
চিঠি- আমার একলা লাগে ভারি
আমার একলা লাগে ভারি
-সুমিতা দাশগুপ্ত
….
আজ রবিবার। সকাল থেকেই তুমুল বৃষ্টি নেমেছে। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। আমার বাড়ির প্রশস্ত লনের কোণে, বিশাল ওক গাছটা থেকে থেকেই প্রবল বেগে মাথা ঝাঁকাচ্ছে, এই বন্দীজীবন ওর আর ভালো লাগছে না বোধহয়, ওরও কী আজ মনখারাপের দিন ঠিক আমারই মতো!
আশ্চর্য! কতোগুলো বছর কেটে গেল এদেশের মাটিতে, তবু এইরকম ঘনঘোর বর্ষায় আমার মন ছুটে চলে যায়, আমার ছেলেবেলার রাঙামাটির দেশে, খুব মন কেমন করে তোর জন্য, তোদের সক্কলের জন্য। রাস্তাঘাট, স্কুল বাড়ি, খেলার মাঠ, নীল গগনের সোহাগ মাখা আমার সকাল সন্ধ্যেবেলা, সব, -সব কিছু এসে ভীড় করে এসে দাঁড়ায়, আমার মনের মধ্যে। খুব ইচ্ছে করে, তোর সঙ্গে কথা বলতে, কিন্তু এখন তো তারও কোনও উপায় নেই, পৃথিবীর অপর গোলার্ধে এখন গভীর রাত, তোরা সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অগত্যা নিজের মনে একাএকাই সুখ দুঃখের কথা কই।
আমার ছেলেরা তো এখন যে যার নিজের ঘরে দুয়ার এঁটে মোবাইল নিয়ে বসেছে। প্রকৃতির পানে চেয়ে দেখার অবকাশ নেই তাদের। আসলে ওরা তো কেউ রোদেপুড়ে, জলে ভিজে কাদামাটি মেখে বড়ো হয়নি আমাদের মতো, কোনও দিন হাঁটে নি শীতের কুয়াশা মাখা আবছাপথে।এদেশে কেবল বৃষ্টি আর বরফ, গৃহবন্দী এইসব শিশুদের খেলাধূলাও সব গ্যাজেট নির্ভর। তাই ওদের শৈশবও আমাদের মতো স্বপ্নেমোড়া নয়। ওরা কেউ কোনও দিন কাগজের নৌকা ভাসানোর আনন্দটুকু পেলই না। আমাদের এইসব সুখ দুঃখের গল্পের মর্ম ওরা আর কী বুঝবে বল!
খুব ভুল যদি ভেবে না থাকি তাহলে এখন তো বোধহয় আষাঢ়ের শুরু। আমাদের রাঙামাটির দেশে বৃষ্টি নেমে গেছে। আমি মনে মনে বেশ দেখতে পাই, তুই বাদলা দিনে বারান্দায়, থামে হেলান দিয়ে, কালো পাথরের বেদীতে পা ছড়িয়ে বসে বৃষ্টি দেখছিস। বড়ো বড়ো সব গাছপালার পাতা বেয়ে জল গড়িয়ে নামছে, কাকগুলো সব ভিজে ঝুপ্পুস।
আমাদের বাড়ির এই বারান্দাটা কিন্তু বড্ডো ভালো, বল্! বিরাট বড় বারান্দায় গোটা চারেক থাম, রেলিং এর বদলে চওড়া কালো পাথরের বেদী দেওয়া। ছুটির দিনে অনেকটা সময় আমরা ওখানেই কাটাতাম।
দুই ধাপ সিঁড়ি বেয়ে নেমে লাল সুরকি ঢালা পথ সারা বাড়িটাকে ঘিরে রেখেছে, পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে বেলফুল আর রঙ্গনের গাছ। গেটের মাথায় জুঁই এর ঝোপ আজও গন্ধ ছড়ায় জানি। কুয়োতলার পাশে নীলমণি লতার মনকাড়া নীলিমা।
এক একদিন রাতে আমরা সবাই রাতের খাওয়ার পর বারান্দায় বসে গল্প গুজব করতাম, বাবা আমাদের গান গাইতে বলতো। তুই তো চিরকালই ভালো গাইতে পারিস।তোর রিনরিনে গলার সুর ছড়িয়ে পড়তো চারপাশে। আমি ছিলাম ফাঁকিবাজ। গান গাইতে চাইতাম না, গাইলেও মাঝপথে থেমে গিয়ে বলতাম- আর জানি না।
