।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
আরো একবার
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
একখানা চার চাকা প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়ালো বিভার।বিভাও তৎক্ষণাৎ চোখ পাকিয়ে তাকালো গাড়িটার দিকে। গাড়ীর জানালার কাঁচ টা নামিয়ে একজন ভদ্রমহিলা বলে, অ্যাই বিভু উঠে আয় গাড়িতে।
চমকে উঠেছিল সেদিন ডানকুনি র কোএডুকেশন স্কুলের শিক্ষিকা বিভাবরী রায়। বিভু নামটা ধরে তো তার কলেজের বান্ধবী সুদক্ষিনা ছাড়া আর কেউ কোনদিন ডাকে নি।
কিন্তু সেই সুদক্ষিনা তো ভীষন গরীব ঘরের মেয়ে ছিল। কতবার বিভাবরী নিজের পকেট মানি দিয়েছিল সুদক্ষিনা কে। শুধুমাত্র তার অসুস্থ মাকে ফল কিনে দেওয়ার জন্য।
বিভাবরী ছাতাটা বন্ধ করে ভালো করে গাড়ীর ভিতরের মহিলাটিকে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে ছিল। মহিলা টি আবার ও বলে ওঠে, কি রে বিভু চিনতে পারছিস না? অ্যাই আমি সুদক্ষিনা মজুমদার। দূর্গাপুর গরমেনট কলেজের ২০০১ এর ইতিহাসের ব্যাচ।
এইবার বিভা উচ্ছসিত হয়ে ওঠে। সংকোচের সমস্ত বাঁধন ভেঙ্গে বলে ওঠে, সুদু তুই! তোকে আমি চিনতে পারি নি।
একটু ঠাট্টার ছলে,তা কেন পারবি? উঠে আয় গাড়িতে। এই বলে গাড়ীর দরজাটা খুলে দিল সুদক্ষিনা।
বিভাবরী গাড়ীতে উঠে বসতেই গাড়িটা চলতে শুরু করল। ভাদ্রমাসের ভ্যাপসা গরমে ছাতা মাথায় বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে রীতিমত ঘর্মাক্ত বিভা।
গাড়ীতে বসেই এসির হাওয়াতে শরীরটা বেশ আরাম বোধ করল। ইতিমধ্যে সুদক্ষিনা ড্রাইভার কে বলে শক্তিগড়ের কোনো ভালো রেস্তোরার সামনে যেন গাড়ি দাঁড় করায়।
বিভাবরী বারবার আড় চোখে দেখে চলেছে সুদক্ষিনাকে।কি সাংঘাতিক পরিবর্তন। কলেজের সেই সাদা মাটা মেয়েটা এখন কি স্মার্ট দেখতে হয়েছে।
বিভা মনে মনে বলে, পড়াশোনা তে তার থেকে কোনদিনই ভালো ছিল না সুদক্ষিনা। তাহলে নিঃশ্চয় বড়লোকের বউ এখন।লেয়ার কাট চুলের বাঁকা সিঁথি তে আবছা একটু সিন্দুর দেখতে পেয়ে নিশ্চিত হলো সুদক্ষিনা বিবাহিত।
সুদক্ষিনা বেশ কতগুলো ফোন কল সেরে ফোনটা ব্যাগে রাখতে রাখতে বলে ছিল, আজ কিন্তু তোকে সহজে ছাড়ছিনা।আঠেরো বছর পর আবার দেখা। এখন সাড়ে এগারোটা। লম্বা টাইম আমাদের হাতে।
কি রে এমন ফ্যাল ফ্যাল করে কি দেখছিস বলতো? ভাবছিস গরীব,বেচারী সুদক্ষিনা কি লটারি পেয়েছে?
বিভা ঠোঁটের কোণে একটু হাসি এনে বলে, তা তো একটু ভাবছি।অ্যাই সুদু তুই কবে বিয়ে করেছিস?
