দর্পণে আত্মারাম
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়
অন্তেষ্টিক্রিয়া শেষ করে ফিরেই, দাঁতে নিমপাতা কাটো, আগুনের তাপ নাও, লোহা স্পর্শ করে বিশুদ্ধ হও। জানাই তো আছে নিশ্চিত, অতৃপ্ত আত্মা ঘুরঘুর করছে এখনো, এখানেই আশপাশে। এইতো ছিল আপনজনের দেহ। ভালোবাসার আকুল প্রত্যাশায় মোড়া। তাহলে! সেই দেহস্থ আত্মা অতৃপ্ত, বোঝা গেলকীভাবে?
এইতো কথার মতো কথা।
আরে বাবা, নিজের সঙ্গে ধাপ্পাবাজি চলে না। নিজের লোক। রক্তের সম্পর্ক। কোথায় ছিলে বাপধন? কাজ গুছিয়ে সরে পড়েছো। এখন রেড সিগনাল দপদপ করছে। অনুশোচনা?
পাপী শরীর। জ্ঞানপাপী মন।
কর্তব্যনিষ্ঠার পাঠ মুখস্থ, কন্ঠস্থ, মগজস্থ। শুধু পালনের অনীহা।
জীবিতকে ভয় নেই। সে বাৎসল্য বোধে মৃয়মান। কিন্তু, মৃত ভয়ানক। জীবিতের লৌকিক। মৃতের অলৌকিক।
ক্ষমতা বড়ো লোভনীয়। শুধু নিজের জন্যে। অন্যের ক্ষমতা ঈর্ষণীয়। কর্তব্যপালন-ধর্ম, নিজের প্রতি। অন্যের প্রতি বর্জনীয়। অন্ধকার মনে সাপের বাসা। দেহ পুড়লেই স্মৃতি বিলুপ্ত নয়। দেনা পাওনার হিসেব, চুটকি মেরে নিকেশ হয়ে যায় না।
অশৌচ দেহ, অশৌচ মন।
ভেক ধরো, সাজো। নিখুঁত অভিনয়ে প্রমাণ করো তোমার কর্তব্যপরায়ণতা।
মালসায় হবিস্যি রাঁধো। মুখ ব্যাজার করে ঘি মাখিয়ে আলো চাল সেদ্ধ ঢোঁক গিলে নাও। মাত্র তো ক’টা দিন। খোঁচা খোঁচা চুল দাড়ি, হাঁটু পযন্ত ট্যাঁং টাঁং করা জ্যালজেলে ধুতি, উত্তরীয়র, গলায় ঝুলোনো লোহার চাবি। বগলে কুশাসন। লোকাচার শেষ। তারপর..
তন্ত্রধারকের দুর্বোধ্য দেবপুঁথি উচ্চারণকে আরও দুর্বোধ্য ক’রে হয়ে যাও শুচি শুদ্ধ।
বিগ সাইজ পারশে মাছ সহযোগে সবান্ধবে সেরে ফ্যালো অন্তিম কর্ম।
আহা.. উনি পারসে বড্ড ভালোবাসতেন। ব্যস। নিশ্চিন্দি। আর ভয় নেই। ভাবনা নেই। ঝাড়া হাত পা। আত্মা তৃপ্ত। পরমাত্মার জয়জয়কার কেত্তন। বুক ফুলে ছাপ্পান্ন ইঞ্চি।
কোথাও কী কোনও ফাঁক রয়ে গেল? দ্যাখনদার লোকাচার কেরামতিতে? মন মোমবাতি বাতাসে দুলছে। সারারাত বিনিদ্র এপাশ ওপাশ।
অর্ধাঙ্গিনীর শাস্ত্রসম্মত সাবধানী উপদেশ, বাৎসরিক কাজে পুষিয়ে দেওয়া যাবে ‘খন। গয়া কিংবা হরিদ্বার। একটু বেড়ানোও হয়ে যাবে। ঘুমোও দেখি। যথেষ্ট করেছো, আবার কী!
মৃত বড়ো ভয়ংকর। জীবিত নিরীহ। বাৎসল্য বোধে টইটম্বুর।
কোথায় যেন মন্দ বাতাস বইছে। কে যেন কু গাইছে। একটা খিকখিক তাচ্ছিল্য হাসির শব্দ। ফিসফিস করে, কানের পাশে পরিচিত কন্ঠ, শ্রদ্ধাহীন শ্রাদ্ধ- হায় রে গর্ভজাত আদরের সন্তান আমার, হায়..
কে! কে? ও.. তু…মি.. বিশুদ্ধ আত্মা!