গল্প- কেন না মানুষ

কেন না মানুষ
– সুনির্মল বসু

 

 

স্টেশন রোডের পাশে তাঁর বিরাট মুদির দোকান। রমরমা ব্যবসা। ইন্দ্রধনু সিনেমার পাশে বিরাট হার্ডওয়ারের দোকান। শহরের কেন্দ্রস্থলে পরিপাটি মিষ্টির দোকান। তিনি বীরেন সামন্ত। এই অঞ্চলের নামকরা ধনী মানুষ। তাঁর স্ত্রী কল্যাণী দেবী সারা জীবন ঘর সংসার নিয়েই মেতে থেকেছেন।

ছেলে সৈকত চাকরি সূত্রে আমেরিকায় আছে গত পাঁচ বছর। সেখানেই ভালোবেসে বিয়ে করেছে অনামিকা নামের একটি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার মেয়েকে। একমাত্র মেয়ে অঞ্জলি বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে দিল্লিতে থাকে। ওদের একমাত্র ছেলে তুতাই।

সারা জীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন বীরেন বাবু।এখন তাঁর ঝাড়া হাত পা। তবুও পুরনো অভ্যেস বশতঃ তিনটি দোকানের কোনো একটিতে এসে বসেন। খোঁজখবর নেন। বাকিটা কর্মচারীরাই দেখাশোনা করে।

সকালে দুর্গা ভান্ডারে নিজের মুদির দোকানে এসে গদিতে বসেছেন। পুরনো বন্ধু শ্যামল দোলুই এসে সামনে বসল। মাক্স খুলতে তাঁকে দেখে বীরেন বাবু হাসলেন।তারপর বললেন, দ্যাখ্ শ্যামল, আগে গরুরা মুখোশ পরতো, এখন মানুষ পরছে।
শ্যামল বাবু হেসে বললেন, আগে মানুষের মুখটাই মুখোশ ছিল। তার উপর এখন মুখোশের ওপরে মুখোশ।
বীরেন বাবু বললেন, আম্ফান ঝড় এলো, অতি মারী এলো, মানুষ কিছু শিখলো না।
শ্যামল বাবু দুঃখ করে বললেন, অন্যকে কি বলবো, আমার মায়ের আঁচল ধরা ছেলে অরুনাভ, বিয়ের পরদিনই বউ নিয়ে ফুটে গেল।
বীরেন বাবু বললেন, চারদিকে এত অন্যায় বেড়েছে, এসব খুঁজে বের করতে গেলে, কম্বলের লোম বাছা হয়ে যাবে।
একজন মুদি দোকানের কর্মচারী ওদের সামনে দু’কাপ চা রেখে গেল। ওরা চা পান করায় মনোনিবেশ করলেন।
শ্যামল বাবুর মাসিক জিনিসপত্র গোছানো হলে, তিনি সেসব নিয়ে রিক্সা করে বাড়িমুখো হলেন।

বীরেন বাবু, বন্ধু শ্যামলের কথা ভাবছিলেন। ওরা এক ইস্কুলে একসঙ্গে পড়তেন। শ্যামল বাবু রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ থেকে গত ছয় বছর আগে অবসর গ্রহণ করেছেন।

একটু বেলার দিকে নিজের অ্যাম্বাসেডর চেপে বীরেন বাবু বাড়ি ফিরলেন। কল্যাণী দেবী তখনো না খেয়ে বসে আছেন। পুরনো দিনের অভ্যেস।আজকাল বাবা-মার কথা খুব মনে পড়ে বীরেন বাবুর। তাঁর বাবা ছিলেন প্রাইমারী‌ স্কুলের শিক্ষক।মায়ের রঙ ওঠা মেটে শাড়ির কথা আজও একটুও ভুলতে পারেন না তিনি। অথচ কি শান্ত সমাহিত মায়ের মুখটা। বড় মায়াময়, কত যে করুণ। সংসারের জোয়াল টানতে টানতে বাবা একদিন অকালে চলে গেলেন। তারও পাঁচ বছর পর মা।

বীরেন বাবু পড়াশোনায় ভালো ছিলেন না কোনোদিন।প্রথমদিকে চাকরীর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে, তিনি খিদিরপুর থেকে মাল এনে, দোকানে দোকানে সাপ্লাই দিতেন। তারপর একদিন তাঁর নিজস্ব মুদির দোকান হল। একটি দোকান থেকে তিনটি দোকান।বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী, বীরেন বাবু জীবন দিয়ে তা প্রমাণ করেছেন।