একবার কিন্তু, বাবা আমায় খুব জব্দ করেছিল, মনে আছে তোর? ছেলেবেলায় খুঁটিনাটি সব কিছু নিয়ে বায়না ধরা ছিল আমার স্বভাব। যেটা চাই, সেটা না পাওয়া পর্যন্ত ঘ্যানঘ্যান চলতেই থাকতো। প্রতিবছর বর্ষায় কদম ফুল ফোটা শুরু হতেই বায়না জুড়তাম, ঐ ফুল পেড়ে দিতে হবে। রোজ রোজ অতো উঁচু গাছের ফুল পাড়ে কে? একদিন মালীকাকু একখানা কদমগাছ এনে পুঁতে দিয়ে বলেছিল-
“নাও আজ থেকে এটা তোমার গাছ। বড়ো হলে দেখবে কতো ফুল দেয়।”
বাবা বলেছিলো-
“না, অতো সহজে কোনো কিছু পাওয়া যায় না, পেতে নেই। যেদিন ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ গানটা ঠিকঠাক গাইতে শিখবে, সেই দিনই ওটা তোমার হবে।”
আমিও তেড়েফুঁড়ে উঠে কিছুদিনের মধ্যেই শিখে নিয়েছিলাম গানটা, আর নিজের অজান্তেই পেয়েছিলাম এক অমূল্য শিক্ষা। আকাঙ্ক্ষার বস্তু পেতে নয়, নিজের যোগ্যতায় অর্জন করতে হয়। আজও মনে রাখি সেই কথা।
আমার পূর্ণবয়স্ক কদম গাছ সময় মতোই ফুল ফুটিয়েছে, এখনও নিয়মিত অজস্র পুষ্পসম্ভার নিয়ে হাজির হয় বাদলের গান শোনাতে। তোর তোলা ছবি দেখে, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাই।
বৃষ্টিটা মনে হয় ধরে এলো। ওকের ছুঁচালো পাতার আগা থেকে বিন্দু বিন্দু জল ঝরছে, ঠিক যেমনটি আমাদের বাড়ির সামনের ইউক্যিলিপটাস গাছ থেকে ঝরতো টুপটাপ করে। মনে আছে, বৃষ্টিটা একটু ধরলেই আমরাও বেরিয়ে পড়তাম? বাগানের জল যাওয়া নালাটা তখন ঘোলা জলের খরস্রোতা নদী । সেই নদীতে আমরা দুজন কত্তোগুলো কাগজের নৌকায় নিজেদের নাম লিখে ভাসিয়ে দিতাম! দিব্যি হেলেদুলে ভেসে ভেসে চলে যেত ওরা অজানার পথে।
জুঁই ফুলের গন্ধ ভরা রাতে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে কল্পনায় দেখতাম সেই নৌকা তখনও ভেসেই চলেছে পরীরাজ্যের ঠিকানায়। হাতের মুঠোয়, আপনি এসে ধরা দিতো স্বপ্নলোকের চাবি।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে এখন। আকাশ থেকে বিলীয়মান আলোর আভা এসে পড়েছে লনের উপরে। ঠিক যেন সেই গানটা ‘ধরণীর গগনের মিলনের ছন্দে ,বাদল বাতাস মাতে মালতীর গন্ধে’- কিন্তু আমাদের দেশের মালতীর গন্ধ এরা পাবে কোথায়?
চল দাদা আমরা দুজন মিলেই না হয় গাই গানটা,
আমি গাইবো গুনগুন করে, আর তুই গাইবি আমার মনে।
ও আরও একটা কথা, এবার যখন দেশে যাবো আমরা দু’জন মিলে কাগজের নৌকা ভাসানোর খেলাটা আবার খেলবো, শুধুই আমরা দুজন, কেমন! ……


3 Comments
Shyamal sengupta
Apurbo.Ashadharon.Kolponae chotobelar smritichalon.
Anirban
Very nice. 👏🏼👏🏼
Anonymous
Besh laglo.