।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার এর গল্প।।
অতসীর প্রেম
-শচীদুলাল পাল
আসনবনি গ্রামে একদিকে রেল লাইন অপর দিকে শস্যক্ষেত ও ঘন গাছপালার সবুজের সমারোহ। পুকুর পুস্করিণীতে ভরা এই গ্রামটিতে অধিকাংশ অধিবাসী কৃষি নির্ভরশীল। অনেকে জীবিকার জন্য গ্রাম ছেড়ে শহরে এমনকি অন্য রাজ্যে পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছে।
সেই গ্রামের একান্নবর্তী মিত্র পরিবারের এক অপরূপা সুন্দরী কিশোরী অতসী পড়াশোনা খেলাধুলা গান নিয়ে বড়ো হচ্ছিল। মায়ের খুব আদুরে। মা তার কোনো কিছুতে বাধা দিতনা।
গ্রামের হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়তো। চোদ্দ বছরের অতসীর দেহসৌষ্ঠব চোখে পড়ার মতো আকর্ষণীয়। প্রস্ফুটিত পুষ্পের মতো বালিকাটি পরিবারের ও সারা গ্রামের সবার প্রিয় ছিল। বাড়ি থেকে কিছু দূরে এক সরোবর।
নাম তার ভাগা বাঁধ। সেখানকার জল বড়ো স্থির। বাঁধের চারপাশে গাছের ছায়া, রাঙা মেঘের ছায়া। অসংখ্য ছোট বড়ো মাছেরা খেলা করত। মনে হতো এই সামনে এসে ধরা দেবে। অতসীর এই সরোবরে স্নান করতে ভাল লাগতো। বিশাল জলাশয়ের একদিকে মেয়েরা, বিপরীতে ছেলেরা স্নান করতো।
সেদিন ছিল ছুটির দিন। অতসী গ্রামের এক বৌদির কলসি নিয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে অনেক দূর চলে গেছিল।
হঠাৎ মাঝ সরোবরে অতসীর হাত থেকে কলসিটি ছিটকে হাতছাড়া হয়ে গেলো । বালিকা অতসী আপ্রাণ চেষ্টা করল। কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে, ক্লান্ত হয়ে আর পারছিল না। মনে হচ্ছিল সে আর পারবেনা।
মরে যাবে। তলিয়ে যাবে। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে প্রাণপণে চীৎকার করলো
বাঁ চা ও। বাঁ—- চা —-ও।
সরোবরে তীরে এক মহা সোরগোল পড়ে গেলো।
অতসী ডুবে যাচ্ছে। মেয়েটা ডুবে গেলো। কেউ বাঁচাও ওকে।কিন্তু
কেউ আর নামলো না। ডুবন্ত কাউকে বাঁচাতে গেলে তারই তো নিশ্চিত মৃত্যু। তাই কেউ সাহস করে নামলো না।
নির্ঘাত মৃত্যুর কোলে অতসী নিজেকে সঁপে দিল।
ওপারে একটি ছেলে চীৎকার শুনে নিজ জীবন বিপন্ন করে জলে ঝাঁপ দিল। দ্রুত সাঁতার কেটে মেয়েটির কাছে আসতেই দেখলো মেয়েটি তলিয়ে যাচ্ছে। সে ডুব সাঁতার দিয়ে খুঁজে বার করলো মেয়েটিকে। পিঠে চাপিয়ে জলের উপরে উঠলো।
ডুবন্ত প্রাণী একটা খড়কুটো যা পাই সেটাকেই সে আঁকড়ে ধরে।এক্ষেত্রে জলমগ্ন অতসী
ছেলেটির পিঠে উঠে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো।
ছেলেটা ঈশ্বরের অসীম কৃপায় দেখলো সামনে এক কলসি ভাসছে।
এক হাতে কলসি, পিঠে অতসী দুপায়ে ও একহাতে সাঁতার কাটতে কাটতে মেয়েদের ঘাটে উপস্থিত হলো। দেখলো ঘাটে অনেক মেয়েদের ভীড়। সবাই তাকে বাহবা দিলো। অতসী চোখ মেলে ছেলেটির দিকে অপলকে তাকিয়ে রইল। ইশারায় কাছে ডাকলো ছেলেটিকে। ছেলেটি কাছে আসলে অতসী জড়িয়ে ধরে দুচোখ বন্ধ করলো।
গ্রাম থেকে গ্রামে এই খবর ছড়িয়ে পড়লো।অতসীর পরিবার ও পাঁচ গাঁয়ের সবাই ছেলেটির প্রসংশায় পঞ্চমুখ হলো।
