প্রবন্ধ- হিংসা

হিংসা
-শচীদুলাল পাল

 

 

ষড়রিপুর মধ্যে মাৎসর্য এক রিপু। মাৎসর্য বিষে জর্জরিত হয়ে আসে পরশ্রীকাতরতা। পরশ্রীকাতরতা থেকে জন্ম নেয় ঈর্ষা। আর ঈর্ষা থেকে জন্ম নেয় হিংসা।

মানুষ সব সময় নিজেকে প্রথম স্থানে দেখতে চায়। এটা তার চাহিদা। কিন্তু যখন মানুষ এই স্থানে অন্য কাউকে দেখে তখন তার মনে একটা জেদ আসে। যতক্ষণ সে সেই জেদটা চেপে রাখতে পারে ততক্ষণ সেটা জেদ। আর যখন প্রকাশ পেয়ে যায় তখনই সেটা হিংসাতে পরিণত হয়।
লোভ থেকেও হিংসার জন্ম হয়। মানুষ অন্যকে একটা কিছু পেতে দেখে নিজেও সেটা পেতে চায়। অন্যের উন্নতি সে দেখতে পারে না।
সে বদলা নেবার প্রচেষ্টা করে। প্রথমে কারণে অকারণে তাকে অপমান করে নিচু দেখিয়ে মনের ঝাল, মনের জ্বলন মেটায়।
যে ব্যক্তি অপমানিত হয় সে যদি ভাবে। আমাকে কেন অপমান করলো! তাতে সে দেখবে সে আমার স্থানে কোনোদিন আসতে পারবে না। তাই তার মধ্যে হিংসার বহিঃপ্রকাশ।

কিন্তু যখন সে সেইটা পায় না তখন যেই ব্যক্তি ওই জিনিষটা পেলো তাকে সে হিংসা করা শুরু করে।

মানবচরিত্রে যেসব খারাপ দিক আছে, তার মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ মারাত্মক ক্ষতিকারক। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, ঈর্ষাকাতরতা, কলহ-বিবাদ প্রভৃতি মানুষের শান্তিপূর্ণ জীবনকে অত্যন্ত বিষময় করে তোলে। এতে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে অন্যের সুখ-শান্তি ও ধন-সম্পদ বিনষ্ট বা ধ্বংস করে নিজে এর মালিক হওয়ার কামনা-বাসনাকে হিংসা বলা হয়।

হিংসা করলে যার প্রতি করা হয় তার কোনো ক্ষতি সাধারণত হয় না কিন্তু হিংসুক ব্যক্তি তার সমস্ত ধ্যানজ্ঞান এর পেছনে ব্যয় করে যে নিজেরই ক্ষতি সাধন করছে তা বোঝার
মত জ্ঞানও হারিয়ে ফেলে।

সুযোগ খোঁজে কি করে অন্যের অনিষ্ট করবে। তার ঈর্ষানল প্রজ্বলিত হয়। রাগে অন্ধ হয়। হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। সে আঘাত করে বসে। পরিণাম সংঘর্ষ হানাহানি লড়াই। যুদ্ধ হত্যা পর্যন্ত সংঘটিত হয়।

একটা দেশ একটা জাতি একটা গোষ্ঠী অন্য দেশ অন্য গোষ্ঠীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

বিশ্ব ইতিহাস আজ কলুষিত এই হিংসার কারণে।
ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপপ্রচার কুৎসা রটিয়ে নিজের জলন দূর করে হিংসার আর একটি বহিঃপ্রকাশ হলো ঠাট্টা বিদ্রুপ করা।

প্রকৃত আদর্শবান ব্যাক্তি, মহান ব্যক্তি হিংসা দ্বেষ জলনকে উপেক্ষা করে।
একটা দেশ জাতি গঠনে হিংসাহীন মানসিকতা কাম্য।

ঘরে ঘরে পাড়ায় প্রতিবেশীদের মধ্যেই দেখা যায় ভাইয়ে ভাইয়ে, জায়ে জায়ে প্রতিবেশীদের মধ্যেই হিংসা বেশি প্রকটিত হয়। কারোও ছেলেমেয়ে পড়াশোনা, চাকরি-বাকরি করে উন্নতি করলে ভীষণ ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের হিংসা বেশি হয়।
ফলস্বরূপ জ্বলে পুড়ে মরে। এই যে জ্বলন সেখান থেকে হরমোনের ক্ষরণ হয়। ফলত এড্রিন্যাল গ্ল্যাড থেকে ক্ষরণ হয়। তাতেই ইন্ডাইজেশন, আলসার, ডায়াবেটিস, কিডনি লিভারের মারাত্মক ব্যাধি সৃষ্টি হয়।
হিংস্র প্রাণীরা বেশিদিন বাঁচে না। পরন্তু কচ্ছপ, শান্ত নম্র ধীর অহিংসক প্রাণী প্রায় তিনশ বছর বাঁচে।
ডাইনোসরাস হিংস্র প্রাণী লড়াই করে অন্যকে হত্যা করে নিজেদেরই ধ্বংস করেছিল।

