মোটা ধান
-রীণা চ্যাটার্জী
সকালের কাজের ব্যস্ততার মাঝেই বেসুরো সুর- বৌদি আজ বিকেলে কাজে আসবো না। ঘরে অতিথি, কপালে ঘাম, মাথা গরম, তাও ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলো দীপালি- কাল সকালে আসবে তো?
-দেখি যদি রাতে ফিরে আসতে পারি তাহলে আসবো। ননদের বাড়ি যাব। গলাটা আরো নামিয়ে কানের কাছে এসে বললো, বড়োছেলের জন্য মেয়ে দেখতে যাব। ঝিমলি প্রায় পনেরো-ষোলো বছর কাজ করছে দিপালীর বাড়ি, ছেলেমেয়েদের চেনে, ছোটোবেলায় মায়ের হাত ধরে আসতো মাঝেমাঝে। তারপর আসা কমিয়ে দিয়েছিল বড়ো হবার পর। বড়ো! তা সে কতো বড়ো! বিয়ের কথায় তাই দিপালী বেশ অবাক হয়ে বলে, এখন বিয়ে দেবে? কতো বড়ো হলো?
-এই তো একুশে পা দেবে?
-এর মধ্যেই বিয়ে দেবে? কি করে?
-করে টুকটাক চলে যাবে ঠিক। চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছে, পেয়ে যাবে।
-চাকরি পাবার আগেই বিয়ে দেবে?
-এ তো তোমাদের শহর নয় বৌদি, গ্ৰামে ভাশুর- জ্ঞাতিরা পাঁচ কথা শোনাচ্ছে। ননদ মেয়ে দেখেছে, দেখতে না গেলে আবার কথা শোনাবে।
দিপালী আর কিছু বলে না। ঝিমলিও বাকি কাজ সেরে চলে যায়। পরদিন যে আসবে না দিপালী জানে- যথারীতি এলোও না। দিপালী আর কথা বাড়ায় না। কিন্তু ঘটনা একদিনে থেমে থাকে না। মেয়ে দেখতে যাবার নামে দেশের বাড়ি যাতায়াত বেড়ে যায়, ছোটো ছোটো ট্যুর- দু’ আড়াই দিনের। প্রায়দিনই এই চলতে থাকে- মেয়ে দেখতে যাওয়া।
একদিন দিপালী জিজ্ঞেস করে, কতো মেয়ে দেখবে? অনেকগুলো দেখলে তো? পচ্ছন্দ হচ্ছে না? কেমন মেয়ে চাই তোমাদের?
-দেখছি তো, কিন্তু হচ্ছে কোথায়? শুধু আমি দেখলে তো হবে না, মেয়ে-জামাই দেখবে, তাদের’ও পচ্ছন্দের ব্যাপার। তাদের পচ্ছন্দ হচ্ছে না, বলে-কারোর ঠোঁটটা বেশ মোটা, কারো দাঁত উঁচু, কারো চুল কম.. কি করি বলো?
দিপালী বুঝতে পারে, এরা হ্যারিকেনে তেল ভরে মেয়ে দেখতে বেরিয়েছে। তাও জিজ্ঞেস করে- শুধু রূপ দেখছো, না কি আরো কিছু দেখছো?
-সে তো বাপের অবস্থা দেখতেই হবে। ছোটো পরিবার হলে, নাহলে গ্ৰামের ঘরে বড়ো পরিবার, সে অনেক হ্যাপা। তারপর ছেলে বলেছে ‘কম করে একটা পাশ’ সেইসব তো আছেই, ছেলে তো আমার তিনটে পাশ দিয়েছে।
-তা বটে.. দেখো সব মিলিয়ে মনের মতো কবে পাও।
-জানো বৌদি, আমিও মেয়ের বাড়িতে বলে দিই যাবার আগে, মেয়েকে বলা চলবে না, ছেলের বাড়ি থেকে দেখতে আসবে। সাজাগোজ চলবে না। যেমন আছে তেমনি দেখবো। সাজগোজের নামে স্নো পাউডার মাখলে কি আর আসল রঙ বুঝতে পারবো বলো?
-বাবা! তোমার ঘটে এতো কথা! তোমার ছেলে তো কালো..
-তাই তো একটু ফর্সা মেয়ে দেখছি গো.. নাহলে দুজনেই কালো হলে শেষে ‘মোটা ধান’ হবে।
-মোটা ধান? সে কি?
-এই দেখো, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কালো হলে, বাচ্চাও কালো হবে যে..
-ওহ্, তা তুমি তো কালো নয়, তোমার ধান কালো হলো কেন?
-সে আর কি বলি বলো? ওদের বাবা যে কালো। আমার বাবা বিয়ে দিয়েছে, আমি তো আর দেখি নি।
দিপালী বুঝলো, এদের কিছু বোঝানো বৃথা। কষ্টও পেলো- যত বিচার সব মেয়েদের জন্য।
এরপর আরো কিছুদিন গেল। আরো মেয়ে দেখার ছুটিও হলো। মাস ছয়েক পর একদিন এসে বললো, বৌদি এক জায়গায় পাকা কথা হতে পারে বিয়ের, বাপের অবস্থা ভালো, দুই মেয়ে- বড়োর বিয়ে হয়ে গেছে, এটা ছোটো। মেয়ে একটা পাশ দিয়েছে, আর একটা পাশের পড়া পড়ছে। রঙটা কালো না, শ্যামলা.. মোটামুটি,তা হোক, চলে যাবে। বাপের অবস্থা ভালো- দেবে-থোবে। ওরা জানাবে বলেছে- তোমাকে কিন্তু একটা ভালো কিছু দিতে হবে, আগে থেকে বলে রাখলাম।
দিপালী বললো, ঠিক আছে। সে দেখা যাবে। ওরা কি জানায় দেখো তো..
মনে মনে ভাবলো মেয়েরা আর কতোদিন রূপ আর রূপোয় বিকোবে কে জানে? ছেলে কেমন দেখতে কই কেউ তো জানতে চায় না।
দিন দুয়েক পর ঝিমলি কাজে এলো, মুখটা শুকনো। জিজ্ঞেস করলো দিপালী, কি হলো?
-মেয়ের খুব চোপা বৌদি, মুখরা মেয়ে।
-কেন? কি হলো আবার! কি বলেছে?
-বলেছে চাকরি পেলে যেন সম্বন্ধ নিয়ে আসে, তিনটে পাশ দেওয়া ছেলে নিয়ে কি ধুয়ে জল খাবো।
মনটা খুশিতে ভরে উঠলো দিপালীর। না জানা, না চেনার মেয়েটার জন্য মনটা অকৃত্রিম স্নেহ আর ভালোবাসায় ভরে গেল। মনে মনে বললো, মোটা ধানের মুখের মতো জবাব, এই সাহসটুকু বুকে বেঁধে রাখিস মা, আর ছড়িয়ে পড়ুক এই সাহস ষ্ফুলিঙ্গের মতো সব মেয়ের বুকে- যেন নিজের আত্মসম্মান এইভাবে বজায় রাখতে পারে।
মুখে বললো ঝিমলিকে- দেখো, দেখতে থাকো, ঠিক পেয়ে যাবে তোমাদের মনের মতো।