দশম শ্রেণীর ছাত্র ষোলো বছরের বিপিন দাস বেশ লম্বা।নিকষ কালো গায়ের রঙ।ফুটবল দলের স্ট্রাইকার। পড়াশোনায় মন্দ নয়।শান্ত স্বভাবের বিপিন খুব নম্র ও ভদ্র। বিপিনদের আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল নয়। বাবা দিনমজুর। মা অন্যের ক্ষেত খামারে কাজ করে। দু’দুটো দিদির বিয়ে দিতে গিয়ে বাবা নিঃস্ব।
স্কুল ছুটির পর অতসী প্রতিদিন এক একেকটা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে এক ঝলক দেখবে বলে। কিন্তু সাহস করে কথা বলতে পারে না। শুধু নিষ্পলকে তাকিয়ে থাকে।
ঘরে গিয়ে রাতে শুধু ভাবে বিপিনের কথা। অনেকদিন ভেবে ভেবে রাত শেষে ভোর হয়ে যায়।
একদিন স্নান সেরে ভিজে কাপড়ে ফিরছিল। রাস্তায় বিপিনের সাথে দেখা। অতসী ইশারায় এক গাছের নীচে ডেকে বলল,
— বিপিনদা। আমি তোমায় খুব ভালোবাসি। আমি তোমার কথা সবসময়ই ভাবি।
— আমিও।
অতসীর হৃদয় তন্ত্রীতে এক সুর ঝংকারিত হলো।
আবেগে বিপিনকে জড়িয়ে ধরল।
— আমি তোমার সাথে রোজ দেখা করতে চাই বিপিনদা।
—-সেটা কি সম্ভব? আমরা অপ্রাপ্তবয়স্ক। গ্রাম্য সমাজ কি বলবে?
— তাহলে ফোন করবে।
— আমার তো ফোন নেই।
আমরা ভীষণ গরীব।
— আচ্ছা। আমি তোমাকে আমার একটা
পুরানো ফোন দেব আর কিছু টাকা দেব। তুমি নতুন সিম কিনে আমার সাথে কথা বলবে।
ভিডিও চ্যাট করবে।
—-আমি এসব জানিনা।
— আচ্ছা। কাল তুমি আমার ঘরের সামনে মাঠে সন্ধ্যায় আসবে। আমরা গাছের আড়ালে দেখা করব। আমি ভিডিও করাও শিখিয়ে দেব।
এভাবে কিশোর কিশোরীর ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব এক গভীর ভালোবাসায় পরিনত হলো।
তারা এখানে সেখানে দেখা করতে লাগলো।
কাঁচা থেকে ডাঁসা।ডাঁসা থেকে সুপরিপক্ক সেই প্রেম দুজনের হৃদয়ে স্থায়ী বাসা বাঁধলো।
দিনেরাতে ফোনে মেসেঞ্জারে সংগোপন সাক্ষাতে তাদের প্রেম ঘনীভূত হলো।
এভাবে চলতে চলতে একদিন দুজনে বড়ো হলো। অতসী স্থানীয় কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট ও বিপিন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করলো।
এখন কুড়ি বছরের উদ্ধত যৌবনা ফর্সা সুন্দরী ত্বন্বী অতসী একদিন বিপিনকে বললো
— চলো একবার আমরা দুজনে তারাপীঠ ঘুরে আসি।
— তারাপীঠ?
— হ্যাঁ।সেখানে আমরা দুজনে মাকে দর্শন করবো। পুজা দেব।
— কিন্তু তুমি আমি একসাথে গেলে তোমার বাড়ির কেউ কিছু বলবেনা?
— না। আমি মিথ্যা বলে যাব।বান্ধবীদের সাথে যাচ্ছি বলব।
— কিন্তু আমার কাছে টাকা নেই এক্কেবারে। আমি ডিপ্লোমা পাশ। ইন্টারভিউ দিয়েছি অনেক। চাকরি হয়ে যাবে। তখন আমি নিজের টাকায় তোমাকে ঘুরতে নিয়ে যাব।
— ওরে বাবা। সে তখন কাছাকাছি নয়। দূরে অনেক দূরে নিয়ে যেতে হবে। এখন আমার ইচ্ছে তারাপীঠ যাব। তুমি রাজি কিনা বলো।
— বেশতো। তুমি যা বলবে তাই। রাজি।
— স্নান করে উপোস করে স্টেশনে আসবে। আমি টিকিট কেটে তোমার অপেক্ষায় থাকবো।
অনেক দেরি করে বিপিন এলো।
—-কি হলো এত দেরি।
—-কি করব!
