গল্প- এক প্রতিবাদিনী

।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ।।

 

এক প্রতিবাদিনী
-অমিত কুমার জানা

 

 

সরাসরি নারী সুরক্ষা দপ্তর থেকে অফিসাররা সকাল দশটা নাগাদ যুথিকার বাড়িতে পৌঁছে গেল। এতদিনে সোসাল মিডিয়া এবং নিউজ চ্যানেলের সৌজন্যে যুথিকার প্রতিবাদীসত্তা বেশ বিখ্যাত হয়ে গেছে। শহরের সুবিদিত ‘দত্ত এন্টারপ্রাইজের’ স্বত্বাধিকারীর একমাত্র ছেলের পত্নী যুথিকা। তিন বছর হলো যুথিকার বিয়ে হয়েছে।
নারী সুরক্ষা দপ্তরের দুজন অফিসার তিনতলা বাড়িটার সামনে পৌঁছে বেশ নিস্তব্ধতা অনুভব করলো। বিখ্যাত অভিজাত পরিবারেও আজ যেন একেবারে নীরবতার ছায়া নেমে এসেছে। অনেক ডাকাডাকি করেও কারও কোন সাড়া না পেয়ে তারা নীচতলার একটা ঘরের দরজায় টোকা দিল।
দরজাটা সামান্য ঠেলতেই খুলে গেল। ঘরে টিভিতে কার্টুন চলছিল। টিভির সামনে একটা চেয়ার। কিন্তু কে টিভি দেখছে? তারা চেয়ায়ের সামনে গিয়ে দেখতে পেল একটা আড়াই-তিন বছরের ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে কার্টুন দেখছে। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে অর্ধোচ্চারিত মনোগ্ৰাহী মিষ্টি ভাষায় জিজ্ঞেস করলো,-” তোমরা কে? তোমাদের নাম কি? “
এইটুকু একটা বাচ্চার এহেন চটপটে বাক্যালাপের ভঙ্গিতে অফিসাররা স্তম্ভিত হয়ে গেল। তারা জিজ্ঞেস করলো ,” সোনামনি, তুমিই কি যুথিকাদেবীর মেয়ে?” মেয়েটা মাথা নেড়ে ইতিবাচক উত্তর দিল এবং বললো তার নাম রিতিকা। ছোট্ট রিতিকা তাদের বসতে বললো।

কিছুক্ষণ পর যুথিকা বাথরুম থেকে স্নান সেরে এল। অফিসাররা নিজেদের পরিচয় দিলেন। এরপর যুথিকা বললো,-” আপনারা এসেছেন ভালো কথা,তবে কেউ আমার সঙ্গ দিক আর না দিক আমাকে এ জীবন যুদ্ধে জয়ী তো হতেই হবে। এছাড়া অন্য উপায় নেই।”
অফিসাররা তার বিবাহিতা জীবনের তিন বছরের কাহিনী জানতে চাইলেন। যুথিকা গোড়া থেকে বলতে শুরু করলো,-” বছর তিনেক আগে আমি আর আমার মা ‘দত্ত এন্টারপ্রাইজে’ গিয়েছিলাম মার্কেটিং করতে। ওখানেই দত্তদের একমাত্র ছেলে রাকেশ দত্তের সাথে আমার পরিচয় হয়। প্রথম সাক্ষাতেই ও আমাকে প্রেম নিবেদন করে এবং মোবাইল নম্বর চায়। প্রথমে একেবারেই বিশ্বাস হচ্ছিল না যে এরকম একজন বিখ্যাত অভিজাত পরিবারের ছেলে আমাকে সত্যিই ভালবাসে কিনা। কিন্তু অতঃপর ও আমাকে একটা দামী এনড্রয়েড মোবাইল কিনে দেয় এবং কিছুদিনের মধ্যে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেয়। তারপর বিয়ের পাকাকথাও হয়ে যায়। আমি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। আমার মা অঙ্গনওয়াড়ী স্কুলে চাকরি করে। তা থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়েই যথাসম্ভব চেষ্টায় বিয়ের গয়নাসামগ্ৰী কেনাকাটা করা হয় এবং আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের সময় শ্বশুরবাড়ির লোকেদের মিষ্টি ব্যবহারের সুদক্ষ অভিনয় আমার বিন্দুমাত্র বোধগম্য হয় নি।
বিয়ের প্রায় দুবছর পর থেকে ওদের আসল চেহারা ক্রমশ আমার সামনে স্পষ্ট হতে থাকে। যে কোন উপায়েই আমাকে বাড়ি থেকে বহিষ্কার করার চেষ্টায় তৎপর হতে থাকে। রাকেশ আমাকে ‘সামান্য বাড়ির মেয়ে’ বলে গালিগালাজ করতে থাকে। কিন্তু খুব অদ্ভুত লাগত যখন দেখতাম আমার শ্বশুর এবং শাশুড়িও তাদের একমাত্র এই আদরের ছেলেকে পুরো সমর্থন করতো। প্রথমে মনে হতো এই দুর্ব‍্যবহার বোধহয় ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে। কিন্তু না , ঠিক এর উল্টোটাই ঘটতে থাকলো।
তারপর একদিন কানপেতে ওদের গোপন আলোচনা শুনতে পেলাম। আলোচনার সারমর্ম এইটাই যে আমাকে তাড়িয়ে দিয়ে রাকেশের নতুন করে বিয়ে দেওয়া হবে। আমি ভীষণ শোকাহত হয়ে গিয়েছিলাম এবং আসন্ন বিপদের কথা ভেবে জড়োসড়ো হয়ে গিয়েছিলাম।
কিন্তু তারপর ভাবলাম এত সহজে হার মেনে নিলে চলবে না। এইটাই তো আমার প্রকৃত ঘর। আমি বাপের বাড়িতে গিয়ে কেন থাকব? নিজেকে বেশ শক্ত করলাম এবং এর একটা প্রতিকার খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। তখন আমার কোলে দেড় বছরের মেয়ে রিতিকা। ওকেও বড়ো করে তুলতে হবে তো।

