সাথে থাকতে ইচ্ছে হলে আমাদের এই একতলা বাড়িতে এসেই থাকতে হবে।

উনি যদি ওনার অর্থ, প্রাচুর্য, বৈভব ছেড়ে সত্যিই যদি আপনজনদের মাঝে থাকতে চান তাহলে আমাদের এই সামান্য একতলা বাড়িতে এসেই থাকতে হবে।

পরিষ্কার ও দৃঢ়তার সাথে মনের ভাবখানা প্রকাশ করে অনুরিমা এঁটো থালাগুলো নিয়ে কলতলার অভিমুখে হাঁটা দিল।

অভিজিৎ গিয়ে তার বড়বৌদি তমালীকে অনুরিমার বক্তব্য এবং অবশ্যই শর্তখানা জানায়। তমালী মনে মনে যথেষ্ট অসন্তুষ্ট হয়। দুঃখী দুঃখী মুখ করে যদিও বলে, তাহলে তো আর একসাথে থাকা হল না ভাই।

অভিজিৎ চলে যাওয়ার পর তমালী নিশাকে ফোন করে অনুরিমার সব বক্তব্য জানায়। যদিও নিশা বলে, কাকীমনি কিন্তু খুব খারাপ কিছু বলে নি মা। তুমি যেমন তোমার আরাম, বৈভব এইসব ছেড়ে বের হতে চাইছো না কাকীমনিও তার আত্মসম্মান ও আত্মাভিমান এইসব ছেড়ে কেন বের হবে?
আসলে কি জানো মা, তুমি চিরকালই কাকীমনিদের হেয় প্রতিপন্ন করে এসেছো। আমাদের আর্থিক স্বচ্ছলতাকে দূরে সরিয়ে সম্পর্কগুলোকে কোনোদিনই তুমি সেইভাবে লালন করো নি। আজ আমি চাইলেও তোমার শরীর খারাপ হলেও ছুটে আসতে পারি না। আমার চাকরি আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। আমিও বাইরে, অরিত্রও বাইরে থাকে। তোমরা যদি নিজেরা মিলেমিশে থাকো তাহলে আমরাও আমাদের কাজগুলো মন দিয়ে করতে পারি।
তাই বলি মা, এখনও সময় আছে তোমার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করো। আমাদের জীবনে অর্থবল ও লোকবল দুটোই দরকার। আমরা যদি আপনজনরা একে অপরের নির্ভরযোগ্য সহায়তা লাভ করতে পারি তাহলে আকস্মিক কোনো ঝড়ে আমরা কখনো হারিয়ে যাবো না।

নিশার এই তাৎপর্যপূর্ণ কথাগুলো নিয়ে প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে ভাবনা চিন্তা করলো তমালী। সত্যিই তো আজ সে স্বামীহারা, একমাত্র মেয়ে সেও দেশের বাইরে। বাপের বাড়ির লোকজনদের সাথেও তেমন ঘনিষ্ঠতা নেই। কত দিন ভাইদের বাড়ি যাওয় হয় নি। একমাত্র নিকট আত্মীয় বলতে তার ছোট দেওর ও জা। হঠাৎ যদি তার কিছু বিপদ ঘটে সবার আগে তারাই আসবে ছুটে। সুতরাং নিজের আত্ম অহংকার ভুলে যদি ছোট জা অনুরিমার শর্তখানা মেনে নিতে পারি তাহলে জীবনের শেষের দিনগুলো নিরাপত্তাহীনতা ও একাকীত্বে কাটবে না।

Loading

Leave A Comment