উঠানে পড়ে গিয়ে মায়ের কপাল কেটে গিয়েছিল।
আমি হাস্পাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল।
— এখন কেমন আছেন?
— দুটো স্টিচ দেওয়া হয়েছে। সম্পূর্ণ সুস্থ।
—-চলো তাড়াতাড়ি। শেষ লোকালের সময় হয়ে গেছে।
লোকালে চেপে তারা যখন মন্দিরে পোঁছালো তখন সন্ধ্যারতি হচ্ছে।
দুজনে ভীড় ঠেলে মন্দিরে প্রবেশ করতেই পুরোহিত বিপিনের কপালে সিঁদুরের টিপ দিয়ে বলল —
— এই সিঁদুর মেয়েটির সিঁথিতে পরিয়ে দাও।
— কিন্তু
— কোনো কিন্তু টিন্টু নয়। চলো। ভীড় হটাও।
ঘটনাচক্রে বিপিন পুরোহিতের দেওয়া সিঁদুর অতসীর সিঁথিতে দিতেই মন্দিরে কাঁসর ঘন্টা বেজে উঠলো।
দুজনেই শিহরিত হলো।এক অপুর্ব আনন্দে আনন্দিত হলো।
তারা ছুটতে ছুটতে স্টেশনে আসতেই শেষ লোকালও চলে গেলো। অগত্যা দুজনে মন্দির চত্ত্বরে ফিরে এসে রাত্রিযাপনের জন্য হোটেলের
খোঁজ করলো।
এক হোটেলে এসে যখন তারা বললো আমরা দুজনে দুজনকে ভালো বাসি। স্বামী স্ত্রী নই।কেউ রুম ভাড়া দিতে রাজি হলো না। তাদেরকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগলো।
অগত্যা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে অন্য হোটেলে রুম ভাড়া পাওয়া গেল। হোটেলে ঢুকে আলো জ্বালতেই দেখলো এক বিশাল আয়না। অতসির সিঁথিতে জ্বলজ্বল করছে সিঁদূর। অপলক তাকিয়ে থাকলো দুজনে। ব্যাগ থেকে একজোড়া প্লাস্টিকের শাঁখা বের করে অতসী বলল
—- এটা পরিয়ে দাও।
— এখনই পরানোর সময় হয়নি অতসী।
আমাকে চাকরি পেতে দাও।
— সবই হবে। কিন্তু এই মুহূর্ত কখনো ফিরবেনা। তুমি মনে প্রাণে আমার স্বামী।
জোর করে হাতে দিয়ে বললো পরিয়ে দাও।
অগত্যা বিপিন বাধ্য ছেলের
মতো অতসীর দুই হাতে শাঁখা পরিয়ে দিল।বাইরে তখন দূর গ্রামে কোথাও বিয়ে বাড়ির মন্ডপ থেকে শঙ্খ ও উলুধ্বনির শব্দ ভেসে আসছে।
অতসী আবেগে বিপিনকে জড়িয়ে ধরে ঘনিষ্ঠ হলো।বিপিনের পুরুষ্ট বুকে নিজেকে সমর্পণ করে বললো
— এখন থেকে আমরা স্বামী স্ত্রী।
এসো আজকের এই রজনী আমরা এনজয় করি।
বিপিন শিহরিত রোমাঞ্চিত হলো। বললো
— আজ আমাদের বিবাহ রজনী
দুটি অভিন্ন হৃদয় মন দেহ বারেবারে মিলিত হলো।
রাত শেষে সকাল হলো। চোখে সূর্যের আলো পড়তেই বিপিনের ঘুম ভেঙে গেলো। দেখলো বিছানায় অতসী নিশ্চিন্তে অকাতরে ঘুমাচ্ছে। আলু থালু প্রায় বিবস্ত্র বেশবাস। সূর্যরশ্মি অতসীর সর্বাঙ্গ ছুঁয়ে যাচ্ছে।অতসীর ফর্সা নিটোল দেহ থেকে এক রশ্মি যেন ঠিকরে বেরচ্ছে। অপুর্ব মোহময়ী লাগছে। সে তার দু’চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা, এত সুন্দরী তার জীবনসঙ্গিনী!এতো সেই কল্পলোকের রাজকন্যা তার শয্যাসঙ্গিনী।
বিপিন আলতো চুম্বন দিতে গিয়ে অতসীর ঘুম ভেঙে গেলো। তার এই চুরি করে দেখাতে ছেদ পড়লো। অতসী বিপিনের বুকে মাথা রেখে আবেশে জড়িয়ে ধরল।
দরজায় কলিং বেলের আওয়াজে দুজনে ধড়ফড় করে উঠলো।
দরজা,খুলতেই দেখলো হোটেল বয় চায়ের ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে।
জিজ্ঞেস করল
—- আজ আপনারা কি কি খাবেন? খাবার কি রুমে দিয়ে যাবো?
