ব্যাগের জন্মদিন
-সঞ্চিতা রায় (ঝুমকোলতা)
“মিস্ তোমার জন্য বাদামের প্যাকেট আর বিস্কুটের প্যাকেট এনেছি।”
“কেন তুই নিজে না খেয়ে আমার জন্য আনলি?”
মিমিতা মিস জানে সায়কের বাবা রোজ তাকে জলখাবার খাওয়ার জন্য কুড়ি টাকা করে দেয়। সেই কুড়ি টাকা থেকে বাঁচিয়ে সায়ক তার নানা রকম ইচ্ছা পূরণ করে। কিন্তু সায়কের তো পুষ্টি দরকার। তাই মিমিতা মৃদু ধমকের সুরে বললেন, “তুই কিন্তু খাবি ঠিক করে”।
ব্যাগে স্টিকার দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে। মিমিতা যখন বিস্কুট আর বাদাম নিজে খেলো আর ভাইঝি মোনালিকে দিল, অপূর্ব এক আনন্দে সায়কের মুখ ভরে উঠলো। মিস ভাবছেন সত্যি কত ছোট ছোট কিছুর মধ্যে দিয়ে আনন্দ খুঁজে নিতে পারে এরা। “মিস একদিন আমাদের বাড়ি যাবে?”
“মিস্ তুমি এসেছো,দেখো বাগানে কত ফুল গাছ করেছি”। ছোট্ট ছোট্ট টবকে ভালবাসা দিয়ে কি সুন্দর করে সাজিয়েছে সায়ক। অবাক দৃষ্টিতে দেখছেন মিমিতা।
“এই রোদে কোথায় যাচ্ছিস?”একদিন মিমিতার বাড়ির সামনে দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল সায়ক।
“দুপুরের খাবার আনতে যাচ্ছি মিস, মা তো আমাদের সাথে থাকে না, তাই দুপুরের খাবারটা কিনে আনি। জানো মিস মাঝেমধ্যে বাজার করে রান্নাও করি আমি।” মিমিতা জানতে পারেন, হ্যাঁ সত্যিই সায়কের মা ওর বাবাকে ছেড়ে অন্য একজনের সাথে চলে গেছে। সঙ্গে নিয়ে গেছে সায়কের একমাত্র বোনকে। এই বোন সায়কের সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই একটা শূণ্যতা সৃষ্টি হয়েছে। ও পাশের বাড়ির ছোট্ট মেয়েটার মধ্যে হয়তো বোনকে খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। সায়কের অষ্টম শ্রেণী আর পাশের বাড়ির মেয়ে বৃষ্টির ষষ্ঠ শ্রণী। কাজে কাজেই সমাজ ভাই-বোনের একটা পবিত্র সম্পর্ক নিয়ে গল্প তৈরী করতে ছাড়েনি। এটা যে আমাদের সমাজের পরিচিত চিত্র। সায়কের বাবাও তার প্রথম স্ত্রী (সায়কের মায়ের আগে যাকে বিয়ে করেছিল) তার কাছে আবার যাতায়ত শুরু করেছে। মাঝে মধ্যেই ঘরে ফেরে না। এ হেন অবস্থায় সায়ক সঙ্গ দোষে পরে কিছু খারাপ গালাগালি শেখে। মিমিতার অন্য ছাত্রছাত্রীরা ওর সঙ্গে পড়তে চায় না। বলে, মিস্ ও খারাপ কথা বলে ওকে আমাদের ব্যাচে নেবে না। এটা তো স্বাভাবিক। অভিভাবক অভিভাবিকারাও তাদের ছেলে মেয়েদের এই ব্যাচে রাখতে চান না। পরিবেশের প্রভাবে একজন ছেলের কি পরিণতি হতে পারে ওকে দেখে মিমিতা বোঝেন। তবু নিজেও মাঝে মধ্যে ধৈর্য্য হারিয়ে সায়ককে প্রচণ্ড বকেন। এভাবেই এসে পড়ে সরস্বতী পুজো। মিমিতা বাড়িতে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে পুজো করেন। অবাক বিস্ময়ে মিমিতা ছোট্ট সায়কের ফল কাটা দেখে। ঠাকুর ঘরটা অবশ্য সবাই মিলে সাজায়। সায়কের সৃজনক্ষম মনটা সবাইকে আকৃষ্ট করে। খিচুড়ি রান্নাটা অনেকটা সায়কই করে। মিমিতা ভাবেন পরিবেশ পরিস্থিতি যেমন মানুষকে খারাপ গুণ দেয় তেমনই অনেক অনেক কিছু শিখিয়ে নেয়, যা নাকি ব্যবহারিক জীবনের অনুকূল। “মিস আমার কাছে কিছু পুরানো বই আছে তুমি একটু নেটে দিয়ে দেবে, যদি কেউ কেনে। আমি তাহলে প্রশ্নবিচিত্রাটা কিনবো ওই টাকায়।” মিমিতা দেখেন নীচু ক্লাশের কিছু বই। সে সায়কের কাছে কটা দিন সময় চায়। কিন্তু বই কেনার কাউকে জোগাড় করতে না পেরে অর্দ্ধেক দামে নিজেই তিনটে বই কিনে রাখে। সায়ক এলে বলেন “তোর বই বিক্রি হয়ে গিয়েছে নে টাকা” সায়ক তার পরের দিন প্রশ্নবিচিত্রা কিনে এনে হাসি মুখে বলে, “মিস এই দেখো কিনেছি,আমি একটু একটু উত্তর করার চেষ্টা করবো।” না, সায়ক পড়াশোনায় একেবারেই ভালো নয়। হয়তো ওকে কোনোদিনও সেভাবে পড়াশোনায় মনোযোগী করা যাবে না। তবুও প্রশ্নবিচিত্রা হাতে তার মুখের হাসি মিমিতার মনকে ভীষণ ভীষণ খুশি আর ভালোলাগায় ভরিয়ে দিল।ওর হাতে একটা ড্রইং খাতা আর পেন্সিল দিয়ে বললো “এটা তোর ব্যাগের জন্মদিনের উপহার তোর ব্যাগের হয়ে তুই এতে আঁকিস এবার।” সায়কের মুখে খুশির হাসি। মিমিতা ঈশ্বরের কাছে কামনা করে বললেন, “হে ঈশ্বর তুমি ওর মধ্যে যে গুণগুলো আছে সেগুলোকে পূর্ণতা দিও।