খেয়ালীর মন
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
বেশি কিছুর চাহিদা ছিল না জীবনে, তবুও যা পেয়েছি তাই আমার কাছে অনেক বেশি মনে হয়।
– কি যে বলো বৌদি? তুমি আবার পেলে কি? নিজের এতো ভালো কেরিয়ার তা’ও অবহেলা করে দূরে সরিয়ে রাখলে।
-শোন ভূমি ( ভূমিকা) কেরিয়ার গড়া এতো সহজ ছিল না। আমাদের মতো ছাপোষা মধ্যবিত্তের ঘরের বউ-এর দিনরাত গান নিয়ে মেতে থাকা সম্ভব ছিল না। আর তুই তো জানিস আমার গান করা নিয়ে তোর মায়ের কত আপত্তি।
-ছাড়ো তো মায়ের কথা। তোমার কোন বিষয়টা নিয়ে আপত্তি করে না সেটা তুমি এতদিনেও কি বুঝে উঠতে পেরেছো? নিজে যেমন করে জীবন কাটিয়েছে তোমাকেও সেই ধারাতে ফেলতে চায় সারাক্ষণ।
-ছাড় না ভূমি। আর পুরানো কথার কাসুন্দি নিয়ে বসতে হবে না তোকে। আগে বল তোর নতুন ফ্ল্যাট কতদূর? হ্যাঁ রে ভূমি তোর দাদা বলছিল ওখানকার পরিবেশটা বেশ ভালো।
-এখনও প্রোমোটারদের অনেক টুকিটাকি কাজ বাকি আছে। তবে আমি বলে দিয়েছি রথের দিন পূজোটা সেরে নেবো। আমার ফ্ল্যাটটা মোটামুটি রেডি। কারেন্টের কাজও হয়ে গেছে। কাঠের মিস্ত্রিও একজন লেগেছে।
-বাঃ বেশ ভালো খবর। নিজের ফ্ল্যাট পাচ্ছিস। নিজের মনের মতো করে সাজিয়ে নিস। হ্যাঁ রে তোর পেন্টিং-এর জন্য একটা কোণা কিন্তু ফাঁকা রাখিস।
-হ্যাঁ গো বৌদি তুমি কি ধারায় তৈরি বলবে একটু? আমার শখ নিয়ে কত মাথা ব্যথা।আর নিজের শখের বেলায় উদাসীন।
ভূমি অভিযোগের সুরে বলে, তোমাকে কত করে বললাম, বৌদি আমাদের কমপ্লেক্সে একটা টু বি এইচ কে বুকিং করো। কতদিন এই ঘুপচি ঘরে কাটাবে?
মুখে একটা চওড়া হাসি দিয়ে খেয়ালী বলে, সে কি রে তোর নিজের বাপের বাড়ি তোর কাছে ঘুপচি লাগছে আজকাল। আমি তো জানতাম সব মেয়েদের কাছেই তার বাপের বাড়ি রাজপ্রাসাদ মনে হয়।
-দেখো বৌদি বাস্তবজগত আর কল্পনার জগতের মধ্যে বিস্তর ফারাক। তোমার ঘরের দক্ষিণ দিকের জানালাটা খুলে দিলেই দেখতে পাওয়া যায় মেজু জেঠুর ঘর। সারাদিন চলছে ওদের পারিবারিক নাটক। কখনও জেঠিমা বৌদিকে গালমন্দ করছে আবার কখনও নেপালদা মদ খেয়ে এসে নিজের মা বাবার গুষ্টি উদ্ধার করছে। এই তো গেল দক্ষিণ দিকের গল্প। আর পূর্ব দিকে রেশন দোকান। সারাদিন পাঁচিলের পাশে চলছে মুত্র বিসর্জন। পশ্চিম দিকে মধূ গয়লার ঘর। গোবরের গন্ধে একেবারে গা গুলিয়ে আসে। এই জানলাটা তো কোনদিনই খোলা হয় বলে মনে হয় না। আর রইলো উত্তর দিক। যদিও এতকাল হাওয়া বাতাস আসতো এখন তো দেখছি হাবুল কাকু দোতলা তুলছে। এই দমবন্ধ পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আমাদের কমপ্লেক্সে একটা ফ্ল্যাট বুক করলে কি ক্ষতি হতো। বরং গলা ছেড়ে একটু গানের রেওয়াজ করতে পারতে।