বিপিন কিছু বলতে যাচ্ছিল, অতসি মেনু কার্ড দেখে খাবারের অর্ডার দিয়ে বলল— —-খাবার রুমেই দিয়ে যাবে।
এভাবে দিন তিনেক হোটেলে রাত্রিযাপন করে তারা ফিরে এলো। মাঝখানে মায়ের ফোন এসেছিল। অতসী মাকে বলে দিয়েছে সে বান্ধবী শিলার বাড়িতে আছে। একদিন বাদে ফিরবে।
অতসী নিজের গ্রামের স্টেশনে পৌঁছে কলের জলে সিঁথির সিঁদুর মুছে ফ্রেস হয়ে আলাদা আলাদা পথ ধরে ঘরের দিকে রওনা দিল।
বাড়িতে পৌঁছে একমাত্র মেয়ের মাথায় মুছে ফেলা হয়েছে এরূপ সিঁদুরের আভার দিকে তাকিয়ে সন্দেহ হলেও কিছু বললো না মা মিতাদেবী।
শুধু বললো বাইরে থেকে এসেছো যাও বাথরুমে শ্যাম্পু মেখে ভালো করে স্নান করে এসো।
বাথরুমের আয়নায় অতসী নিজেকে দেখে শিউরে উঠলো।
🎒🎒🎒🎒🎒🎒🎒🎒🎒
যতই লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করুক মায়ের মন ঠিক বুঝে নিতে দেরি হলো না।
রাতে অতসীর বাবাকে বলে ঠিক হলো অতসীর বিয়ে দিয়ে দেবে। যথারীতি ঘটক নিযুক্ত করা হলো। অনেক সম্বন্ধ এলো, তার মধ্যে একটি খুব ভালো ছেলে। দূর সম্পর্কের আত্মীয়। স্বজাতি। পাশের গ্রামেই বাড়ি। কলেজের প্রিন্সিপাল। বয়স অল্প বেশি। সাড়ে সাঁয়ত্রিশ।অর্থাৎ সতেরো বছরের পার্থক্য।
ছেলে ও বাড়ির সবাই কোনো এক অনুষ্ঠানে মেয়েকে দেখেছে।
দুই বাড়ির সবার পচ্ছন্দ।
বিয়ের কথাবার্তা অনেকটা এগিয়ে গেলে একদিন মা মিতাদেবী অতসীকে বললো
— মা অতসী। তুই বি.এ পাশ করেছিস। দেখতে আরও অনেক সুন্দরী হয়েছিস। এবার তোর বিয়ে দিয়ে দেব।
— না।
— না কেন? মানে কি।
—- মানে আমি এখন বিয়ে করবো না।
— কেন?
—- এমনি।
— দেখ মা। তোর বিয়ের বয়স হয়েছে। ঠিক সময়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়াটা পিতামাতার কর্তব্য।
— কিন্তু আমি তো এখন কুড়ি।
— হলোই বা। এত ভালো ছেলে!
হাতছাড়া কেন করব।জানিস ছেলেটা কলেজের প্রিন্সিপাল । তুই এক প্রিন্সিপালের বউ হবি। গর্বে তোর ও আমাদের বুক ভরে যাবে।
—- আমি বিয়ে করবই না।
— কেন।
— আমার বিয়ে হয়ে গেছে।
—- কি বলছিস তুই?
