Site icon আলাপী মন

গল্প – যুগল বন্দি

যুগল বন্দি
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

 

 

ফালতু পয়সা নষ্ট করাটা তোমার এখন স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে দেখছি। কোনো চিন্তা নেই, ভাবনা নেই, প্রয়োজন কিংবা অপ্রয়োজনের হিসাব নেই, হুটহাট করে অনলাইনে নিত্য জিনিস অর্ডার করা চাই। প্রচন্ড রাগে গজগজ করতে করতে কথাগুলো বলে চলেছে অনুশ্রী।

তবে অনুশ্রীর রাগের কোনো রকমের তোয়াক্কা না করেই তার বৌমা অগ্নি (অগ্নিমিত্রা ) বলে, দেখো মামনি আমায় রান্না করতে হলে এইসব utensils লাগবে। আমার স্টিলের খুন্তিতে রান্না করতে ভালো লাগে না। আমার একখানা spatula দরকার ছিল। তাই আমি অর্ডার করে ছিলাম। That’s it.

অনুশ্রী চোখগুলোকে কপালে তুলে বলে ওঠে, ওওওও, তাহলে স্টিলের খুন্তি আজকাল ব্যাকডেটেড! এই স্টিলের খুন্তি দিয়েই আমি এতকাল সুস্বাদু সব রান্না করে চলেছি আর বাড়ি সুদ্ধ লোক চেটেপুটে খেয়ে চলেছে ।সে সব ফালতু তাহলে। আর এই দুদিন রান্না ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই মেয়ের কথা শোনো, আশ্চর্য!

এবার মুখটাকে বাংলার পাঁচের মতো করে অগ্নি বলে, আমি weekend এ কিচেনে ঢুকবো এবং সেই অনুযায়ী আমার appropriate রান্নার জিনিস পত্র লাগবে। আপডেটেড জিনিস পত্র না থাকলে আমার রান্না করতে ইচ্ছা করে না।

এবার অনুশ্রী মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, তোমার আর রান্না করে কাজ নেই বাছা। রাঁধবে তো কিসব ইটালিয়ান, চাইনিজ ডিশ। আমাকে আবার তোমার শ্বশুরের জন্য আলাদা করে রান্না করতে হয় প্রতি শনি, রবিবার।

অগ্নি মুখটা বেঁকিয়ে উত্তর দেয়, মামনি তুমি যদি আদিখ্যেতা করে বাপির জন্য রান্না করো। বাপি তো আমার হাতের Risotto খেতে খুব ভালো বাসে। গত রবিবার দু’ দুবার চেয়ে নিয়ে খেয়েছে।

এরপর অগ্নি একটু বিজ্ঞের মতো বলে, যাক গে মামনি। তুমি স্নান,পূজো সেরে নাও। আজ তো তোমার কিচেন থেকে ছুটি। সুতরাং এখানে দাঁড়িয়ে বকবক করে আমার ভেজা ফ্রাই করো না। রান্না করার আগে আমার আবার একটু fresh mind লাগে। ভালো রান্না করতে হলে ভালো মন দরকার। এই বলে কানে ইয়ার ফোনটা গুঁজে স্মার্ট ফোনটা হাউস কোর্টের পকেটে রেখে কাঁধ ঝাঁকিয়ে BTS এর গান শুনতে লাগলো।

এতক্ষণ শাশুড়ি-বৌমার এই তরজা চুপচাপ উপভোগ করছিল অনুশ্রীর বোন মধুশ্রী। গতকাল সে দিদির বাড়ি বেড়াতে এসেছে। কিন্তু এসে থেকেই সে শুনে চলেছে শাশুড়ি-বৌ এর কাওয়ালি। তার দিদি দু’কথা বললে বৌমা আরো চার কথা দেয় শুনিয়ে।

বড্ড আশ্চর্য লাগছে তার এইসব বাগবিতণ্ডা। মনে মনে বলে, একি ! দিদির তো দেখছি শাশুড়ি হওয়ার সামান্য সম্মানটুকুও নেই। আমরা তো ভাবতেই পারি না শাশুড়ীর সাথে উঁচু গলায় কথা বলা যায়।এ কেমন ধারার শাশুড়ি বৌ-এর সম্পর্ক কে জানে?

