।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
মুড়ি
-অঞ্জনা গোড়িয়া
ও মা আর দুটো মুড়ি দে না । কত দিন পর মুড়ি খেতে দিলি। তাও মোটে একঠোঙা।
ফুলো ফুলো মুড়ি খেতে বড্ড ভালোবাসি। আর দুটো দে না মা?
মা চোখ বড়ো বড়ো করে একটা ধমক। যা দিয়েছি খেয়ে নে বলছি। কিসের এত খিদে রে তোর?
ঠোঁট ফুলিয়ে খাদু ঠোঙাটা খুলতে খুলতে ই বলে উঠল, ক’দিন শুধু পান্তা আর পান্তা।
নুন মাখিয়ে খাচ্ছি। আর ভাল্লাগে না।
দে না মা আর কিছু মুড়ি।
দাঁত খিঁচিয়ে মা, শুধু খাই আর খাই। সারাদিন রাহুর খিদে। এবার আমার মাথাটা জিবিয়ে খা। এত খাবার কোত্থেকে জুটবে শুনি?
পাঁচ বছরের খাদু গুঁটিসুঁটি মেরে বসে থাকল ঘরের কোণে।
শেষ হয়ে যাওয়া মুড়ির ঠোঁঙাটা। ফুঁ দিয়ে ফুঁলিয়ে আর ফাটাতে ইচ্ছে হলো না। হাতের তালুতে মুড়ে ফেলে দিল নর্দমায়।
সরমা মুখ চাপা দিয়ে সরে আসে বাইরে। চেঁচিয়ে কাঁদার ও উপায় নেই।
এই কদিনে ই খাঁদুর মা সরমা কেমন বদমেজাজি খিটখিটে হয়ে গেছে। এমন তো ছিল না সরমা। খাঁদু এই মাকে চেনে না।
মায়ের কী হয়েছে? এত রাগ কেন করে খাঁদুর ওপর। দুটো মুড়ি ই তো চেয়েছে।
খাঁদু গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ে কাঠের তক্তায়। আঙুল চুষতে চুষতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে। সে জানে না।
সরমা গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
গালে একটা হালকা চুমু খেতে গিয়ে থেমে গেল। যদি কাঁচা ঘুমটা ভেঙে যায়।
আর নরম হলে চলবে না। আরও আরও কঠিন হতে হবে। সমস্ত সমাজটার ওপর একটা ঘেন্না ওর চোখে মুখে।
থু থু। ধিক ধিক! এই সমাজ। এই পুরুষ গুলো কে সে ঘেন্না করে খুব।
আঁচল পেতে শুয়ে পড়ল মেজেতে । তবু ঘুম আসে না। খালি পেটে কী করে আসবে ঘুম? কত কথায় মনে পড়ছে আজ।
আজ ই সেই দিন টা। যেদিন খাঁদুর বাবা ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে ফিরে এল অন্য রাজ্য থেকে। দিব্যি ছিল মায়ে ছেলেতে। বর বাইরে সোনার কাজ করত। যা উপার্জন তাতে ই চলে যেত ভালো ভাবে। কিন্তু লকডাউনে পড়িমরি করে ফিরতে বাধ্য হলো পরিযায়ী শ্রমিক খাঁদুর বাপ ।
কিছুদিনের মধ্যেই জানা গেল খাঁদুর বাপ করোনা পজেটিভ। নিয়ে গেল হসপিটাল।
তারপর সব শেষ। সে যাত্রায় বেঁচে গিয়ে ছিল খাঁদু আর তার মা।
গাঁয়ের মানুষ তারা। ঘর টুকু ছাড়া আর কিছুই নেই। সর্বস্ব কিনে খেতে হয়। খাঁদু স্কুল থেকে কিছু চাল আলু ডাল পায় আর রেশনের চালে দিন চলে।
তার পরে ও তো থাকে কিছু খরচ। কাজে ঢুকল দত্ত বাড়িতে। সারা মাস গায়ে গতরে খেটে মোটে ৫০০ টাকা।
সেদিন হঠাৎ কালো মেঘে ঢেকে গেল আকাশ। ঝড় উঠলো। প্রবল ঝড়। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আকাশে। আলোর ঝিলিক সারা গায়ে।
ইলেক্ট্রিক অফ। খাঁদু বাড়িতে একা। হাতের কাজ টা সেরে ই সরমা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসতে গেল।
কর্তা মা বাড়ির ভেতর। কিছু ই টের পেল না।
কেউ একজন চেপে ধরল মুখ। আঁচল টা টেনে দিল।
খুলে নিল শরীর থেকে কাপড়টা।
পিছন ফিরে তাকানোর জো নেই।
হাত দুটো কাপড়ে বেঁধে দিল।