বিয়ের কথা শোনা মাত্রই সুদক্ষিনা কেমন একটা মুচকি হাসি দিয়ে সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল।
তারপর বলল, বিভু তুই কি এখন ও দূর্গাপুর এ থাকিস? আর এখানে এসেছিলি কোথায়?
_ আমি ডানকুনির একটা স্কুলে চাকরি করছি ইতিহাসের টিচার হিসাবে। আর আমি এখন ও দূর্গাপুরে থাকি সেই পুরনো কোয়ার্টারে। যদিও কোয়ার্টার খানা এখন আমাদের নিজেদের হয়ে গেছে।
বাবার রিটায়ারমেন্ট এর আগে থেকেই স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া কোয়াটার গুলো লীজে দিতে শুরু করেছিল।আমি ই তখন বাবার কোয়াটার খানা লীজে কিনে ফেলি।
_ বিভু আশাকরি তোর সাথে সমরেশ দার বিয়ে হয়েছে। কেমন আছে রে সমরেশ দা?
ইতিমধ্যে শক্তিগড়ের একটা সুন্দর রেস্টুরেন্ট এর সামনে ড্রাইভার গাড়ি টা থামালো।গাড়ি থেকে নেমেই সুদক্ষিনা বিভাবরীর হাত দুটো ধরে বলে, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি কোনো দিন তোর সাথে আবার দেখা হবে। কতগুলো বছর হয়ে গেল বলতো। আমাদের মধ্যে সামান্যতম যোগাযোগ টুকু ও ছিল না। আসলে কলেজ ছাড়ার পর যে যার মতো জীবন যুদ্ধে নেমে পড়েছিলাম সবাই।
বিভু তোর মনে আছে আমাদের কলেজের পাশে জেরক্স দোকানের সুনীল দার কথা।যার দোকান থেকে ছেলে গুলো সব পরীক্ষার সময় মাইক্রো জেরক্স করে আনতো।
_ তা আবার মনে থাকবে না।যত রকমের দু নাম্বারি কার্য কলাপের আখড়া ছিল এই দোকান টা।সুদু তোর সাথে আমাদের ব্যাচের অন্য কারোর সঙ্গে যোগাযোগ আছে না কি?
_ আছে একজনের।
_ কে রে?
_ পার্থ প্রতিমের সাথে।
পার্থ প্রতিমের নাম শুনেই বিভাবরী যেন আকাশ থেকে পড়ল। চোখ গুলো কপালে তুলে বলে, পার্থ এর সাথে তুই যোগাযোগ রেখেছিস! কি করে সম্ভব? তুই তো ওকে দুচোখে সহ্য করতে পারতিস না।
মনে আছে সেবার সরস্বতী পূজার সময় কি সাংঘাতিক ঝামেলা হয়েছিল তোদের দুজনের মধ্যে। সমরেশ দা অনেক কষ্টে তোদের দুজনকে শান্ত করেছিল।
_ দেখ বিভু কেউ যদি তোকে স্বার্থপর বলে তাহলে তুই রাগ করবি না?
