শিকারী
-রাখী চক্রবর্তী
নারায়ণ পুর গ্রামের একদম শেষ প্রান্তে যে দু’টো বাড়ি আছে তার মধ্যে একটি বাড়িতে মাদু থাকতো ওর বাবার সাথে। কিছুটা দুরে জেলে পাড়া ,ঐ জেলে পাড়ায় ওর বাবার খুব যাতায়াত ছিল। জেলে না হলেও জমিদার বাড়ির পুকুরে মাছ ধরার জন্য ডাক পড়তো মাদু’র বাবা মানে নিরু সাহার। মাদু ওর বাবার খোঁজ করতে করতে মাঝে মধ্যেই জেলে পাড়ায় যেতো। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হতো, মাদুর বাবা বাড়ি ফিরতো না। তখনই মাদু ওর বাবার খোঁজ করতে বেরিয়ে পড়তো। রতন ও হাবু ছিল জেলে পাড়ার মস্তান। মাদু’র দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকতো রতন ও হাবু, মাদুর অস্বস্তি হতো খুব। এক সন্ধ্যা বেলায় মাদু ওর বাবার খোঁজ করতে গেছে জেলে পাড়ায়।
রতন বিড়ি মুখে দিয়ে সুর টেনে বললো, মাদু দেখবি আমার যাদু। একটু আদর দিলেই তুই ঠিক হয়ে যাবি কাবু।
হাবু হেসে বললো, আমি হলাম হাবু, হা হা হা
মাদু- দা সঙ্গে নিয়েই বাড়ি থেকে বের হই।দেখা তোদের যাদু।
মাদু’র রুদ্র মূর্তি দেখে রতন ও হাবু পালিয়ে গেল।এমনি করেই মাদুর দিন যায়, রাত যায় রতন ও হাবুকে দা দিয়ে ভয় দেখিয়ে।একদিন মাদু’র বাবা মেয়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করেই বসলো জেলে পাড়ায় আর সে যাবে না। মাদুও খুব খুশি বাবার কথা শুনে। মাদু’র খুব সম্মানে লাগে রতন ও হাবু যখন কুনজরে দেখে ওকে। বয়স্থা মেয়ে মাদু’র লাজলজ্জা একটু বেশিই। যাক সে কথা
মাঘ মাসে মাদুর বিয়ে ঠিক করলো ওর বাবা।
শীতের আমেজ নিয়ে মাদু বৌ সাজলো।লজ্জাবতী পাতার মতো হয়ে আছে মাদু।সলাজ দৃষ্টি ওর। সখীরা ধরলেও লজ্জায় গুটিয়ে যাচ্ছে মাদু। বেশি রাতে বিয়ের লগ্ন ছিল। অতিথিদের খাওয়া দাওয়া হয়ে গেছে তারপর মাদুর বিয়ে শুরু হলো।
শুভদৃষ্টির সময় বরের দিকে তাকিয়ে মাদু থমকে গেছিল। চোখ দু’টো কতো চেনা।
মাদু তো আর হবু বরকে দেখেনি আগে। তবে চেনা কেন লাগবে! মাদু মনে মনে বলছে স্বপ্নতে দেখেছি রাজপুত্রকে। বাবা যথার্থ পাত্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছে।
সখীরা বলছে, মালাটা দে বরের গলায়। এই মাদু…
মাদু চমকে উঠে বললো, এই তো দিচ্ছি। মালা বদল হলো, বিয়ে সুসম্পূর্ণ হল। মাদু স্বামীর ঘর করতে চললো।
অষ্টমঙ্গলায় মাদু বাপের বাড়ি আসবে। ঠিক আগের রাতে মাদু’র বর খুন হলো। রক্তারক্তি ভাবে না, বিষাক্ত দংশনে। সারা শরীর নীল হয়ে গেছিল। পুলিশ মাদুকে থানায় ধরে নিয়ে গেল জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ।
নিরু সাহার জীবন থমকে গেল, জামাইয়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে। যৎসামান্য সঞ্চয় ছিল, মেয়ের বিয়ে দিয়ে তা শেষ করেছে নিরু।মাদু’র বিধবা হওয়ার খবর পেয়ে রতন ও হাবু এসেছিল নিরুর কাছে। কতবার বললাম নিরুকা আমাদের সাথে মাদুর বিয়ে দাও।দিলে না। বিধবা মেয়েকে পোষো এবার।
নিরু নিরুত্তর থাকে রতন হাবুর কথা শুনে।
একমাস হয়ে গেল মাদু বাপের ভিটেতে পা রাখেনি। রতন চম্পট দিয়েছে ভিন্ গায়ে। মাদু পুলিশের কাছে বলেছে রতন ও হাবু বিষ দিয়েছে ওর স্বামীকে। ওপর তলার পুলিশ নড়েচড়ে বসেছে মাদু’র কথা শুনে। মাদু’র ওপর অকথ্য অত্যাচার করেছে থানার বড়বাবু। সবটাই হাবিলদার দামোদরের কাছ থেকে শুনেছে রতন। তাই দেরি না করে রতন গাঁ ছাড়ল। হাবু গাঁয়েতেই ছিল।
তিন মাস পর রতন নারায়ণ পুর গ্রামে ফিরলো। সন্ধ্যা বেলায় রতন গঙ্গার ধারে গিয়ে বসলো। মাদু গঙ্গার জল নিয়ে ফিরছিল, মাদুকে দেখে মাদু’র সামনে এসে রতন বললো, কি রে মাদু ঠমক্ ঠমক্ করে চললি কোথায়?দিনের বেলায় তোর দেমাক সহ্য করবো, কিন্তু রাতে আমি যা চাইবো তাই হবে।
মাদু- পথ ছাড়,যেতে দে।
রতন- না না, জাপটে ধরে তোকে একেবারে মহলে নিয়ে উঠবো। হ্যাঁ রে মাদু শ্বশুর ঘর ছাড়লি কেন? বরকেই বা মারলি কেন?