স্নান, পূজো সেরে অনুশ্রী ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে সিঁথিতে সিঁদুর টানছিলেন। একটা কাঁচের বাটিতে বেশ কিছুটা স্পাউট মুগ কলাই খেতে খেতে ঘরে ঢুকলো মধুশ্রী।
সে তার দিদির উদ্দেশ্যে বলে, দিদি তোর তো একটা জবরদস্ত বৌমা হয়েছে রে। কি করে সহ্য করে এক ছাদের তলায় থাকছিস একসাথে। আমি হলে কবে আলাদা থাকার ব্যবস্থা করে নিতাম।

অনুশ্রী মুখে ময়েশ্চারাইজার ঘষতে ঘষতে বলে ওঠে, সবই আমার কপাল মধু। কেউ কি এমন সাধ্য সাধনা করে একমাত্র ছেলের জন্য জেনে শুনে এমন বৌ ঘরে আনে। তুই তো জানিস বৌমার মা আমার কলেজের বান্ধবী।

বহু বছর পর একদিন হঠাৎই হাবিবের স্যালনে দেখা হয় বৌমার মা লীনার সঙ্গে। আমি তো এতকালের পুরানো বান্ধবী পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। আর সেই দিনই লীনার মেয়েকে দেখে আমি জাস্ট মুগ্ধ হয়ে ছিলাম।আহা কি দেখতে। চোখ মুখ যেন তুলি দিয়ে আঁকা। যেমন লম্বা তেমন ফর্সা। কি অসম্ভব স্মার্ট চেহারা।

লীনার সাথে কথা বলতে বলতে বারবার আমার চোখ চলে যাচ্ছিল ওর মেয়ের দিকে। আমিও কথায় কথায় জানালাম অনিকেতের কথা। লীনা নিজেই বলেছিল, অনুশ্রী আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা আত্মীয়তার সম্পর্কে রূপান্তরিত হলে মন্দ হয় না।

আমি আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে লীনার হাত দুঊটো ধরে বলেছিলাম, তুই তো আমার মনের কথা বলে দিলি। তবে এখনকার ছেলেমেয়েরা কি বাবা-মায়ের পছন্দ করা পাত্র পাত্রীকে চোখ বন্ধ করে বিয়ে করে নেবে রে! আমাদের সব চিন্তা ভাবনাই ওদের কাছে বোরিং ,বেকডেটেড মনে হয়।

লীনা হেসে বলেছিল, দেখা যাক না কথাটা পাড়ি আগে। তারপর কি হয় দেখা যাক।

সেই মতো আমিও তোর জামাই বাবু আর অনিকেতের কাছে লীনার মেয়ের কথাটা পারলাম। তোর জামাইবাবু তো তাড়াতাড়ি আমার ফোনটা নিয়ে ফেসবুক থেকে লীনার প্রোফাইলটা বের করে এক ঝলকে অগ্নির ছবিগুলো স্টক করে এলো।

ওর মুখ থেকেও বেরিয়ে এলো, মেয়ে তো অপূর্ব সুন্দরী। তবে বড্ড বেশি আধুনিকা মনে হচ্ছে। হট প্যান্ট না শর্ট প্যান্ট কি যেন বলো সেগুলো ছাড়া বোধহয় কিছুই পরে না।

মেয়ে আল্ট্রা মডার্ন শুনেই অনিকেতও হামলে পড়লো ফোনের ওপর। কিন্তু ফটো দেখেই সে আবার মাথা চাপড়াতে লাগলো।

মধুশ্রী প্রচন্ড কৌতুহল ভরে জিজ্ঞাসা করে, মাথা চাপড়ানো কেন দিদিভাই?
-আরে অগ্নি তো অনির কলেজেই পড়তো। অনিকেত বলে, মা এ মেয়ে বড্ড বেশি স্ট্রেট ফরোয়ার্ড। মুখের ভাষাও খুব একটা ভালো না।
তখন তোর জামাই বাবু তাড়াতাড়ি অনিকে থামিয়ে কি বলেছিল জানিস?