আমাকে মাঝে মধ্যে পার্থ ওর ইতিহাসের নোট দিত। । জানিস তো আমার কোচিং নেওয়ার মতো সামর্থ্য ছিল না।তাই মাঝে মধ্যেই এর ওর কাছ থেকে নোট ম্যানেজ করতে হতো।
সেবার সরস্বতী পূজার ফুল, বেলপাতা, দূর্বা, সব কিছু ধুয়ে পরিষ্কার করে ঝুড়িতে বেছে রাখছি।এমন সময় পার্থ এসে বলে, সুদক্ষিনা আমাকে একটা ছোট গাঁদা ফুলের মালা দে। আমার গার্লফ্রেন্ড খোঁপায় জড়াবে।
আমি তখন বলেছিলাম মালা সব হিসাব করে আনা হয়েছে।মালা কম পড়লে ম্যাম আমাকে বকবেন।
আর আমার এই কথা শুনে পার্থ আমাকে বললো, ও যখন আমার কাছ থেকে নোট চাস তখন তো আমি না বলি না।নোট গুলো আমাকেও পয়সা দিয়ে কিনতে হয়।
তারপর তো আমাকে স্বার্থপর, হিংসুটি,লোভী আরো কত কিছু বলেছিল। আসলে গরীব ছিলাম তো তাই বোধহয় আমাকে অপমান করতে কেউ দ্বিধা বোধ করতো না।
_থাক না সুদু ঐ সব কথা। এতদিন বাদে তোর সাথে আমার যে দেখা হলো তা যে কত আনন্দের তা বলে বোঝাতে পারবো না।
ইতিমধ্যে ওয়েটার এসে দু প্লেট মশালা ধোসা দিয়ে গেল। সাথে কফি।
খেতে খেতে সুদক্ষিনা ও লক্ষ্য করে চলেছে বিভাবরী কে।সাজ পোশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে না যে সে সধবা না বিধবা।সে তো আজকাল বাঙালি বিবাহিত মেয়েদের কে দেখে বোঝা যায় না অবিবাহিত না বিবাহিত না বিধবা। তাছাড়া সুদক্ষিনা নিজেও শাঁখা, সিঁদুর কিছুই পরে না।
তাই সুদক্ষিনা আবার সমরেশ দার প্রসঙ্গ টা টেনে আনলো।
কি রে সমরেশ দার কথা কিছু বল। বিয়ে করে নিঃশ্চয় খুব সুখে আছিস তোরা?
বিভাবরী মাথা টা কিছুক্ষন নিচু করে রাখে। তারপর বলে, বছর পাঁচেক হলো
সুদক্ষিনা তাড়াতাড়ি বিভাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, থাক থাক আর বলতে হবে না তোকে। তারপর বলে, আমি ভাবতেই পারছি না সমরেশ দার মতো মানুষ এত তাড়াতাড়ি চলে গেল। ঈশ্বরের কাছে ওর আত্মার শান্তি কামনা করি।
বিভাবরী এবার বিরক্ত হয়ে বলে, ধূর বাপু। তোর না আগে আগে ভেবে নেওয়ার অভ্যাস টা এখনও যায় নি দেখছি। ওরে তোর সমরেশ দা মারা যায় নি। বহাল তবিয়তে আছে।
সুদক্ষিনা কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে, তাহলে বছর পাঁচেক আগে কি হয়েছিল রে?
বিভা বলে, ডির্ভোস। তোর সমরেশ দার সঙ্গে আমার ডির্ভোস হয়েছে বছর পাঁচেক হলো ,বুঝলি পাগলি।
_ সে কি রে! সমরেশ দার মতো বুঝদার মানুষের সাথে তুই ঘর করতে পারলি না।আর আমাকে দেখ , কেমন ফালতু, হিংসুটে,রগ চটা ছেলেটার সাথে ঘর করছি।
_কার কথা বলছিস সুদু?
_ কার আবার, পার্থ প্রতিম বাবুর কথা বলছি।
এবার তো রীতিমতো ভিমরি খাওয়ার জোগাড় বিভার।সে দুচোখে কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে, তুই পার্থ কে বিয়ে করেছিস? কবে করলি বিয়েটা? হ্যা রে পার্থ এখন কি করে?
