Site icon আলাপী মন

গল্প- স্মৃতির পাতায়

।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।

 

স্মৃতির পাতায়
-সুমিতা পয়ড়্যা

 

 

তমসা এখনো বসে বসে ভাবছে সেই দিনগুলোর কথা। আজ তমসার শাশুড়ি মায়ের বাৎসরিক কাজ শেষ হলো। ঘর গোছাতে গোছাতে ছবিটির সামনে বসে পড়ল, চোখে জল, ডুকরে ডুকরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকলো। মনের ভেতর দিয়ে এক ঝড় বয়ে গেল এক লহমায়। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যেন এক আবর্তে ঘিরে থাকা পুরো অজানা গল্পটা পড়ে ফেলল এক মুহুর্ত।
জন্মের পর জ্ঞান হবার মুহূর্ত থেকেই কালী কালী শুনে বড় হয়েছে তমসা। সত্যিই এত কালো যে তা বলার অপেক্ষা রাখে না; পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে শুনতে-শুনতে কখন যেন আর ভালো নামের আড়ালে ডাকনামটাই বেশি প্রচলিত হয়ে গেছে। কালী বলে পাড়াই পরিচিতি।
22 বছর সংসার করেছে, তার শাশুড়ি মায়ের কাছে থেকেছে কিন্তু কোনদিন শাশুড়ি মায়ের কাছ থেকে এমন কথা শোনেননি কিংবা কোন কাজে কোনো কটু মন্তব্যও কানে আসেনি– নিজের বাবা-মা যা অনায়াসে বলতে পেরেছিল যখন পাত্রপক্ষ পছন্দ করত না। কোন একদিন ছেলের বিয়ে দেবে বলে এই মা তো তমসাকে দেখতে এসেছিল। সবাই যেমন চা- জল- মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করে তেমনি করেছিল তমসার বাবা-মা। এই নিয়ে পঁচিশ জন পাত্রের বাড়ির লোক দেখে গেছে। কালোর জন্য কেউ পছন্দ করে নি। তমসার বাবা-মা জানতো এনারাও পছন্দ করবেন না। তবুও মেয়ের বিয়ে দেবার চেষ্টা তো করতেই হবে আর তাই দেখতে আসতে বলা এবং তমসাকে সামনে হাজির করা।
সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের তমসার জন্ম। এক দাদা, এক দিদি ও বাবা মাকে নিয়ে পরিবার। সবাই যেমন তেমন হলেও তমসার গায়ের রং খুব কালো। তাই ওর বাবা-মা আদর করে নাম রেখেছিল তমসা। মানুষ ভাবে এক আর হয় এক। যতদিন এগোচ্ছিল নামের তাৎপর্য সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিল। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবা মায়ের মনেও এক নীরব দ্বন্দ্ব শুরু হয়। খুবই খারাপ লাগত তমসার।
একের পর এক পাত্রপক্ষ দেখছে আর চলে যাচ্ছে। দ্বিতীয় বার আর কোন খবর আসছে না। এত কালো মেয়েকে নেওয়া যায় না। প্রত্যেকেই প্রথমে রূপ দেখে। তারপর গুণ বিচার করে। তমসা ছোট থেকেই খুব মেধাবী। সব কাজেই সে পারদর্শিতার পরিচয় দেয়। কিন্তু পাত্র পক্ষের কাছে সেটা ব্রাত্য। যাকে চোখে ধরছে না, তাকে মনেই বা ধরবে কেন! এইভাবে দিনগুলো চলছিল।
তবে তমসা এবার মনে মনে কি যেন একটা ঠিক করে রেখেছিল। যা কাউকে বলেনি। এমনকি বুঝতেও দেয়নি। দিন যায়-রাত যায় আর মনে মনে ভাবে তাকে একটা কিছু করতেই হবে। বাবা-মা তো কালো বলে চাকরি করা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে না সেটা তমসা বুঝেই গেছিল। দাদা দিদিদের বিয়ে হয়ে গেছে। এখন তারই পালা। কিন্তু পাত্রপক্ষ কিছুতেই তাকে পছন্দ করছে না। এমনই এক সম্বন্ধ আবার এলো এবং সেইদিনও উপস্থিত হল। পাত্রের বাবা-মা, মাসি মেসো, দিদি- জামাইবাবু দেখতে এলেন।
যথারীতি চা জলখাবার পরিবেশনের দায়িত্ব এল তমসার হাতে। একই প্রথা। নীরবে তমসা তা পালন করল। পরিপাট্য আভিজাত্যের একরাশ আন্তরিকতা। পাত্রপক্ষের আদব-কায়দা দেখে সবাই খানিকটা বুঝেই গেল যে, এটাও হবার নয়। তবুও পাত্রপক্ষ বলল বাড়ি গিয়ে আলোচনা করে জানাবো। ইত্যবসরে পাত্রের মা একটু বাইরে থেকে এসে ওয়াশরুম খুঁজতে লাগলেন। তখন তমসাই এগিয়ে এসে দেখিয়ে দিল। যখন উনি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলেন ঠিক তখনই তমসা উনার পা দুটি জড়িয়ে ধরল আর বলতে শুরু করল———-
মা, তুমি তো মা। একজন মেয়েও। তুমি সর্বংসহা। তুমি জগৎ জননী। তুমি তো সব জানো মা। তুমি জানো আমি কালো, আমাকে কেউ পছন্দ করছে না। এমনকি তুমিও না। তোমার বাড়ির লোকেরা ও না। কিন্তু তুমি তোমার সন্তানকে বাঁচাতে পারো। তুমি আমাকে বাঁচাও মা, বাঁচাও। না হলে আমার আর বাঁচার উপায় থাকবে না। তুমি পারো আমাকে বাঁচাতে বলে তমসা কাঁদতে শুরু করল।