আমার জন্য মন কেমন করে তোর তাই না।আমি রাজি বে করবি আমাকে। ওই একটু আদটু আনন্দ ফূর্তি করেছিস বে করে, তাতে কোন দোষ হয় না রে। তাহলে ঐ কথা রইলো আজ রাতে চলে আসিস মহলে।
মাদু- তোর বাপের মহল বুঝি। ফোট এখান থেকে। হাত ছাড় বলছি
রতন- তোকে দেখে নেবো। আজ রাতেই।
রতন মুখে বিড়ি গুঁজে গজগজ করতে করতে চলে গেল।
রাতে জেলে পাড়ায় উৎসব হবে মানে ছাইপাঁশ খাওয়া দাওয়া হবে। রতনের বন্ধু হাবু, কলকে, হারু সব আসবে।
রতন হারুর বাড়ি গেল হারুকে ডাকতে। হারু হারু..
হারু- রতন আয়।
রতন- আজ উৎসব আছে জেলে পাড়ায়, আসবি কিন্তু। একটু পরেই চলে আসিস, হাবুকে বলা হয়নি এখনও, যাই।
হারু-হাবু নাই রে, জানিস তো রতন
রতন-কেন? হাবুর কি হলো?
হারু- রতন জানিস, রাত হলেই তো শিকার করতে বের হয় মেয়েছেলেটি..
রতন- কে? কার কথা বলছিস?
হারু- তুই তো ছিলিস নে এখেনে। এক মাস আগির রেতে হাবু খুন হলো। পুলিশের কাছে কয়েছে হাবু একটা মেয়ে ওকে কুপিয়েছে ছুরি দিয়ে। তার পর হাবু মরে গেল। তুই তো গেরামে ছিলিস নে, তায় কিছু জানিস নে।
রতন- কি বলছিস! চল তুই আমার সাথে।আজ উৎসব হবেই। মাদুকে ডাকতে যাই।রাজি না হলে তুলে আনবো।
হারু- মাদু কোথায় ?
রতন- ওর বাপের ভিটেতে আবার কোথায়।স্বামীকে খেয়েছে। এবার আমি ওকে খাবো।হা হা হা..
হারু- তুই যা আমি পরে যাব।
রতন মাদু’র বাড়ি গেল। মাদু, মাদু বেরিয়ে আয়। আজ রাতে নাচ, গান, মজলিশ হবে।
মাদু ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। রতন মাদুকে দেখে চোখ ফেরাতে পারলো না। কি সেজেছিস মাইরি বলেই মাদুকে জাপটে ধরতে গেল রতন।
মাদু বললো, এখানে না গঙ্গার ঘাটে চল।আনন্দ ফুর্তি করবো। বাবা ঘুমাচ্ছে এখন।
রতন তো খুশিতে ডগমগ করছে। মাদুর হাত ধরে রতন গঙ্গার ঘাটে গেল। মাদু গঙ্গার জলের দিকে এক পা করে এগোচ্ছে রতনও এগোচ্ছে। তারপর কোমর জল, বুক জল।গলা পর্যন্ত ডুবে গেছে রতনের।
মাদু হেসে বললো, সুরা পান করে নে রতন।
অমৃত সুরা। পান কর। যত পারিস পান কর।
রতন চিৎকার করে বলছে, মাদু বাঁচা, টেনে তোল আমাকে পা মাটিতে আটকে গেছে।
মাদু- আমার বরও বাঁচার জন্য ছটফট করছিল। বাঁচাতে পারিনি। বিষ দিয়েছিলিস। এবার ডুবে মর। থানার বড়বাবুকে টাকা খাইয়ে ছিলিস আমার ওপর অত্যাচার করার জন্য। এইবার মর..