এরপর একদিন বিকেলের দিকে বাড়িতে কেউ ছিল না। হঠাৎ আমার রুমের দরজায় কেউ টোকা দিল। দরজা খুলতেই বলপূর্বক আমার রুমে প্রবেশ করলো এক যুবক। ওকে কোথায় দেখেছি ঠিক মনে করতে পারছিলাম না। ও আমার গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করছিল। আমি তার আগেই অতি সাবধানে মোবাইলের ভিডিও রেকর্ডারটা স্টার্ট করে দিয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গেই কোথা থেকে হঠাৎ রুমের সামনে হাজির হলো আমার বাড়ির লোকজন। রাকেশ বললো,-” ছি ছি, শেষকালে আমার বন্ধুর সঙ্গে তুমি!” শ্বশুর,শাশুড়ি সবাই আমাকে দুশ্চরিত্রা বলে বিশ্রী ভাষায় গালি দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বললো।

আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই নি মোটেই। তখনই আমার বান্ধবী উকিল (দিশা)- কে ফোন করে সব জানালাম এবং শ্বশুরবাড়ির বাড়ির বিরুদ্ধে বধূ নির্যাতনের মামলা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। শহরের আদালতে মামলা দায়ের করা হলো। দিশা অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আমাকে আশ্বস্ত করেছিল যে আমি মামলা জিতবোই। এখন আমি মামলা জেতার মুখেই।”

অফিসাররা বিস্মিত হয়ে বললেন ,-” এমন কি প্রমাণ আছে যে আপনি মামলা জিতবেনই?”
যুথিকা বললো,-” ভিডিও রেকর্ড। আমাকে ঘরছাড়া করার ষড়যন্ত্রের রেকর্ড এবং রাকেশের বন্ধু যে নোংরামি করার চেষ্টা করেছিল তার রেকর্ড। আমি এই কাজটা খুব সাবধানেই করেছিলাম। শুধু তাই নয় রেকর্ডেড ভিডিও দিশার মোবাইলেও পাঠিয়ে দিয়েছিলাম যাতে আমার মোবাইল চুরি বা নষ্ট হয়ে গেলেও ভিডিও না নষ্ট হয়। এ সংগ্ৰামে আমার সম্মান এবং জীবন দুটোই রক্ষা করতে হবে আমাকেই। আমি তো ভীষণ একা।
শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে মামলা করেছি,তাই এই নীচের রুমটাতে ঠাঁই হয়েছে। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতেই আছি। আর কিছুদিনের মধ্যে পূর্ণ মর্যাদা ফিরে পাবোই পাবো এবং ওদেরকেও আমার কাছে অপরাধ স্বীকার করতেই হবে।”
যুথিকার সুন্দর এবং প্রতিবাদী দুটো চোখ বেয়ে নেমে এল অশ্রুধারা।
পুরো ঘটনা শুনে নারী সুরক্ষা দপ্তরের অফিসাররা বললেন,-” আপনি এই মামলা অবশ্যই জিতবেন। কোনরকম অসুবিধায় পড়লে আমাদের জানাবেন। আমরাও আপনার পাশে আছি। আপনার অধিকার এবং যর্যাদা আপনি অতি শীঘ্রই ফিরে পাবেন। শুভ কামনা রইলো।”

Loading

Leave A Comment