— হ্যাঁ। হ্যাঁ। ঠিকই বলছি।
হঠাৎ মিতাদেবীর সেইদিনের সিঁথিতে সিঁদুরের আভার কথা মনে পড়লো।
দুরুদুরু বুকে জিজ্ঞেস করলো। কে সেই তোর বর?
— এবার বলো তোমরা মেনে নেবে?
— নামটা বল?
— বলো মেনে নেবে?
—- যদি কলেজ প্রিন্সিপাল মলয়বাবুর চাইতে ভালো হয় তাহলে মেনে নেব।
— কার চেয়ে কে ভালো সেটা আমার দেখার দরকার নেই।
— বেশতো। নামটা বল?
—- ছেলেটাকে তোমরা কেন দশখানা গাঁয়ের সবাই চেনে।
— কে সে? নাম কি?
— নাম তার বিপিন দাস।
— যে তোকে জল থেকে তুলে তোর প্রাণ বাঁচিয়েছিলো?
—- হ্যাঁ হ্যাঁ।আমি তাকে মন দিয়েছি। সেই আমার জীবন সঙ্গী।
—- হে ভগবান! কি বলছিস তুই। নিকষ কালো গায়ের রঙ।গরীব। নীচ জাত।বেকার।বাবা দিনমজুর, মা ক্ষেত খামারে কাজ করে। অশিক্ষিত পরিবার। কোনো দিক থেকেই সে তোর উপযুক্ত নয়।
—- তোমার মেয়ে তো মরেই গেছিলো। ওইতো তোমার মেয়েকে তোমার কোলে ফিরিয়ে দিয়েছে। আজ সে অচ্ছুৎ! বাঃ।
একটা কথা তোমরা ভালো করে শুনে রাখো বিয়ে করলে আমি বিপিনকেই বিয়ে করব। না হলে কাউকেই বিয়ে করব না।
(যতই মিতাদেবী মুখে বলুক না কেন, অন্তরে বিপিনের উপর একটা টান জন্মে গিয়েছিল।তার একমাত্র কন্যার প্রাণদাতা।) তবুও বললেন
— এই তোর শেষ কথা?
— হ্যাঁ।
— আমি তোর বাবা ও পরিবারের সবাইকে বলে দেখি।
🗻🗻🗻🗻🗻🗻🗻🗻🗻
বাবা কাকা জ্যাঠামশাইরা একে একে, একসাথে এসে অনেক বোঝালো। কিন্তু কোনো মতেই রাজি করা গেলো না।
তারা হাল ছেড়ে দিল।
অবশেষে বিপিন ও তার পরিবারেও কথাটা পৌঁছালো।
বিপিনের মা বাবা আচ্ছা করে ধমকে দিয়ে বিপিনকে বললো
—–বামন হয়ে আকাশের চাঁদ দেখছিস। ওই সুন্দরী শিক্ষিত জমিদার পরিবারের মেয়েকে ঘরে আনবি। সমস্ত গ্রাম একঘরে করে দেবে। দুমুঠো খাচ্ছিলাম তাও বন্ধ করে দিবি তুই।
যা এক্ষুনি গিয়ে মেয়েটাকে বলে আয়।
বিপিন মোবাইলে অতসীকে ডেকে পাঠালো মিত্রদের বাগানে সেই পরিত্যক্ত কুয়ার ধারে।
আকাশে মেঘের ঘনঘটা যেকোনো সময় বৃষ্টি আসবে।
আলো আঁধারিতে বিপিনকে দেখতে পেয়ে অতসী জড়িয়ে ধরে বললো
—- বাড়ি থেকে আমাকে অন্যত্র বিয়ে দিচ্ছে।
— বেশ তো?