অন্ধকারের মধ্যে হিংস্র পশুর মতো দুটো নোংরা হাতে জাপ্টে ধরল খাঁদুর মাকে। গোঁ গোঁ শব্দে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা। শক্ত করল মন। সর্ব শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিল দরজায়।
পশুটা পড়ে গেল। হাতের বাঁধন আলগা হলো। আলো আঁধারীর মাঝেই হাতের কাছে ছিল লম্বা বটি।
বাঁধন খুলে তুলে নিল হাতে। মা কালীর রুদ্রমূর্তির মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে খাঁদুর মা।
সারা শরীর কাঁপছে। হাজারো ঘেন্নায়।
পালিয়ে প্রাণ বাঁচাল পশুটি।
কিন্তু খুলে গিয়েছিল হাতের সোনার আংটি ।
সেই টুকু সঙ্গে নিয়েই টলতে টলতে বাড়ি ফেরে ঝড়ের রাতে।
খাঁদু তখনও ঘুমায় নি। মায়ের অপেক্ষায় জড়ো সড়ো হয়ে শুয়ে ছিল ঘরের কোণে।এমন অবস্থা দেখে খাঁদু ভয় পেল। কী হয়েছে মা? সরমা কোনো উঠে দিল না। ঘুমিয়ে পড় খাঁদু। কিছু হয় নি আমার।
পরের দিন কাজে গেল শান্ত মনে।
বাড়ির কর্তার হাতে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে ভয়ে ভয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। কর্তা মা ভারী গলায় জানিয়ে দিল আজ থেকে আর কাজে এসো না।
কর্তা মশাই চায় না এই করোনার সময় বাড়িতে কেউ কাজ করুক। তোমার পাওনা গণ্ডা মিটিয়ে দিচ্ছি।মানে মানে বিদেয় হও তো বাপু।
খাঁদুর মা প্রস্তুত নিয়েই এসে ছিল আজ।
ভরসা করে বললো, তা তোমার কর্তাবাবু টি কই গো? করোনায় বিছানা নিয়েছে বুঝি?
আরে না না, কাল ঝড়বৃষ্টিতে ধাক্কা লেগে হাতে চোট পেয়েছে। তাই বিশ্রাম নিচ্ছে।
তা কোথায় ধাক্কা লাগল কর্তা মা। জিজ্ঞাসা কর নি?
তোমার এর খবর নেওয়ার দরকার কী শুনি?
ঠিক আছে কর্তা মা, তাহলে এই আংটি খানি থানায় জমা দিয়ে আসি। কেমন? কাল ঝড় বৃষ্টিতে কুঁড়িয়ে পেলুম। গরীব হতে পারে,তাবলে চোর নই তো।
ভেতর থেকে শুনতে পেয়ে, আরে ওটা আমার আংটি। ওর কাছ থেকে নিয়ে বিদায় করো।
তাই বুঝি কর্তা বাবু? তা খুলল কী করে শুনি? একটু গল্প টা বলো দেখি কর্তা মা ও শুনুক।
বিড়বিড় করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে একপ্রকার ছিনিয়ে নিল আংটি। সত্যিই কাল ধ্বস্তাধস্তিতে কখন খুলে গিয়ে ছিল বুঝতে পারে নি।
খাঁদুর মাকে থামাতে হবে। ওকে আরও কিছু টাকা দিয়ে বিদেয় করে দাও।
রাতের অন্ধকারের পশুটার চেহারা দিনের আলোতে ও কালো হয়ে গেল।
খাঁদুর মা আর তর্ক না করে বাড়ির দিকে ফিরল।
অনেক দিনের লোভ ছিল। অনেক টাকা বকশিস ও দেবে বলে ছিল কিন্তু পারে নি পোড়ামুখিটা। নিজের দেহ বেচতে। খাঁদুর বাপকে যে বড্ড ভালোবাসে।
কাজ খুইয়ে ৩২ বছরের যুবতী বাড়িতে একা।
খাঁদুকে মানুষ করতেই হবে। কদিন রেশনের চালের ভাত পান্তা খেয়ে কোনো ক্রমে চলছিল।
এভাবে থাকলে খাঁদু টা মরে যাবে।
আবার সন্ধানে নতুন কাজের। আর লজ্জা নয়। চরিত্র নিয়ে করবে কী? বাঁচতে হবে। বাঁচাতে হবে খাঁদুকে।
চোখের জল মুছে খাঁদুকে ঘুম পাড়িয়ে চলল খাঁদুর মা।
বলে গেল শুধু আর কাঁদিস না। তোর জন্য মুড়ি আনছি। রাজভোগ আনব।
মন্ডা মিঠাই সব। আমি এখুনি আসছি।
অন্ধকার গলিতে হারিয়ে গেল খাঁদুর মা। পরনে ছিল চকচকে শাড়ি ঠোঁটে লিপস্টিক। হাত ভর্তি রঙিন চুড়ি।