একটি ভূতুড়ে রাতের গল্প
-সুনির্মল বসু
তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি।বিকেল সাড়ে চারটেয় ক্লাস শেষ হয়ে গেছিল। কিন্তু বন্ধু নিখিলেশের জন্মদিন থাকায়, আমরা বন্ধুরা ওর লেকটাউনের বাড়িতে হইহই করে সবাই উপস্থিত হয়েছিলাম। তার আগে কলেজ স্ট্রিট থেকে ওর জন্য কিছু জন্মদিনের উপহার কিনেছিলাম।
আমি, কাবেরী, অনিন্দিতা, সুশোভন সকলেই আমন্ত্রিত হয়ে ছিলাম। একসময় ওদের বাড়িতে পৌঁছলাম। কেক কাটা হলো। হইচই হলো। ভালো খাওয়া দাওয়া হলো। তারপর ফেরার তাড়া।
ফিরতে ফিরতে শিয়ালদা থেকে লাস্ট ট্রেন ধরলাম। ফিরতে দেরী হবে, সেটা মাকে জানিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এতটা দেরি হবে, নিজেও বুঝতে পারিনি। ফলে, স্টেশনে যখন নামলাম, রিক্সা স্ট্যান্ডে কোনো রিক্সা নেই। অথচ, স্টেশন থেকে আমাদের বাড়ি প্রায় চার মাইল। উপায় নেই, ট্রেন থেকে যারা আমার সঙ্গে স্টেশনে নামলেন, তাদের মধ্যে পরিচিত মুখ একটাও দেখতে পেলাম না।
অগত্যা হাঁটা শুরু করলাম। জ্যোৎস্নার রাত। ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। শীতের শুরু তখন। আমাকে ধানক্ষেতে ছাড়িয়ে একটা বড় জলা পেরোতে হবে। জায়গাটা ভারী নির্জন। আমি ভীতু না হলেও, বারবার মনে হচ্ছিল, কেউ একজন সঙ্গে থাকলে, ভাল হতো। কথা বলতে বলতে হাঁটতে হাঁটতে ঠিক বাড়ি পৌঁছে যেতাম।
ধান জমি পেরিয়েছি, সামনে জলা। বাঁদিকে বিরাট একটা অশ্বত্থ গাছ। গাছের পাশ দিয়ে আমাদের পাড়ার মধুদা বেরিয়ে এলো।
আমার মনে একটু সাহস এলো। যাক, মধুদার সঙ্গে গল্প করতে করতে বাড়ি চলে যেতে পারবো।
ডাক দিলাম, মধুদা, ও মধুদা..
মধুদা পিছন ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে দেখলেন না। বরং আশ্চর্য লম্বা লম্বা পা ফেলে, খুব দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগলেন।
মধুদার এই ব্যবহার আমার অদ্ভুত মনে হলো। এমনিতে উনি আমাকে ভালোবাসেন। আমি লিখিটিখি বলে আমাকে বেশ খাতির করেন। তবে উনি খুব ব্যস্ত মানুষ। সক্রিয় রাজনীতি করেন। কিন্তু তা বলে, আমার ডাকে সাড়া দেবেন না, আমি ভাবতেই পারছিনা।
আমিও দ্রুত ওনার পেছন পেছন এগিয়ে চললাম। বাঁদিকে একটা মজা পুকুর, কচুরিপানায় ভর্তি। পাশে একটা ডুমুর গাছ। হঠাৎ দেখি, মধুদা খুব দ্রুত ওই ডুমুরগাছের ঝোপের দিকে এগিয়ে গেলেন। আর তাঁকে দেখতে পেলাম না।
এবার আমার গা ভারী হয়ে গেল। জীবনে প্রথমবার এমন অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছি। মনে হলো, নিখিলেশের জন্মদিনে হাজির হয়ে রাত করা আমার উচিত হয়নি। কিন্তু এখনো বিরাট জলা পেরুতে হবে। আমি দ্রুত পা চালিয়ে দিলাম। মনে হচ্ছিল, আমি আর হাঁটছি না, আমি প্রাণপনে দৌড়াচ্ছি।
আমি খুব শিব ঠাকুরের ভক্ত। মনে মনে ঠাকুরকে বলছিলাম, জয় মহাদেব, ঠাকুর এই বিপদ থেকে আমাকে রক্ষা করো। আমার জন্য একটা কিছু করো। জলার উপর তখন রাতের স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না। হঠাৎ সামনে দেখি, একটা ধবধবে সাদা কুকুর। গায়ের উপর রাতের জ্যোৎস্না যেন তাঁর পিঠের উপর পিছলে যাচ্ছে। আমার ভালো লাগলো, অন্তত একজন আমার সঙ্গে তো আছে। আমি মনে মনে একটু সাহস পাচ্ছি। কুকুরটি আগে, আমি পিছনে চলতে শুরু করলাম।
ওর কাছে আজ আমি বড় কৃতজ্ঞ। এই দুঃসময়ে একজন বন্ধু অন্তত কাছে পেলাম।
তারপর একসময় বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। কুকুরটা তখন আমাদের লোহার গেটের পাশে দাঁড়িয়ে। ভেতরে ঢুকতে মা বললেন, বাবু, তুই আজকাল যা আরম্ভ করেছিস না..
বললাম, সব বলছি। তার আগে তুমি বাইরে আমার সঙ্গে আসা কুকুরটাকে একটু কিছু খেতে দাও। মা ওর জন্য খাবার নিয়ে বাইরে এলেন। কুকুরটাকে ডাকাডাকি খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন। কিন্তু কোথাও আর কুকুরটাকে পাওয়া গেল না। পরে আমি আমাদের গ্রাম ছাড়াও, আমাদের আশপাশের দশটা গ্রাম খুঁজেও, সেই কুকুরটাকে কখনো দেখিনি। কি উজ্জ্বল সাদা তাঁর গায়ের রঙ।
অনেককে বলেছিলাম, ওর কথা। সবাই বলল, তারা কেউ ওরকম চেহারার কুকুর এই তল্লাটে কখনো দেখে নি। সেই বিপদের দিনে কে আমাকে উপকার করতে এসেছিল, আজও তার উত্তর পাইনি।
বাড়িতে মায়ের কাছে মধুদার আশ্চর্য ব্যবহারের কথা বলতে, মা বললেন, দিন সাতেক আগে জলার পাশে ডুমুর গাছের জঙ্গলে মধুদা খুন হয়ে গেছেন। কী আশ্চর্য, আমি এসব কিছুই জানতাম না।
সেই ভূতুড়ে রাতের কথা ভাবলে, আজও ভয়ে শরীরে শিহরণ জাগে। আর কখনো অত রাত করে, আমি জলা পেরিয়ে বাড়ি ফিরি নি।