—- আমার বিয়েতে মত নেই।
আমি তোমাকে আমার স্বামী বলে মনে করি। মায়ের মন্দিরে আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে।
— দেখো অতসী। তুমি আমাকে ভুলে যাও। আমি বেকার। চাকরি পেলেও বিশাল কিছু বেতন পাবোনা। আমরা গরীব।
তুমি আমাকে ভুলে যাও। আজ থেকে তোমার আমার সম্পর্ক এখানেই শেষ।
—- তা হয়না।
— আমি তোমাকে ভালবাসি।
তাই তোমার কোনো ক্ষতি আমি চাইনা।
বলতে বলতে বিপিন অতসীর ঠোঁটে চুমু খেয়ে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে রওনা দিল।
অতসী ডাকলো
—– বিপিন দা ——-
বিপিন ঘুরে দাঁড়াল।
অতসী সামনে এসে বলল
—- সামাজিকতা রক্ষার জন্য আমি বিয়ে করলেও তোমায় আমায় যোগাযোগ থাকবে। আমি বাপের বাড়ি আসলেই তোমাকে ডেকে পাঠাবো।
তুমি আসবে।
বিপিন মৌন থেকে সম্মতি জানাল।
🗻🗻🗻🗻🗻🗻🗻🗻🗻
মহাধূমধামে পাশের গাঁয়ের কলেজ প্রিন্সিপাল মলয় বোসের সাথে অতসীর বিয়ে হয়ে গেলো।
বহু নিমন্ত্রিত অতিথিদের উপস্থিতিতে ও আপাদমস্তক স্বর্ণালংকারে ভূষিত হয়ে অতসী শ্বশুর বাড়ীতে এলো।
সোহাগ রাতে বর এলো অনেক রাতে। এসে বলল।
—আমাকে কালই জরুরী কাজে কলেজে যেতে হবে। আজ বড্ড টায়ার্ড।বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়লো।
এই ঘটনা নিত্য ঘটতে লাগলো।
একদিন গভীর রাতে অতসী লক্ষ্য করলো খাতায় কি সব লিখছে।
কলম কেড়ে নিয়ে বলল
—-আমি আপনার বউ।আজ প্রায় দু মাস হয়ে গেলো আমাদের বিয়ে হয়েছে।
আমি প্রতিদিন আপনার অপেক্ষায় থাকি।
আপনি অনেক শিক্ষিত। আমি মনে হয় আপনার উপযুক্ত হতে পারিনি।
_ নানা তেমন কিছু নয়। আমি নানান কর্মে ও চিন্তায় ব্যস্ত থাকি। তোমার সঙ্গ দিতে পারিনা। তাছাড়া তুমি বিয়ের পর অনেকবার বাপের বাড়ি গিয়েছো। কোনো বাধা দিইনি। আর দেবোও না। তোমার কিছু দরকার হলে মাকে বলো। কাজের মেয়েটাও দীর্ঘদিন ধরে আছে। যা কিছু প্রয়োজন ওকে দিয়ে আনিয়ে নিও।
এভাবে দিন চলে যায়।
অতসী তার স্বামীর খুব খেয়াল রাখে। সকাল বেলা বেড টী থেকে জল খাবার লাঞ্চ প্যাক নিজে হাতে বানিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে দেওয়া থেকে ফোন করে খোঁজ নেয় যে মলয় বাবু খাবার খেয়েছে কিনা? রাতে এসেও শুধু কাজ আর কাজ। বউকে আদর করার এক বিন্দু ফুরসৎ
নেই। ফুরসত নেই বউয়ের সাথে কথা বলার। বিছানার যে কি আনন্দ সেতো অধরাই থেকে গেলো।
এভাবে মাস দুয়েক কেটে গেলো। শাশুড়ী মা খুব ভালো বাসেন। খুব ভালো।
ইদানীং একটা কেমন যেন সন্দেহ দানা বাঁধতে লাগলো।
তার স্বামীর তার প্রতি এত অনীহা কেন?
গভীর ঘুমের ভান করে সে জেগে জেগে ফলো করল।
দেখলে তার স্বামী অন্য কোনো মহিলার প্রতি আসক্ত।
একদিন অতসী বলেই দিল আমাকে যদি আপনার পছন্দ ছিলোনা তাহলে বিয়ে করেছেন কেন? আমাকে বাপের বাড়ি পৌছে দিয়ে আসুন।
— সেতো যাচ্ছো আসছো।অবাধ স্বাধীনতা। এই দু-মাসে কতবার যাওয়া হলো গুনেছো?
দেখো অতসী। তুমি আমার বউ। তোমার গর্ভে সন্তান হলে সেই হবে এই আমার বিষয় সম্পত্তির ওয়ারিশ।এই বাড়িতে সবকিছুতে পূর্ণ অধিকার তোমার।
— আর ভালোবাসা?