এই বাড়িতে বসে শুধু হারমোনিয়ামের রিডগুলোতে হাত প্র্যাকটিসটাই হয়। গলার আওয়াজ তোলার জো নেই পাঁচ জনের কথা ভেবেই।
খেয়ালী রসিকতা করে বলে, বুঝলি ভূমি আমি যদি এখন গলা ছেড়ে গান গাই তাহলে মধূ গয়লার গরুগুলোও বিরক্ত হবে।
তার থেকে ভালো যেমন আছি তেমনই থাকি।
-এই তো সারাক্ষণ বিজ্ঞের হাবভাব। এইজন্যই মাঝে মাঝে অসহ্য লাগে তোমাকে। টুবাই-এর সাথে ফোনে কথা হয় মাঝেমধ্যেই। ও তো পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে আমাকে যে ও অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরেও কলকাতার নিউটাউন, রাজারহাট এইসব অঞ্চলে ফ্ল্যাট কিনে থাকবে।
-এতো ভালো খবর দিলি আমাকে। তোরা পিসি, ভাইপো কাছাকাছি থাকবি। যাক বাবা আমার একটা বড় চিন্তা মাথা থেকে চলে গেল।
টুবাই-এর থাকা নিয়ে মাঝে মধ্যেই চিন্তা হতো। মাঝে মধ্যেই তোর দাদাকে বলি দুতলা’টা বানিয়ে ফেলতে। কিন্তু তোর দাদা বলে, তোমার সাহেব ছেলে আমাদের এই গ্ৰামে এসে কোনদিনই থাকবে না। ফালতু পয়সা খরচ করে লাভ নেই।
তা এখন দেখছি তোর দাদার কথাই ঠিক। দেখছিস খোলামেলা কথাবার্তার মাধ্যমে কত সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
অনেক ক্ষণ হলো গাল গল্প। মৈনাককে চা দিতে হবে, মা কিছু খায় কিনা দেখি।
এই বলে দুজনে রান্নাঘরে ঢুকলো। রান্নাঘরে ঢুকেই ভূমি বলে ওঠে, সাবাস সাবাস, এই নতুন ব্যবস্থাটা কবে হলো গো?
-আর বলিস না তোর দাদার শখ। এই তো অক্ষয় তৃতীয়াতে জিনিসটা ঘরে ঢুকালো।
-এতদিনে একটা আমার মনের মতো কাজ করেছে দাদা। কত দাম পরলো এই ডিশ ওয়াশারটার তা কিছু জানো তুমি?
-কি জানি পঁচিশ না হলে ত্রিশ হাজার হবে মনে হয়। ফোনে টুবাইকে বলছিল শুনতে পেয়েছিলাম। এইসব কথা বলতে বলতেই তিনকাপ জল মেপে একটা বাটিতে ঢাললো।
_ কি গো এককাপ জল বেশি নিলে কেন গো? আমরা তো চারজন লোক। মা তো চা খাবে না। দু’ কাপ জল আর দু’ কাপ দুধ দিলেই তো চার জনের চা হয়ে যাবে।
-বাবা,তোর কি নজর চারিদিকে! কথা বলতে বলতে ঠিক খেয়াল রেখে চলেছিস বৌদি কি করছে। ওরে আমি চার কাপ চা বানাবো না ছয় কাপ চা করবো।
-দু’ কাপ এক্সট্রা? কেন গো দাদা কি আবার সন্ধ্যা বেলায় চা খাবে না কি?