এভাবে উঠে আসার পথটা কিন্তু সহজ ছিল না। প্রতি পদক্ষেপে পা হড়কে যাবার ভয়। সংসার তো নয়, যেন মানুষের জঙ্গল। চারদিকে হায়েনার থাবা, চারদিকে বাঘ ভাল্লুক। নাহ্, কথাটা বোধহয় ভুল বললেন।মানুষ পশুদের থেকেও, অনেক বেশি হিংস্র, অনেক বেশি স্বার্থপর। কেউ কাউকে এক তিল জায়গা ছাড়ে না।

চারদিকের এই ভয়ংকর পরিবেশ বীরেন বাবুকে আত্মরক্ষার উপায় বুঝে নিতে সাহায্য করেছিল।তিনি পারতপক্ষে কারো উপকার করার জন্য এগিয়ে যেতেন না। বরং চারপাশের এই পরিবেশ তাঁর মধ্যে একটা নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করে দিয়েছিল।

বাড়ি ফিরে স্নান সেরে তিনি খেতে বসলেন। কল্যাণীদেবী বলছিলেন, পাঁচ বছর হয়ে গেল, ওরা প্রতিদিন ভিডিও কলে কথা বলে, কিন্তু এদেশে ফিরবার নাম গন্ধ করে না।তিনি ছেলে, ছেলে বউয়ের প্রসঙ্গে কথা বলছিলেন।
বীরেন বাবু বললেন, যুগের হাওয়া। আমি মা বাবার কষ্ট দেখেছিলাম। পাশে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছিলাম।এখনকার ছেলেরা বলে, বউ আমার সম্পত্তি নয়, সম্পদ।
কল্যাণী দেবী বললেন, ওরা দেশে না ফিরলে, আমাদের অবর্তমানে এই বিষয় সম্পত্তি কে দেখবে!
-জানিনা, বলতে পারব না। বীরেন বাবু খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে গেলেন।

পরদিন ভোরে বোমার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ব্যালকনিতে এসে দেখলেন, দুই যুযুধান পক্ষ লুটের মালের বখরা নিয়ে সকাল সকাল রাস্তায় নেমে পড়েছে।
এ পাড়ার ল্যাংড়া বিজন বোমের থলি হাতে দৌড়াচ্ছে। ওদিকে দীপ্তেন ওর দেশী রিভলবার উঁচু করে ছুটে আসছে।
-আয় শুয়োরের বাচ্চা, আজ সব কটাকে মায়ের ভোগে পাঠাবো,
অন্যদিকে হাবুল পাইপ গানের নল উঁচু করে বলছে, শালা, এমন পেটাই করবো, ছবি তুললে, নেগেটিভ আসবে না।
একটু বাদে পুলিশ ভ্যান এসে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে রাস্তা শুনশান।
ওসি সুবর্ণ সরকার একজন পথচারীকে জিজ্ঞাসা করলেন, যারা এসেছিল, তাদের চেনেন?
কারো মুখে কোনো উত্তর নেই। বিরক্ত ওসি বললেন, শাল্লা, পাবলিক আজকাল ভারি সেয়ানা হয়ে গেছে। কিছুতেই মুখ খুলতে চায় না।

এসব ঘটনায় অন্য অনেকের মতো মন খারাপ হয় বীরেন বাবুর। কিন্তু করার কিছুই থাকে না।পরদিন বীরেন বাবু তাঁর মিষ্টির দোকানে গেলেন।সকাল থেকে দোকানে ভিড়। আজ জামাই ষষ্ঠী।বেচাকেনা চলছিল। এই দোকানটা তাঁর ভাইপো তিতাস দেখাশোনা করে। দেখতে দেখতে বিকেল হয়ে গেল। পাঁচটা নাগাদ আকাশ জুড়ে মেঘ। ছটা নাগাদ বীরেন বাবু বাড়িতে ফিরবার জন্য গাড়িতে উঠে বসলেন। ড্রাইভার সুপ্রিয় গাড়িটা স্টার্ট দিল।

