।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার এর গল্প ।।
অতৃপ্ত বাসনা
-শচীদুলাল পাল
স্টেশন লছমনপুর।বীরভূম ঝাড়খন্ড সীমান্ত। ভীমগড় থেকে পলাস্থলি রুটের একটাই ট্রেন। সকাল ৭ টায় যায় রাত আটটায় ফেরে।ট্রেন থেকে নেমে দেখলাম লোকজন বিশেষ নেই। দুএকজন যদিওবা ছিল তারা দক্ষিনে দিকে চলে গেলো । আমাকে উত্তরদিকে লছমনপুর গ্রামে যেতে হবে ক্যানসার আক্রান্ত বন্ধুকে দেখতে। কলেজে পড়ার সময় আরও দুজন সহপাঠী বন্ধুর সাথে একবারই এসেছিলাম।
বেশ অবস্থাপন্ন।
বিশাল অট্টালিকা। ঘুরে ঘুরে ঘরগুলি দেখিয়েছিল বেশ গোলোক ধাঁধাঁর মতো ঘরগুলি। একবার যদি কোনো ডাকাত দল ঢুকে পড়লেও সে বেরতে পারবেনা। একবার এক ডাকাত দলকে দরজা বন্ধ করে আটকে রেখে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছিল।
আজ আমি একা। ধীরে ধীরে রাত বাড়তে লাগলো। নিশুতি রাত। মেঘে ঢাকা আকাশ। গা ছমছম। চাঁদ ওঠেনি। সরু মেঠো পথ।নিস্তব্ধ নিঝুম। শাল পিয়ালের বন।রাস্তা ভুলে গভীর জঙ্গলের দিকে যেতে যেতে অনেকটা পথ চলে এসেছি। গভীর বনের শেষে এক পরিত্যক্ত মাটীর বাড়ি। পাশে ছোট নদী কুল কুল বয়ে চলেছে। থমকে দাঁড়ালাম। ভুল পথে এসেছি। আবার যে পথে এসেছি সে পথই ধরলাম। কিন্তু না কোথায় যাচ্ছি?একটা গোলোক ধাঁধায় পড়লাম।
একটা পিয়াল গাছতলায় এসে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ ভাবলাম, মনে করার চেষ্টা করলাম।
হঠাৎ একটা খসখস শব্দ।শুকনো পাতার উপর চললে যেমন হয়।স্পষ্ট দেখলাম একজোড়া নারী পুরুষ এগিয়ে আসছে। যুবক যুবতী। এগিয়ে এসে যুবতি মেয়েটি বলল “আপনি কোথায় যাবেন”? আমি বললাম “লছমনপুর গ্রাম “।মেয়েটি বলল” আপনি ভুল করেছেন। এটা গ্রামে যাবার পথ নয়।আমাদের সাথে আসুন আমরা আপনাকে সঠিক পথ দেখিয়ে দিচ্ছি। আমরা ঐ গ্রামেরই।আমি ওদের অনুসরণ করলাম। মেঘের ফাঁকে একফালি চাঁদ।
কখনো আলো কখনো ছায়া। মাঝে মাঝে চাঁদের আলোয় ওদেরকে দেখছিলাম। মেয়েটি গান গাইছিল আর ছেলেটি বাঁশি বাজাচ্ছিল।
জিজ্ঞেস করলাম “তোমরা কে”?মেয়েটি বলল ” আমি পিয়ালি আর ওর নাম পলাশ”।আমরা দুজনে দুজনকে খুব ভালবাসি।পথ চলতে চলতে আমরা একটা গ্রামের সামনে এসে পড়লাম। পিয়ালি বলল “কার বাড়ি যাবেন?” আমি আমার বন্ধুর নাম করতেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো তারপর বলল “আসুন”। বাড়ীটির কাছাকাছি আসতেই দূর থেকে দেখিয়ে দিয়ে তারা অদৃশ্য হয়ে গেল। কিছুই বুঝতে পারলাম না কোন দিকে গেলো। বাইরের দরজায় টোকা দিতে বন্ধুর স্ত্রী দরজা খুলে দিল। বিশাল অট্টালিকা। অসুস্থ বন্ধুর সাথে দেখা করলাম। রাতের খাবার খাইয়ে বন্ধুর স্ত্রী দোতলায় একটা ঘর খুলে বলল “এখানে আপনি ঘুমাবেন”।
দক্ষিণ খোলা।আলো বাতাস পূর্ণ দোতলার ঘরটি বেশ মনোরম। কিছুক্ষন কথাবার্তা শেষে ওরা চলে গেলো। আমি দরজায় খিল এঁটে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। পথশ্রান্ত আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
হঠাৎ একটা বিভৎস চিৎকারে আমার ঘুমটা ভেঙে গেলো।কান খাড়া করে শুনবার চেষ্টা করলাম।আলো জ্বেলে দেখলাম নাঃ,কেউ কোথাও নেই।আলো নিভিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।আবার একটা অস্বাভাবিক শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। একটা মেয়েলি কণ্ঠস্বর। স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিতা একটা মেয়ে আমার পাশে বসে আছে। একফালি চাঁদের আলো ওর মুখের উপর পড়লো। আমি ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম” কে তুমি “?