মধুশ্রী আরো কিছুটা মুগ কলাই চিবাতে চিবাতে জিজ্ঞাসা করে, কি.. কি বলেছিল জামাইবাবু?
তোর জামাইবাবু বলে, শোন অনি তোর মায়ের যুগ আর নেই। তখনকার মেয়েদের গলা দিয়ে আওয়াজ বের হতো কম। আর এখনকার মেয়েরা অবলা নয় সবলা। নিজের লড়াই নিজেই লড়তে জানে।

আমি বেশ বুঝতে পারলাম কর্তারও বেশ পছন্দ লীনার মেয়েকে। শুধু অপেক্ষা অনিকেতের মতামতের।

যদিও ছেলে সঙ্গে সঙ্গে তার ইচ্ছা, অনিচ্ছা কোনটাই না জানিয়ে চুপচাপ তখনকার মতো আলোচনা সভা ত্যাগ করে বুদ্ধির ঘটে ধোঁয়া দেওয়ার জন্য নিজের ঘরে গেল সেটা আমি বেশ বুঝতে পারলাম।

মধুশ্রী তাড়াতাড়ি বলে, হ্যাঁ রে দিদি অনিকেত স্মোক করে তুই কিছু বলিস না!

অনুশ্রী বলে, মা বারণ করলেই ছেলে শুনবে এমন কোনো গ্যারেন্টি আছে? আজকাল তো দেখি কর্তা গিন্নি দু’জনেই এক সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে।

দুই বোনের খোশগল্পের মাঝে অগ্নি এসে হাজির ঝড়ের মতো। যদিও কিচেন থেকেই চিৎকার করতে করতে আসছিল, মামনি আমার cleaver খানা কোথায়?

মধুশ্রী অনুশ্রীর মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জানতে চায় সেটা আবার কি?

অনুশ্রী তাড়াতাড়ি করে ড্রেসিং টেবিলের টুল থেকে উঠে খাটের তলা থেকে একটা মাঝারি সাইজের ছুরি বের করে অগ্নির হাতে দেয়।

অগ্নি চলে যাওয়ার পর অনুশ্রী বলে,এই ছুরির নাম নাকি cleaver। ছুরিটার চেহারা দেখলি। মানুষ খুন করার মতো। এটা দিয়ে নাকি কাঁচা মাছ মাংস কাটা যায় সহজে। এই জিনিসটাও গত সপ্তাহে অনলাইনে কেনা হয়েছে। আমার তো ছুরিটা দেখলেই কেমন ভয় করে। তাই খাটের তলায় লুকিয়ে রেখে দিয়েছি।
তারপর মুখটা বেঁকিয়ে অনুশ্রী বলে, বঁটি দিয়ে দিব্বি মাছ মাংস কেটে নেওয়া যায়। তা নয় মহারানীর cleaver টাই লাগবে।

মধুশ্রী বেশ একটু তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে, দিদিভাই তোর অবস্থা কিন্তু বেশ সঙ্গিন তোর সংসারে এখন তোর কথার দাম নেই। ছেলে, স্বামী সবাই তো বৌমার পালে হাওয়া দিচ্ছে। তুই তো একেবারে একা হয়ে গেছিস দেখছি।

অনুশ্রী একটু হেসে বলে, কি যে বলিস নিজের ঘরে কখনও কেউ একঘরে হয়! এটা যেমন আমার সংসার তেমন কিন্ত বৌমারও সংসার।

মধুশ্রী একটু বিরক্ত হয়ে বলে, দেখ দিদিভাই ছেলের বৌকে মাথায় তুলে এতো নাচিস না।পরে তোকেই আফশোষ করতে হবে। আমি তো কাল থেকে এসে দেখছি তোর বৌমা তোকে একটুও ভয় পায় না। সারাক্ষণ মুখে মুখে তর্ক লেগেই আছে। উল্টে তুই কিছু বললেই তার মুখ হাঁড়ি হয়ে যাচ্ছে।

তারপর মধুশ্রী চোখে মুখে আরো খানিকটা বিজ্ঞের ভাব ফুটিয়ে বলে,শাসন করতে না জানলে ভালো শাশুড়ি হওয়া যায় না বুঝলি।

অনুশ্রী চুপ করে থাকে বোনের সুচিন্তিত অভিমত শুনে চলেছে। কিছু কথা তার ঠোঁটের ডগায় হাজির হচ্ছিল। তবু সে চুপ করে রইলো সেই মুহুর্তে।

