সাঁড়াশী জিন্দাবাদ
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়
গঙ্গা সাগর মেলায় লাখো সাধুবাবা হাজির। হাজির লাখো লাখো পুণ্যার্থী। মানুষের চাওয়ারও শেষ নেই দুঃখেরও শেষ নেই। শেষমেশ ভরসা সাধুবাবা।
মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা সাধুবেশী সাধকের পা জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ কান্না।
বাবা এই বয়সে স্বামী আমার অন্য মেয়ের পাল্লায় পড়ে, আমাকে দুরছাই করছে বাবা, আমি কী নিয়ে বাঁঁচবো বাবা।
বাবা গাঁজার ছিলিমে সুখটান দিয়ে বললো, আরে দুর বেটি। ভয় কী। সাহস কর। রুখে দাঁড়া। মনকে সাঁড়াশী কর। কামড়ে ধর। সাঁড়াশীর কাছে সবাই জব্দ।
সাঁড়াশী। কেন জানিনা, খুব কম বয়স থেকেই এই যন্ত্রটির প্রতি আমার বিশ্বাস আস্থা প্রগাঢ়। অনেক সময় একে আমার অস্ত্র বলে মনে হয়।
সাঁড়াশী আক্রমণ। অর্থাৎ এমন ভাবে সজোরে চেপে ধর, যা ছাড়িয়ে পালানো প্রায় অসম্ভব। সাঁড়াশী জেরায় জেরবার হয়ে আচ্ছা আচ্ছা প্রভাবশালীকে নাকানিচোবানি খাইয়ে ছেড়েছে দুঁদে উকিল। কিন্তু, দেখলে মনে হবে, ওটা নিতান্তই সাদামাটা একটা রান্নাঘরের আর পাঁচটা সাধারণ রান্নাবান্নার সাহায্যকারী একটি বস্তু। কিন্তু কী সাংঘাতিক এর ক্ষমতার বহর, না না শুধু ক্ষমতার কেন, নামের মাহাত্ম্য, সেকি কম?
আমার তো মনে হয় নামের মস্তানিতে সাঁড়াশী সেরা। কেননা শক্তপোক্তর কথায় যদি আসা যায়, তাহলে তো রান্নাঘরের হামানদিস্তে, শিলনোড়া, তারা-ও কম যায় না। কিন্তু সাঁড়াশীর কাছে ওদের কেমন যেন ম্রিয়মাণ মনে হয়। মনে রাখতে হবে, কুটিরশিল্প কারখানার ( পড়ুন রান্নাঘর ) সেরা যন্তর সাঁড়াশী।
একজন প্রৌঢ়া মহিলা, সামান্য মানসিক ভারসাম্যহীন। পাড়ার দুষ্টু ছেলেপিলের দল দেখতে পেলেই চিৎকার করে তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতো, সাঁড়াশী.. ব্যাস, আর যায় কোথায়। মহিলা মুখে যা আসতো তাই বলে গালমন্দ করতো। ছেলেরাও প্রৌঢ়ার ক্ষাপামি দেখে ভারি মজা পেত। তারা দ্বিগুণ উৎসাহে বারবার উচ্চারণ করতো, সাঁড়াশী..সাঁড়াশী.. প্রৌঢ়ার মেজাজ আর কন্ঠস্বর আকাশ বিদীর্ণ করতো, কিন্তু মজা পাওয়া কিশোরগুলোর মন হয়তো বা পাথর দিয়ে গড়া, অথবা সাঁড়াশী শব্দের এমন মজাদার মাহাত্ম্য গুণ তাদের এমন পাগল করে তুলতো, যেখানে হৃদয় নামক বস্তুটি কিছুমাত্র নরম হতে পারতো না।
এই গেল নাম মাহাত্ম্য।
সাঁড়াশী হৃদয় লোক, আরও ভয়ংকর। অনেকটা বাংলা সিনেমার কমল মিত্র টাইপ। ধরলে আর রেহাই নেই। তা সে উত্তম কুমারই হোক কিংবা সুচিত্রা সেন।
“নিজে রোজকার ক’রে তারপর বড়ো বড়ো কথা বললে ভালো হয় না কী?” ব্যাস, হয়ে গেল। এইকথা শোনার পর কোন লায়েক ছেলে-মেয়ে নিজের মান খুইয়ে বাপের কাছে থাকবে? চললো তারা আজন্মের আস্তানার মায়া কাটিয়ে কেরিয়ার গড়ার পথে। চ্যালেঞ্জ একসেপ্ট।
এককথার ধাক্কায় বাড়ি থেকে দূর করে দিতে একটুও দয়া মায়ার ধার ধারত না। বেড়িয়ে যাও মানে, বেড়িয়ে যাও। এ কথার আর নড়চড় হবে না। ওদিকে স্ত্রী কেঁদে ভাসাচ্ছে। যতই হোক মায়ের প্রাণ। ডুকরে কেঁদে বলছে, ওগো একি করলে, ছেলে যে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে!