মেয়েটি বেশ জোর গলায় বলল “আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি পিয়ালি”। ভয়ে উত্তেজনায় হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো। হাত পা কাঁপতে লাগলো।নিজের হাতে দরজা বন্ধ করেছি কোথা থেকে সে এলো? হঠাৎ পিয়ালির চোখ দুটি বড়ো হয়ে গেল। আগুন ঠিকরে বেরতে লাগলো। ভয়ংকর বিভৎস মূর্তি।ঘরের আলো একবার জ্বলছে একবার নিভছে। আকাশ বাতাস চিরে অট্টহাসি। আমার খাটটা দুলতে লাগল। একবার আলো একবার অন্ধকার। পিয়ালি কখনো খাটের উপর কখনো নীচে।কখনো এপ্রান্তে কখনো ওপ্রান্তে। সর্বত্র দেখছি পিয়ালি।
হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানি।কড়কড় কড়াৎ শব্দে বাজ পড়লো। সামনে পলাশ। পিয়ালি পলাশ একসাথে আমাকে গ্রাস করতে আসছে। আমি চীৎকার করতে করতে জ্ঞান হারালাম। সম্বিত ফিরে পেলাম কে বা কারা যেন বাইরে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। আমি দরজা খুলে দিলাম। দেখলাম বাইরে বন্ধু ও বন্ধুর স্ত্রী । তারা ঘরে এসে বসল।জিজ্ঞেস করল” এত জোরে চেঁচাচ্ছিলে কেনো? “।আমি বললাম “পিয়ালি পলাশ এসেছিলো, পিয়ালি কে?” একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বন্ধুটি বলল “পিয়ালি আমার বোন”।
বন্ধু পত্নী যা বলল তা শুনতে শুনতে আমার হাত পা কাঁপতে লাগল।
—অনেকদিন আগে, দু দুবার চেষ্টা করেও এক কুখ্যাত ডাকাত এই বাড়িতে ডাকাতি করতে পারেনি।
সেই আক্রোশে এগারো বছরের স্কুল ফেরতা পিয়ালি কে কিডন্যাপ করে জঙ্গলে এক পরিত্যক্ত ঘরে আটকে মুক্তিপন চেয়ে চিঠি লিখেছিল।
লিখেছিল “পিয়ালিকে পেতে হলে দশ লাখ টাকা নিয়ে এসে ছাড়িয়ে নিয়ে যা। তা নাহলে কেটে টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দেব।
পুলিশে জানালে তোদের সবাইকে শেষ করে দেব।”
বাড়িতে এক বিমর্ষতা ও অন্ধকার ছেয়ে এসেছিল।
পলাশ নামে একটি ছেলে এসে বলেছিল
—আমি জানি পিয়ালিকে কে তুলে নিয়ে গেছে। আমি পিয়ালিকে উদ্ধার করে আপনাদের ফেরত দেব।
আমাদের উত্তরের অপেক্ষা না করে সেই রাতে চুপিচুপি সেই ডাকাতদের আস্থানায় ঢুকে ঘুমন্ত এক ডাকাতের বন্দুক চুপিসারে নিয়ে সেই ঘরে ডাকাত দলের সবকটাকে গুলি করে মেরে পিয়ালিকে উদ্ধার করেছিল।
সেই থেকে পিয়ালি- পলাশ একে অপরকে ভালবাসত।কয়েক বছরের মধ্যে ভালোবাসা গভীর হলো।
এখানে সেখানে তারা মিলিত হতো।আমরা পিয়ালিকে ঘরে বন্দী করে রাখতাম।
কয়েক বছর পর একদিন পালিয়ে গিয়ে মন্দিরে পলাশকে বিয়ে করেছিল।
পলাশ ছিল জাতে বাউরি।গরীব। আমরা মেনে নিইনি।একদিন ওরা আবার পালিয়ে যায়।জঙ্গলের মধ্যে একটা পিয়াল গাছে গলায় দড়ি দিয়ে দুজনে একসাথে আত্মহত্যা করেছিল।সকালবেলা গ্রামের লোক বাড়ীতে খবর দিয়েছিল।” বলতে বলতে বন্ধু পত্নী অঝোরে কাঁদতে লাগলো।
আমার রক্তের ভিতরে এক হিমশীতল স্রোত বয়ে গেলো।