রতন ‘মাদু মাদু্’ বোলে চিৎকার করতে থাকলো। গঙ্গার জল আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে গেল। মাদু ঘরে ফিরে এলো।
হ্যারিকেনটা নিভিয়ে দাও বাবা। আজকের মতো শান্তি আমি কোনদিন পাইনি বাবা।
নিরু-ঘুমা মা, ঘুমা। আমি গান গাইয়ে ঘুম পারিয়ে দিচ্ছি তোকে।
মাদু- হ্যাঁ বাবা, কতরাত ঘুমাই নি। শিকারের খোঁজে এদিক ওদিক ঘুরে বেরিয়ছি।
নিরু- চাঁদ মামা ,চাঁদ মামা ঘুম নিয়ে আয়
মাদু মা’র চোখ যে বন্ধ না হয়,
তুই এলে ঘুম আসবে
আমার সোনার চোখে,
সকাল হলে নিয়ে যাস
ঘুম সোনার চোখ থেকে।।
পরের দিন সকালে রতনের লাশ ভেসে উঠেছে গঙ্গায়। নারায়ণ পুর গ্রামের সবাই ছুটেছে রতনের লাশ দেখতে। হারুও গেছে।
পুলিশ অফিসার অবনী কুমার হারুকে জিজ্ঞাসা করলো, তুমি তো রতনের বন্ধু হও।কিছু জানো তো বলো। তাহলে মৃত্যুর আসল কারণ জানা যাবে ।
হারু- মাদু’কে নিয়ে কাল রাতে উৎসব করবে বলেছেল রতন। আমরা সব বন্ধুরা যাব। রতন মাদুকে ডাকতে গেল। আর এল না, আমরা জেলেপাড়ায় রাত একটা অব্দি ছিলেম। রতন আসল নে। আমরা বাড়ি ফেরে এলাম।
পুলিশ অফিসার অবনী কুমার বললেন, মাদু মানে বিয়ের পর যার স্বামীর রহস্য মৃত্যু হয়ে ছিল। জেলেতেই তো মাদু আত্মহত্যা করেছিল। সে এখানে কি করে আসবে, মাদু তো মৃত।
হারু কাঁপতে কাঁপতে বললো, মাদু বেঁচে নেই? হাবুকেও তো একজন মেয়ে খুন করেছেলো। সেও কি তবে!
পুলিশ অফিসার বললেন, মাদু’র বাড়ি তদন্ত করতে হবে।
গ্রামের কয়েকজন ও হারু পুলিশের সাথে মাদু’র বাড়িতে গেল। দরজা ভেজানো ছিল ।দরজা খুলতেই ভোটকা গন্ধে পুলিশ অফিসার দু’ পা পিছনে চলে এলেন। হারু সামনে গিয়ে দেখলো, নিরু সাহার দেহে পচন ধরেছে। পুলিশ অফিসার থানায় খবর দিলেন। ভ্যানে করে নিরু সাহার পচা মৃতদেহ মর্গে নিয়ে যাওয়া হলো।
পুলিশ অফিসার ভালো করে পরীক্ষা নিরিক্ষা করছেন মাদু’র ঘরের, হঠাৎ ওনার নিরুর বিছানায় চোখ গেল। উনি দেখলেন দু’টো মাথার বালিশই ভেজা, চাদরটাও অগোছালো, হ্যারিকেনটা নিভু নিভু করে জ্বলছে।
“আমার বাবার মৃতদেহ উদ্ধার করুন পুলিশ বাবু, আমার হত্যার প্রতিশোধ আমিই নেবো, নারায়ণ পুর গ্রামে যাবেন কাল সকালে, মাদু আমি”
হারু- আপনি চুপ করে আছেন কেন,
পুলিশ অফিসার অবনী কুমার মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন,আর কোন ভয় নেই শিকারী সফল হয়েছে তার কাজে, আপনারা কেউ এখানে আর থাকবেন না। সবাই চলে যান।
হারু বললো, রতনের মৃত্যু রহস্য কি! সেইটে জানবেন নে অফিসার?
পুলিশ অফিসার- রতন, হাবু মাদুকে জ্বালাতন করতো তাই না হারু?
হারু-হ্যাঁ, হাবু ও রতন মাদু’র শ্বশুর বাড়ি পর্যন্তু গেছেলো। কি কাণ্ড বাদেয় ছেল ওরা ওখানে সেইটে জানতে পারিনে এখনও।তারপর তো রতন এই গাঁ ছেড়ে পায়লে গেল। তারপর হাবু খুন হল এক মেয়েছেলের হাতে। মরার আগেই তো হাবু বলেছেল।
পুলিশ অফিসার ঠিক আছে বলে চলে গেলেন।
নারায়ণ পুর থানায় গিয়ে পুলিশ অফিসার অবনী কুমার জানতে পারলেন গতকাল রাতে থানার বড়বাবুকে নর্দমার মধ্যে পড়ে থাকতে দেখেছে স্থানীয় লোকজনেরা।
পুলিশ অফিসার অবনী কুমার থানার থেকে বেরিয়ে বড়বাবুর বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। বড়বাবুর বাড়ি গিয়ে জানতে পারলেন গতকাল রাতে একটি মেয়ে না কি বড়বাবুকে ডেকে নিয়ে গেছে। ভোরবেলায় নর্দমার জলে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন বড়বাবু।
পুলিশ অফিসার অবনী কুমার আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার তদন্ত শেষ মা, তোমার আত্মা শান্তি পাক। আকাশের ওপর দিয়ে একটা বাজ পাখনা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে গেল। অবনী কুমার আকাশের দিকে তাকিয়ে টুপীটা মাথা থেকে খুলে আবার মাথায় পড়ে নিলেন।