নারী সহীংসতা
———————-
সহিংসতাঃ সহিংসতা বলতে আমরা বুঝি অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্যাতন, অতিরিক্ত শাসন, যৌন হয়রানি বিবিধ। জন্মের পর থেকেই একটি শিশু বিভিন্ন ভাবে সহিংসতার  শিকার হয়।

নারীর প্রতি সহিংসতা বা নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা হচ্ছে সহিংস অপরাধগুলো যেগুলো প্রধাণত বা কেবলই নারী বা বালিকাদের উপরেই করা হয়। এরকম সহিংসতাকে প্রায়ই ঘৃণাপূর্বক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়,
যা নারী বা বালিকাদের উপর করা হয় কেননা তারা নারী। নারীর প্রতি সহিংসতার খুব লম্বা ইতিহাস রয়েছে, যদিও এরকম সহিংসতার মাত্রা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ছিল, এমনকি আজও বিভিন্ন সমাজে এগুলোর মাত্রা ও ঘটনার ধরণ বিভিন্ন হয়। এরকম সহিংসতাকে প্রায়ই নারীকে সমাজে বা আন্তঃব্যক্তি সম্পর্কে অধীনস্থ করার কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ব্যক্তি তার অধিকারপ্রাপ্তির বোধ, উচ্চস্থানের বোধ, নারীবিদ্বেষ, বা নিজের সহিংস প্রকৃতির জন্য নারীর প্রতি সহিংস আচরণ করতে পারেন।

নারী ও বালিকাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা একটি পৃথিবীব্যাপী বিরাজমান সমস্যা। সমগ্র বিশ্বজুড়ে তিন জন নারীর অন্তত একজনকে মারা হয়েছে, জোরপূর্বক যৌনক্রিয়া করতে বাধ্য করা হয়েছে, বা অন্য কোনোভাবে তার জীবনে যৌন নির্যাতন করা হয়েছে যেখানে নির্যাতনকারী কোনভাবে তার পরিচিত ছিল।

নারীর প্রতি সহিংসতাকে কয়েকটি বৃহৎ শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। এগুলোর মধ্যে “ব্যক্তির” দ্বারা সহিংসতা ও “রাষ্ট্রের” দ্বারা সহিংসতা উভয়ই রয়েছে। সহিংসতার কোন কোন ধরন আছে যা ব্যক্তির দ্বারা ঘটে যথা – ধর্ষণ, গৃহ নির্যাতন, যৌনহয়রানি,  প্রজননগত জোর-জবরদস্তি,  কন্যাশিশুহত্যা, লিঙ্গভিত্তিক গর্ভপাত,  উচ্ছৃঙ্খলা জনতার দ্বারা সহিংসতা বা দাঙ্গা, রীতি বা আচারগত চর্চা যেমন সম্মান রক্ষার্থে হত্যা বা অনর কিলিং, যৌতুক সহিংসতা বা পণ মৃত্যু,  অপহরণপূর্বক বিবাহ বা জোরপূর্বক বিবাহ। আবার কিছু কিছু ধরনের সহিংসতার কর্তা হচ্ছে রাষ্ট্র, যেমন – যুদ্ধকালীন যৌন সহিংসতা, সংঘর্ষের সময় যৌন সহিংসতা এবং যৌন দাসত্ব, বাধ্যতামূলক নির্বীজন, জোরপূর্বক গর্ভপাত, পুলিশ ও কর্তৃত্বকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারীর দ্বারা সহিংসতা, পাথর ছুড়ে হত্যা বা চাবুক মারা। আবার অনেক ধরনের যৌন সহিংসতা সংঘটিত সংগঠিত অপরাধ চক্রের দ্বারা, যেমন – নারী পাচার এবং জোরপূর্বক বেশ্যাবৃত্তি।

নারীর জন্ম থেকে শুরু করে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত সকল পর্যায়ে নারীর প্রতি সহিংসতার বিভিন্ন ধরন নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে নতুন ধারা তৈরি হয়েছে যেখানে বিভিন্ন সম্মেলন বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন,বিভিন্ন ডিরেক্টিভ এর সাহায্যে আন্তর্জাতিক মাত্রায় এই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে চাচ্ছে, যেমন যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে ডিরেক্টিভ, মানব পাচারের বিরুদ্ধে ডিরেক্টিভ।
 উল্লেখ্য, এখানে ডিরেক্টিভ বলতে কোন আন্তর্জাতিক সংঘের একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে তৈরি করা লক্ষ্যমাত্রাকে বোঝানো হয় যেখানে সংঘটির সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে সেই লক্ষ্যপূরণের উদ্দেশ্যে কাজ করতে হয়, কিন্তু সেই লক্ষ্যপূরণের উপায় সেখানে বলে দেয়া থাকে না।

Loading

2 thoughts on “প্রবন্ধ- হিংসা

Leave A Comment