একথা সেকথায় আরো ঘন্টাখানেক অতিবাহিত হলো। আবার শোনা গেল অগ্নির চিৎকার রান্নাঘর থেকে। মামনি ও মামনি আমার mesh skimmer টা কোথায় গেল? আরে বাবা আমার ladle টাও দেখছি ধোয়া নেই। প্লিজ মামনি তুমি তোমার বোনের সাথে এবার খোশগল্পটা বন্ধ করে আমার কাছে এসো। প্লিজ,প্লিজ, প্লিজ।

অনুশ্রী চোখে মুখে একটা প্রশান্তির হাসি দিয়ে মধুশ্রীকে বলে, দেখছিস তো আমার বৌমার আমাকে ছাড়া মোটেই চলে না। সারাক্ষণ বৌমার মুখে লেগে আছে ‘মামনি’ ডাক খানা। আমি যাই রে শিগগিরই। না হলে রেগে আগুন হয়ে যাবে।

‌অনুশ্রী কিচেনে আসা মাত্র অগ্নি বলে, মামনি আমার রান্না মোটামুটি রেডি। তুমি spinnerটা দিয়ে স্যালাড-এর জোগাড়টা করে নিও। আমি টেবিল সাজাতে চললাম।

অনুশ্রী স্যালাড কেটে এনে ডাইনিং টেবিলে রাখতে গিয়ে দেখে অগ্নি আজ বানিয়েছে পুরো বাঙালি খাবার। মুড়ি ঘন্ট, মাছের মাথা দিয়ে মুগ ডাল, মাটন কষা আর টমেটোর চাটনি আবার পাঁপড়ও ভেজেছে বেশ।

ইতিমধ্যে চেয়ার টেনে বসে পড়েছে অনিকেত ও অনিকেতের বাবা। মধুশ্রীও একটা চেয়ার টেনে বসে কৌতুহল ভরে। আজকের খাবারের মেনু দেখে মধুশ্রী বলে, ও বাবা আমাদের বৌমা তো বাঙালি ডিশও বানাতে জানে দেখছি।

মাসি শাশুড়ির কথায় আহ্লাদে গদগদ হয়ে অগ্নি বলে, এইসব রান্না আমি মামনির কাছে শিখেছি। তারপর অনুশ্রীকে জড়িয়ে ধরে বলে, বুঝলে মাসিমনি আমি আর মামনি কেবল ঝগড়াই করি না আমরা একে অপরের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখি।

তারপর গর্ব করে অগ্নি বলে, আমার মামনি আমাকে শিখিয়েছে একটা শক্ত পোক্ত সম্পর্ক গড়ে তুলতে। একসাথে থাকতে গেলে মতের অমিল হতেই পারে তা বলে মনের অমিল কখনো নয়।

অনুশ্রী এবার হালকা ধমকের সুরে বলে, অনেক হয়েছে বক্তৃতা। এবার খেতে বসো তুমি। সকাল বেলায় একটু পাস্তা খেয়েছিস মাত্র। এত রান্না সব নিজে একা হাতে করেছো। অনেক পরিশ্রম হয়েছে। পেট পুরো খালি হয়ে গেছে। তুমিও বসে পড়। আমি খাবার সার্ভ করে দিচ্ছি।

অগ্নি বলে, না মামনি আমি তোমার সঙ্গে খাবো। weekend এর এই দুটো ছুটির দিনই তো তোমার সাথে দিনের বেলায় খেতে পাই।

অনুশ্রী মধুশ্রীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে, দেখছিস তো মধু আমার বৌমা আমাকে কেমন জ্বালাতন করে।

মধুশ্রী হঠাৎই যেন অগ্নির মুখে দেখতে পেল তার বাইশ বছরের মেয়ের ছায়া। সেও অগ্নির মতো চঞ্চলা, চপলা, মুখরা। সারাদিন তাদেরও মা মেয়ের ঝগড়া চলে। কিন্তু খাবার টেবিলে ঠিক যেন একি রকমের ভাব।

মনে মনে মধুশ্রী বলে, হয়তো একদিন না একদিন আমার মেয়েও কারোর পুত্রবধূ হবে। হে ঈশ্বর তখন আমার মেয়েও যেন ওর শাশুড়ির সঙ্গে এই রকম যুগলবন্দী তৈরি করতে পারে।

Exit mobile version