—-ভালোবাসা। ওসব ছেলে ছোকরাদের কাজ কারবার।
এর বেশি আমার কাছ থেকে
আশা করো না।
— বুঝেছি। আমার মতো অসুন্দর মেয়েকে আপনার পছন্দ নয়।
— না না। তা নয়। তুমি প্রকৃত সুন্দরী। রূপ লাবন্য ফিগার সত্যি প্রসংশার যোগ্য। আমি ও আমার পরিবার প্রতিমার মতো সুন্দরী বউ পেয়ে গর্বিত।তোমার মতো এক সুন্দরী বউ শিক্ষাজীবনে ট্রিপল এম.এ,
ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট, ডক্টোরেট সহ আমার অনেক সার্টিফিকেটগুলির চেয়েও মূল্যবান অলংকার।
— আমাকে অলংকার ভেবে গলায় ঝুলিয়ে রাখা যায়, লকারে রাখা যায়, কিন্তু বিবস্ত্র করে ভোগ করা যায়না!
অর্থাৎ আমি শো কেসের পুতুল। আমার সুন্দরতা নিয়ে গর্ব করা যায়, কিন্তু বিছানায় তাকে আনন্দ দেওয়া যায়না।
আমাকে সুন্দরী বউ বলা যায় কিন্তু পার্টিতে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায়না!
— অনেকটা তাই।
— আমি সব জানি। সব জেনেছি আপনার মোবাইল থেকে। আপনি শুধু আমাকে বঞ্চিত অবহেলিত করেননি। আপনি নিজেও পরকীয়ায় লিপ্ত। আপনার অন্য এক প্রেমিকা আছে। তার সাথে আপনার বিছানার সম্পর্ক আছে।
— (কিছুক্ষন নিরুত্তর থেকে)
যদি তাই হয় তাতে অসুবিধা কোথায়? পরকীয়া এখন বৈধ।সুপ্রিম কোর্ট তো রায় দিয়ে দিয়েছে।
তুমি উচ্চশিক্ষিত নও তা সত্ত্বেও তোমাকে আমার স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছি এবং দিয়ে যাব চিরদিন। তোমার হাজার খুঁত থাকলেও আমার স্ত্রীর মর্যাদা তুমি পাবে। এটা কী ভালোবাসা নয়?
—-বেশ আমি আপনার সম্মানহানি করবো না।আপনি শিক্ষিত মহলের গর্ব। আমরা আপনাকে পেয়ে গর্বিত।
দয়া করে আপনার এই কারাগার থেকে আমাকে মুক্তি দিন।
—- মুক্তি মানে? ডিভোর্স?
— না ডিভোর্স চাই না। আমি জানব আমার কোনো বিয়েই হয়নি।
— তোমাকে আমি স্বাধীন করে দিলাম। তুমি আমার পথে বাধা দেবেনা।অনেক দায়িত্ব একটা কলেজ প্রিন্সিপালের।
তুমি আমার স্ত্রী হয়ে থাকো।
— আমাকে কালই নিজের গাড়িতে আমায় বাপের বাড়ি পৌছে দিন।
এক ছুটির দিনে প্রিন্সিপাল জামাই শ্বশুর বাড়ি এলো। মিত্র পরিবারের বাড়িতে এক মহা ধুমধাম পড়ে গেলো।
সবারই কাছ থেকে সমাদর গ্রহণ করে মলয়বাবু সন্ধ্যায় নিজের বাড়িতে ফিরে গেলো। দুটি পিঞ্জর-বদ্ধ বিহঙ্গ মুক্ত হলো।
🥦🥦🥦🥦🥦🥦🥦🥦🥦
নিরিবিলিতে অতসী ফোন করলো বিপিনকে।
– বলো কেমন আছো অতসী?
— আমি ভালো নেই। আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই আজ এই মুহুর্তে। মিত্র বাড়ীর বাগানে। সেই পরিত্যক্ত কুয়া তলায়।
— তা হয়না অতসী। তুমি এখন অন্য কারোর বউ।আমি তোমার ভালো চাই। তুমি সুখে থাকো।
জানাজানি হলে কেলেঙ্গারি হবে।
— এর আগে তুমি আমি বিয়ের পর কতবার মিলিত হয়েছি। কতবার দেহ মিলন হয়েছে কই বাধা দাওনি।
আমরা তো আমার বেডরুমেও মিলিত হয়েছি। মা দেখেওছে।
— আমরা এক বিপদজনক কর্মে লিপ্ত। আমি আর আসব না।
—-কি বললে? তুমি আসবেনা?