সাঁড়াশী হৃদয় বাপের কোনও হেলদোল নেই। নাইটগ্রাউন গায়ে চাপিয়ে ফুরফুরে চুরোট দাঁতে চেপে, ইজি চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছে। ভাব খানা এমন, যেন কিছুই হয়নি। হতে পারে না। আর হলো তো ভারি বয়েই গেল। একটা বেপরোয়া হিটলারি মনোভাব। আমার কথাই শেষ কথা। ফাইনাল সিদ্ধান্ত। কেউ নাক গলাতে এসো না। লাভ হবে না। ইয়ে বাত নেহি, সাঁড়াশী কা ফান্দা হ্যায়।
সাঁড়াশীর কাজ, শক্ত করে চেপে ধরা। দারুণ শক্ত। নির্দয়তার চরম নিদর্শন। সাঁড়াশী আলগা হয়ে গেলেই, ধপাস।
পপাত ধরণী তল। ছত্রাখান হয়ে চিত্তির।
কলেজে পড়া ছেলে। পড়াশোনায় তেমন মনোযোগী নয়, যতটা বন্ধুবান্ধব, ফুর্তি আর অপ্রয়োজনীয় এদিক ওদিকে উড়ুক্কু মন। এককথায় পয়সাওয়ালা বাপের কু-পুত্তুর। সেদিন সারারাত বাড়ি ফিরলো না। মা কেঁদেকেটে একসা।
ওগো ছেলেটা আমার কোথায় গেল? এমন তো কখনও হয় না। যত রাতই হোক বাছা আমার বাড়ির বাইরে ক্কখনো রাত কাটায় না।
একি হলো গো?
ছেলের ছাইপাঁশ গিলে বাড়ি ফেরার কথাটা এখানে উহ্য রইলো।
বাপ কিন্তু চুপচাপ। খানিক পরে একটি কথাই উচ্চারণ করলো, চিন্তার কিচ্ছু নেই, সকাল হলেই ঠিক ফিরে আসবে। যাবে কোথায়, যাবার কি কোনও জায়গা আছে? তোমার বেয়াক্কেলে আদরে সে জাহান্নামে গেছে।
গর্ভধারিণী অশ্রুসিক্ত হয়ে অনুযোগ করলো, তুমি কি পাষাণ ?
সাঁড়াশী হৃদয় বাপ নির্লিপ্ত মেজাজে চুরটে অগ্নি সংযোগ করলেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্ধকার আকাশে তারা দেখলেন। কিছু গুনগুন করে সুর ভাঁজলেন না।
পরদিন সকালেও, ছেলে এলো না। এলো একটা ফোন৷ ছেলেকে যদি ফিরে পেতে চান, এখনই দশ লাখ টাকার ব্যবস্থা করে রাখুন।
ফোনটা বাবা ধরে ছিলেন। কথাটা শুনে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললেন, দশ লাখ কেন, একটি পয়সাও পাবে না। কুলাঙ্গারটা তোমাদের কাছেই যতদিন পারে থাক। রাখতে না পারলে ফেরত পাঠিও। যদিও ওকে ফেরত নেবার কোনও ইচ্ছেই আমার নেই।
ফোন কেটে গেল না। ওপ্রান্তের সব কথাই ভেসে আসছিলো, অচেনা কন্ঠ, কী সাংঘাতিক বাপ মাইরি তোর। মিলিটারি! তোর সব প্ল্যান খতম। নকলি কিডন্যাপ নাটক ফিনিশ। এবার যা, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যা।
এবার ছেলের সুমধুর বাণী, শালা, বাপ তো নয়, সাঁড়াশী। কেবল চিমটি কেটে ধরতে পারে, ওফঃ।
এবার ফোন কেটে গেল। বাপ আবারও চুরটে অগ্নি সংযোগ করলেন। অস্ফুট উচ্চারণ করলেন, হতচ্ছাড়া…
আলগা দিলেই হাতছাড়া। ওহে কড়াই বাছাধন, সাঁড়াশীকে গরম দেখিও না। যত গরমই হও সাঁড়াশী কান ধরে নামিয়ে আনবে। বুঝতে পেরেছো? জোরসে ধরো হেঁইও। এ-যুগে সাঁড়াশীই শেষ কথা। মোক্ষম দাওয়াই। সুতরাং, সেই সাধুবাবার জুতসই নিদান ।
মনকে সাঁড়াশী করো। কঠিন কঠোর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হও। যুগের সঙ্গে কুস্তি লড়তে হলে, টিঁকে থাকতে হলে, বলো, সাঁড়াশী জিন্দাবাদ।
সাঁড়াশী জিন্দাবাদ।।
এই লেখাটি আলাপীমন এর প্রাণভোমরা রীণা বোনটি কে উৎসর্গঃ করলাম ।এই লেখাটি তে ওর অনুপ্রেরণা অনেকখানি , তাই খানিকটা ঋণ শোধ করার চেষ্টা করলাম মাত্র ।।
কিছু প্রাপ্তি আর্শীবাদপুষ্ট করে জীবনকে, নতমস্তকে গ্ৰহণ করতে হয়- করলাম তাই দাদাভাই। ঋণের কথা বলে আমাকে ঋণী করবেন না- সাথে থাকবেন আর্শীবাদী হাত আলাপী মন-এর মাথায় রেখে। প্রণাম নেবেন। ভালো থাকবেন।
আমি ও বলি সাঁড়াশি জিন্দাবাদ। দারুণ