-না না। আমাদের ঘরের কারোর জন্য নয় পাশের মুদিখানার শ্যামলদা আর ইস্ত্রি করছে যে ছেলেটা আমাদের বৈঠকখানার চাতালে। ওদের দুজনকে বিকালে দু’ কাপ চা রোজই দিই।
চোখগুলো কপালে তুলে ভূমি বলে, তুমি তো সমাজ সেবা করতে শুরু করে দিয়েছো সে কথা আমাকে বলোনি আগে।
-কি করবো বল ওরা যে বড় আপন হয়ে গেছে। তোর দাদার অফিস যাওয়ার জামা প্যান্ট শম্ভু ইস্ত্রি করে দেয় নিত্য। আর শ্যামলদা তো করোনা কালে কি ভাবে যে উপকার করছে তা বলে বোঝানো যাবে না।আলু, পেঁয়াজ-এর পাশাপাশি আদা রসুন কাঁচা লঙ্কা সবই রাখছে দোকানে। তোর দাদাকে তো মেন মাকের্টে যেতেই হয় না। এমন কি মায়ের ডায়পার তাও শ্যামলদার দোকানে পেয়ে যাচ্ছি।
-বৌদি তুমি পয়সা দিচ্ছো ওদের। কেউ জিনিস দিচ্ছে, কেউ আবার কাজ। তা বলে নিত্য চা খাওয়াতে হবে! তোমার এই কাজটা মা জানে?
খেয়ালী মুচকি হেসে বলে, আমার ঘাড়ে কটা মাথা যে শাশুড়িকে না জানিয়ে কোনো কাজ করবো। আর এখন তো বিছানায় শুয়ে শুয়েও চতুর্দিকে নজর রাখছেন।
ইতিমধ্যে একটা স্টিলের মগ নিয়ে হাজির ইস্ত্রিওয়ালা শম্ভু। পূর্ব দিকে জানালা দিয়ে মগটা চালান দিল খেয়ালীকে। তারপর একটা পলিথিন জানালা দিয়ে গলিয়ে দিয়ে বলে, কাকীমা মা পাঠালো সজনে ডাঁটা।
খেয়ালী মগে দু’ কাপ চা ঢেলে দিতেই শম্ভু গুনগুন করে গান করতে করতে চলে গেল। তারপর খেয়ালী বললো, দেখলি ভূমি এদের ভালোবাসা। এই সজনে ডাঁটাগুলোর কিন্তু আমি দাম দিলাম না। বাজারে টাকা দিয়ে অনেক সজনে ডাঁটা কিনে আনা যাবে কিন্তু এই ডাঁটাগুলোর গায়ে যে ভালোবাসা লেগে আছে তা কিন্তু কোনো অর্থ মূল্যে পাওয়া সম্ভব নয়।
আমার অতি সাধারণ জায়গায় বসবাস, সাধারণ মানের ঘরদোর, অতি সাধারণ জীবন যাপন এইসব কিছুকে ছেড়ে আর এই মাঝ-বয়সে ঝাঁ চকচকে দুনিয়ায় যেতে ইচ্ছে করে না কেন জানিস ?
শুধু মাত্র আমার চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর ভালোবাসার জন্য। আর আমার গানও তো রোজ করি সন্ধ্যা বেলায় হারমোনিয়াম বাজিয়ে ঠাকুরের সামনে নিজের মতো করে। হয়তো হাততালির গুঞ্জন থাকে না তবে তাতে থাকে নিজের ভালো লাগার স্পন্দন। একদিন সন্ধ্যার সময় হারমোনিয়াম না বাজালে তোর মা’ও খবর নেয় কি গো বৌমা শরীর ঠিক আছে তো?
তাই এই মাঝ বয়সে এসে যখন হিসাবের খাতা খুলে বসি তখন দেখি না পাওয়ার থেকে পাওয়ার ঘর খানির তালিকায় প্রচুর সংযোজন। সারাক্ষণ নাই নাই করলে কি ভরে উঠবে জীবন। যতটুকু জোটে ততটুককেই যত্ন আত্তি করে রক্ষা করে রাখতে হয়। আর আমি যে ভালোবাসা পাই তোদের কাছ থেকে, আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীর কাছ থেকে তা এক এক সময় অতিরিক্ত মনে হয় আমার কাছে। নিজের মনে বারবার প্রশ্ন জাগে এতো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য কি আমি?