পাত্রের মা একটু অপ্রস্তুত এর মধ্যে পড়লেন। তবু তমসার মাথায় হাত রেখে বললেন, তুমি কেঁদোনা। আমি দেখছি কতটা কি করা যায়। তুমি ভালো থাকো। নিজেকে এত ছোট মনে কোরো না। সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। এমনটা আর কেউ জানলো না। সবার অলক্ষ্যে এমন এক কাণ্ড ঘটে গেল। এরপর পাত্রপক্ষ বিদায় নিল। বাড়িতে গিয়ে সবাই এক বাক্যে বলল—-এত কালো মেয়ে; বাদ দাও। সবাই সব কিছু আলোচনা করলেও পাত্রের মা সেদিন কিছু আর বললেন না। খাওয়া-দাওয়া সেরে যে যার ঘরে শুতে চলে গেলেন। শুধুমাত্র পাত্রের মা সারারাত না ঘুমিয়ে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করলেন। কোনটা দেখবেন—কালো না মেয়েটির গুণ! অনেক ভাবলেন! কিন্তু স্বামীকে কিছু বললেন না। অবশেষে রাত্রি থেকে সকাল হলো।
সকলে সকালবেলা থরর চায়ের আসরে বসেছেন। এমন সময় কথা প্রসঙ্গে পাত্রের মা বলে বসলেন—ওই কালো মেয়েটিই আমার ছেলের বউ হবে। সকলে সমস্বরে বলে উঠল, কি বলছো তুমি! ওই কালো মেয়েটা তোমার ছেলের বউ হবে! তোমার কি মাথাটা খারাপ হলো! পাত্রের মা অবিচল । তিনি আবারো দৃঢ়তার সঙ্গে জানালেন হ্যাঁ! ওই কালো মেয়েটি আমার ছেলের বউ হবে। ছেলেও শুনল সে কথা। ছেলেতো নিরুত্তাপ। মা হ্যাঁ বলেছে মানে হ্যাঁ। কিছুতেই মায়ের কথা ফেলতে পারবে না। মা কে দুঃখ দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং আর কোন কথা থাকতেই পারে না।
কথা বলা, বিয়ে সব হয়ে গেল। কালো মেয়ের সংসার বসল। তমসার চলাফেরা, আদব-কায়দা, চিন্তাভাবনা এক অনন্য পর্যায়ের দাবিদার হয়ে উঠল। সংসারের সকল কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা তাকে গুনগ্রাহী করে তুলল। মনে মনে সকলে সমীহ করতে শুরু করল। সব সময় সংসারকে আগল দিয়ে রেখেছে তমসা। আর মাকে রাজরানী করে রেখে দিল। মা মায়ের কাজ করেছে– তার সন্তানকে সমাজজীবনে কালোর হাত থেকে রক্ষা করেছে। সংসার দিয়েছে। নতুন জীবন দিয়েছে। তমসাকে আর কিছু বলতে হয়নি। নিজের সর্বস্ব দিয়ে আজ বাইশ বছর সংসার সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছে। কখনো কোনো আঁচ পড়তে দেয় নি। যদিও কখনো পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে কটুক্তি এসেছে কিংবা আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে কটুক্তি এসেছে তা মা একাই প্রতিবাদ করেছে । সুতরাং তমসার আর কিছু ভাবতে হয় নি।
স্বামী তাকে সত্যিই গ্রহণ করেছিল কিনা তা সে কোনদিন জিজ্ঞাসাও করে নি কিংবা ভাবেও নি কোন কিছু। কারণ তমসার বিয়ে হয়েছে এই না কত! নতুন জীবন পেয়েছে আর কি চাই!
তবে মাঝে মাঝে রবি ঠাকুরের কবিতার মাধ্যমে কিছুটা বুঝিয়ে দিতেন—-
“কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক—“।
তবে তমসা কখনো যাচাই করতে চাই নি। তমসা শুধু ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখেছিল।এই ভাবেই সুন্দর সংসার চলছিল তমসার জীবনে।
কিন্তু আমাদের জীবন এমনই যে, সব দিন একই রকম যায় না। জীবনে ওঠাপড়া থাকবেই। তাই হল। মা চলে গেলেন।হঠাৎ মায়ের চলে যাওয়াতে তমসা খুব ভেঙে পড়েছিল। তমসা এখনো বসে বসে ভাবছে সেই দিনগুলোর কথা। মা ও মেয়ে সেইদিনের অজানা ঘটনা তমসার স্মৃতির পাতায় একেবারে জ্বলজ্বল করছে উত্তর আকাশের ধ্রুবতারাটির মত। মাও কোনদিন কাউকে কিছু বলেননি এই প্রসঙ্গে।যা আর কেউ কখনও জানতে পারবে না।
ওমা কাঁদছো কেন? ছেলের ডাকে তমসার চমক ভাঙে আর ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আরো জোরে আবেগে কাঁদতে থাকে। না বলা বাণী তমসার স্মৃতির পাতায় পাতায় কালো রং দিয়ে আজ পুরোটাই লেপে দিলো–যা আর কেউ কোনদিন পড়তেও পারবে না। পুরোটাই তমসার একান্ত গভীর গহনে সঙ্গোপনেই থেকে গেল।

Exit mobile version