বেশ তাহলে শুনে রাখো
তুমি যদি না আসো তাহলে আমার মরা মুখ দেখবে।
—এরূপ অলক্ষুণে কথা বলবে না।
—
রাত্রে খাওয়া দাওয়া শেষে যখন মিত্র বাড়ির সবাই নিজ নিজ ঘরে বন্দী। কেউ টিভি দেখছে কেউ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সেই সময় অতসী ঘর থেকে বের হয়ে মিত্র বাগানে পরিত্যক্ত কুয়া তলায় পৌঁছে দেখলো বিপিন আগে থেকেই অপেক্ষা করছে।
অতসী বিপিনকে দেখে দুহাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করে বললো
— আমি চলে এসেছি বিপিনদা।
চলো আমরা পালিয়ে যায়।
— কি বলছো তুমি। আমি বেকার ছেলে আমরা কি খাব?
কোথায় থাকবো। বহু চেষ্টা করে চাকরি জোগাড় করতে পারিননি। ড্রাইভিংটা শিখেছি। এখানেই কোনো গাড়ি পেলে চালাব।
— আর তোমার কি খবর?
—- আমি আর শ্বশুর বাড়ি যাবনা। আমি ঠকে গেছি। তারপর একেএকে সব কথা বলে শোনালো।
মলয়বাবুর সাথে তাদের কথোপকথনের ভয়েস টেপ
ফরওয়ার্ড করে দিল বিপিনের মোবাইলে। শুনে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিও।
—- শুনে তাজ্জব হয়ে বিপিন অতসীকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলল
— ঈশ্বর আছেন। তিনি আমাদের দুজনের পুনর্মিলন ঘটিয়ে দিলেন।
—- হ্যাঁ। এবার তোমার কাছ থেকে একটা উপহার চাই।
—- আমি গরীব মানুষ। আমার সামর্থ্য নেই।
— যদি থাকে?
— আমার সামর্থ্য থাকলে আকাশের চাঁদকে তোমার হাতে দিয়ে দিতে পারি। বলো কি চাই?
— আমি চাই তোমার ঔরসজাত সন্তানের মা হতে।
হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এলো। সিক্ত বসনে তারা ঘনিষ্ট হলো।
🎇🎇🎇🎇🎇🎇🎇🎇🎇
এভাবে তারা সময়ে অসময়ে ঘরে বাইরে
বাগানে,গাড়িতে,সরোবরে মন্দিরে সুরম্য স্থানে কখনো অন্দরমহলে সান্নিধ্য লাভ করতে লাগলো।
ঘন ঘন মিলনে অল্পদিন পরেই অতসী গর্ভবতী হলো। মিতাদেবী নিজে গাড়ী করে শ্বশুর বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এলেন।
নিদিষ্ট দিনে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিল। মিত্র বাড়ি ও প্রিন্সিপাল স্যারের বাড়িতে খুশির বন্যা বইয়ে গেলো।
ছেলেটি অবিকল দেখতে অতসীর মতো।
মলয় স্যার শিশু পুত্র পেয়ে খুব খুশি। শিশুটির কপালে চুমু খেয়ে বললো
— বোস বাড়ির উত্তরাধিকার।
প্রিন্সিপাল ডঃ মলয় বোসের পুত্র।আমি তোমাকে অনেক অনেক শিক্ষিত করে তুলব।
দেখো দেখো মায়ের অবিকল রূপ। দেহের গঠন সবকিছুই মায়ের মতো। তুমি মায়ের মতো অবিডিয়েন্ট হবে।
ঠাকুমা এসে বললেন
— মা গড়ানি ছেলে খুব সুখী হয়।
🥦🥦🥦🥦🥦🥦🥦🎉🎉🎉🎉🎉🔔🔔
মলয় স্যারের বাড়িতে আদরে সোহাগে লালিত পালিত হতে লাগলো শিশুটি।
অতসী তার ছেলের নাম রাখলো অবিনাশ।
অতসীর “অ” আর বিপিনের “বি” মিলিয়ে। ডাক নাম অবি।
সারা দুনিয়া মলয় বোস, কলেজ প্রিন্সিপালের পুত্র জানলেও ,
অতসী, বিপিন আর অতসীর মা শুধু জানলো শিশুটির জন্মদাতা পিতা হলো বিপিন।
অসাধারণ
ধন্যবাদ অফুরন্ত প্রিয় কবিবর। আপনার মন্তব্যে ও মুগ্ধতায় লেখনী সার্থক হলো।