তিনি ফিরে যাবার পর, একটি অল্প বয়সী তরুণী দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো। তখন প্রবল ভাবে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মেয়েটিকে দেখে ক্ষুধার্ত মনে হচ্ছিল। সে কাঁচের মধ্যে মিষ্টির দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়েছিল। তিতাস সেটা দেখে বিরক্ত হলো। বললো, আপনি সরে দাঁড়ান, বিক্রি-বাট্টার সময় ঝামেলা করবেন না।
মেয়েটি একপাশে সরে গিয়ে দাঁড়ালো। তাঁর চলে যাবার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না।তখন বৃষ্টির দাপট আরো বেড়েছে। রাত এগারোটায় দোকান বন্ধ হলো। স্বভাবতই মেয়েটিকে বাইরে বেরিয়ে যেতে হলো। পরদিন সকালে দেখা গেল, উল্টোদিকে ল্যাম্পোস্টের নিচে মেয়েটি মৃত পড়ে আছে।
সকালে দোকান খুলতে এসে, তিতাস ফোনে বীরেন বাবুকে এ কথা জানালো। থানা থেকে পুলিশ এলো। ওরা জিজ্ঞাসাবাদ করে ডেড বডি থানায় নিয়ে গেলেন। প্রতিদিন খবরের কাগজ খুটিয়ে পড়া বীরেন বাবুর চিরকালের অভ্যাস। অতিমারীতে মৃত্যুর খবর পড়তে পড়তে তাঁর মনে হতো, ক্রমশ খালি হয়ে যাচ্ছে চারপাশ। মানুষের হাতে কাজ নেই, ঘরে খাবার নেই।
মানুষের বড় কষ্ট। বীরেন বাবু ভাবলেন, একটু খাবার পেলে মেয়েটা বেঁচে যেত। এর পরেই তাঁর মনে হলো, কত কষ্ট করে তিনি ছেলেকে মানুষ করেছেন, এত বিষয়সম্পত্তি করেছেন, সেই ছেলে বাড়িতেই ফিরতে চায় না।

তিনি দোকানে গেলেন। তিতাসকে রীতিমত বকলেন।
-ওকে খাবার দিস নি কেন?
-দোকানে অনেক খদ্দের ছিল,
-তাতে কি হয়েছে, দেবার ইচ্ছে থাকলেই, দেওয়া যেত।
-কাকামনি, মেয়েটা না খেয়ে মারা যাবে, আমি বুঝতে পারিনি।

রাতে বীরেন বাবু বাড়ি ফিরলেন। স্ত্রী কল্যাণী দেবীকে বললেন, তোমার লায়েক ছেলে তো আর এদেশে ফিরবে না।
কল্যাণী দেবী বললেন, মানুষ কি করে এত অমানুষ হয়ে যায়!
বীরেন বাবু একটুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, শুনেছো তো, আমার দোকানের সামনে একটি মেয়ে না খেয়ে মারা গেছে। একটু খাবার পেলে,ও মরতো না। আমরা সেই খাবারটুকু ওকে দিতে পারিনি।
-সেকি, এতো ভারি অন্যায়। তুমি একটা কিছু করো।
-করবোই তো, না হলে লোকে বলবে, ছেলেটাই শুধু আমানুষ না, বাপটাও অমানুষ।

পরদিন বীরেন বাবু অভাবী মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। বললেন, যতক্ষণ আমার কাছে খাবার আছে, ততক্ষণ আপনারা আমার কাছে খাবার পাবেন। জীবনভর টাকা টাকা করে গেছি। আমাকে আপনাদের পাশে দাঁড়িয়ে একটু কাজ করতে দিন।
টাকা আগে না, মানুষ আগে, আমি বুঝতে পেরেছি।
আজ অনেকদিন বাদে বীরেন বাবুর মনে হল, তাঁর বাবা-মায়ের শিক্ষা তিনি কাজে লাগাতে পেরেছেন।
গভীর রাতে বিছানায় শুয়ে মনে হল, দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করায় এত আনন্দ, কোনোদিন জানা ছিল না।

সকালে তাঁর বাড়ির সামনে বসিয়ে লোকজন খাওয়ানো হচ্ছিল। বীরেন বাবু টানা বারান্দার কিনারায় দাঁড়িয়ে ওদের খাওয়া দেখছিলেন। বরাবর লড়াকু কড়া ধাঁচের মানুষ তিনি। মা বাবা মারা যাবার পর, এতোবছর তাঁর চোখে কখনো জল আসেনি।

আজ এই দৃশ্যপটের সামনে দাঁড়িয়ে কাঠফাটা দুপুরে তাঁর দুচোখে শ্রাবণ দিনের মতো বর্ষা ধারা নেমে এলো।

Loading

Leave A Comment