_ পার্থ আর আমি দুইজনেই এখন রাজ্য পুলিশের আধিকারিক। আসানসোলে পোস্টেড।বিয়ে করেছি দশ বছর হলো।সাত বছরের একটা ছেলে আমাদের।
তবে বিয়েটা যে কিভাবে ঘটল তা আমি ও বুঝে উঠতে পারি না। যেহেতু আমাদের দুজনের বাড়ি এক পাড়াতে। সেই হেতু পার্থ এর মা আমাকে আসতে যেতে দেখতো।
আমি চাকরি পাওয়ার পর উনি নিজেই এসেছিলেন বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আমাদের বাড়িতে। এসে আমার মাকে বলেছিলেন, ‘আমার মেজাজী ছেলের জন্য একটা শক্ত, সামর্থ্য,তেজী মেয়ে খুঁজছিলাম। আপনার মেয়ের মধ্যে আমি সেই সব গুন গুলো দেখতে পাই।তাই আমি চাই আপনার মেয়েকে বউ করে নিয়ে যেতে।’
ব্যাস,চার পাঁচ মাসের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল।
তবে জানিস বিভু, পার্থ কিন্তু এখন অনেক বেশি ম্যাচিওর।রগ চটা স্বভাব টা একদমই চলে গেছে। বরং ওর মধ্যে আমি অনেক বেশি সহনশীলতা দেখতে পাই।
_ তাই হয় বোধহয়।বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বোধশক্তি, বিচক্ষণতাও বাড়ে। কিন্তু সমরেশের ক্ষেত্রে তা আমার উল্টো মনে হয়।
এম এ করার পর অনেক চেষ্টা করেও যখন কোনো সরকারি চাকরি জোগাড় করতে পারলো না তখন ও একটা বেসরকারি স্কুলে যোগদান করে।স্কুল টাইমিং এর পর ও বাড়িতে কোচিং ক্লাস করতো। তবুও কোথায় যেন হীনমন্যতায় ভুগতো সারাক্ষণ।কথায় কথায় টেনে আনতো আমার মাইনের কথা, চাকরির নিরাপত্তার কথা। সাত টা বছর তাও জোড়াতালি দিয়ে চেষ্টা করেছি সুসম্পর্ক রাখার। তারপর আর পারলাম না।
সুদক্ষিনা হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে দুটো ।দুজনে রওনা দেয় দূর্গাপুরের উদ্দেশ্যে।সিটি সেন্টারে ঢোকা মাত্রই পার্থ এর সাথে দেখা।সুদক্ষিনা ফোন করে পার্থ কে আগেই আসতে বলেছিল। তারপর বিকালে সারলো দুপুরের লাঞ্চ। লাঞ্চ করতে করতে কলেজের আরো ও কিছু মজার ঘটনা ওরা স্মৃতিচারণ করলো।
বাড়ি ফিরে এসে সুদক্ষিনা ও পার্থ প্ল্যান করে কিভাবে তাদের সমরেশ দা ও বিভাবরী কে আবার মিলিয়ে দেওয়া যায়।
পার্থ বিভাবরীর কাছ থেকে সমরেশ দার ফোন নাম্বার নেয়। মাঝে মধ্যেই সৌজন্য মূলক বার্তালাপ করে। যে সম্পর্কের বাঁধন গুলো আলগা হয়ে গিয়েছিল সেগুলো আবার মজবুত বাঁধনে বাঁধা পড়তে লাগলো।
সুদক্ষিনা ও পার্থ তাদের একাদশতম বিবাহ বার্ষিকীতে সমরেশ ও বিভাবরী কে নিমন্ত্রণ করলো।প্রথম দিকটায় সমরেশ ও বিভাবরীর একটু আড়ষ্ঠতা থাকলেও কলেজের পুরানো কথার ভীড়ে কখন যে আবার বন্ধুত্বের সারল্যে এক হয়ে উঠেছে তা নিজেরাই টের পায় নি।
রাতে বাড়ি ফেরার সময় হলে পার্থ বিভাবরী কে পৌঁছে দিতে চাইলে সমরেশ বারণ করে বলে, আমি আছি তো। তোকে আর দূর্গাপুর যেতে হবে না।
সেদিন সুদক্ষিনা দেখেছিল, তাদের সমরেশ দার চোখে সেই কলেজের দিনগুলোর গভীর ভালোবাসা বিভুর জন্য।