প্রবন্ধ- খাদ্যরসিক বাঙালি

।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য প্রতিযোগিতা ।।

 

খাদ্যরসিক বাঙালি
-সুমিতা দাশগুপ্ত

 

 

বাঙালি যে চিরকালের খাদ্যরসিক, সেকথা কে না জানে ! এই অবিসংবাদিত সত্যটি এক লহমায় জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায় সুরসিক সাহিত্যিক শ্রী সুকুমার রায়ের লেখা বিখ্যাত “খাই খাই” কবিতায়। বাঙালিকে উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন –“যতো কিছু খাওয়া লেখে বাঙালির ভাষাতে ,
জড়ো করে আনি সব ,থাকো সেই আশাতে” ।
এককথায় এইটিই হলো আমবাঙালির মনের কথা।
কথায় বলে রসে বশে বাঙালি। তাতে আর সন্দেহ কী! হাস্যরস আর খাদ্যরস উভয় ক্ষেত্রেই যে বাঙালির জুড়ি মেলা ভার আমাদের কাব্য সাহিত্য ,গান চিরকাল তার সাক্ষ্য দিয়ে এসেছে।
প্রাণধারণের জন্য প্রাণীমাত্রের‌ই খাদ্যের প্রয়োজন , মানুষ‌ও ব্যতিক্রম নয় ,যেটা ব্যতিক্রমী সেটা হলো একদল খায় বেঁচে থাকার জন্য আর অপরদল খাওয়ার জন্যই বাঁচে। বাঙালিকে এই দ্বিতীয় শ্রেণীতেই মানায় ভাল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ‌ই তো বলে গিয়েছেন–বাসনার সেরা বাসা রসনায় “
প্রাচীনকাল থেকে বাঙালির খাদ্যাভ্যাসের মূল কাঠামোটি অপরিবর্তিত থাকলেও, তার খাদ্য তালিকায় যুক্ত হয়েই চলেছে নিত্যনতুন রেসিপি।
বাংলাভাষায় রান্নাঘরের অপর নাম রসবতী কারণ এইখানেই বাঙালি,স্বাদের তিক্ত ,কটু ,কষায় , লবণ,অম্ল , এবং মধুর এই ষড়রস অবলম্বনে রসনা পরিতৃপ্তির, নিত্যনতুন ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’মেতে থাকে । তবে
যতোই আধুনিক হোক না কেন , বাঙালির আজও ভাত ছাড়া চলে না।ভেতো বাঙালি তকমাটি সে সানন্দেই বয়ে বেড়ায়, ন‌ইলে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ানো ,মুর্গমুসল্লম্, কাবাবে অভ্যস্ত শ্রী সৈয়দ মুজতবা আলী খোলাখুলি ঘোষণা করবেন কেন , একবার জাহাজে ভ্রমণকালে ‘চারটি আতপ চাল ,উচ্ছেভাজা, সোনামুগডাল , পটলভাজা আর মাছের ঝোলের’ জন্য তাঁর প্রাণ কেঁদেছিলো!
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক শ্রী নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন ”ইতিহাসের ঊষাকাল হ‌ইতেই ধান যে ‌দেশের প্রধান উৎপন্ন বস্তু, সে দেশে প্রধান খাদ্য হ‌ইবে ভাত ইহাতে আশ্চর্য কিছু নাই’।
দ্বাদশ শতকের কবি শ্রীহর্ষের নৈষধ চরিত গ্রন্থে ভাতের একটি অনবদ্য বর্ণনা মেলে।
‘পরিবেশিত অন্ন হ‌ইতে ধূম উঠিতেছে, তাহার প্রতিটি কণা অভগ্ন,একটি হ‌ইতে আর একটি বিচ্ছিন্ন ,সে অন্ন সুসিদ্ধ, সুস্বাদু শুভ্রবর্ণ ,সরু ও সৌরভময় ‘।
এমন চমৎকার অন্নসুবাসের আখ্যান, বাংলা ছাড়া অন্যত্র কোথাও সম্ভব কিনা জানা নেই ।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন,
সে যুগে কৃষি গবেষণাগার ছিলো না ,সম্পন্ন চাষীরা নিজেদের চেষ্টায় মাটি বদলে বদলে , নতুন ধরনের সার ও গন্ধদ্রব্য দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ধান চাষে ব্রতী হতেন। বংশানুক্রমে, সেই সব ধান চাষ করিয়ে ধান বীজ রক্ষা করা হতো ।তাঁর পিতামহের সৃষ্টি, সজনেফুলি ,বাসরভোগ , রাঁধুনিপাগল, নামের চালগুলি আজও সেই সাক্ষ্য বহন করে।
‘ধন্য ধন্য বলি তাঁরে’।
প্রাচীনকালে সম্পন্ন গৃহস্থের ভাতের থালায় নাকি চৌষট্টি পদ পরিবেশিত হতো।শেষ পাতে দ‌ই । এযুগেও বাঙালির পাতে পঞ্চব্যঞ্জনের সমাহার। অভিজাত সবজির পাশাপাশি খাদ্যগুণসমৃদ্ধ থোড় ,মোচা ,ডুমুর‌ও পিছিয়ে নেই। রন্ধনপটিয়সীর হাতের গুণ ও মশলায় এগুলির স্বাদ‌ও যে অনন্যসাধারণ , বাঙালি মাত্রেই তা জানে। জানিয়ে রাখা ভালো এইসব রান্নায় ফোড়ন এবং মশলার আনুপাতিক হার‌টি পাটিগণিতের তেলচিটে বাঁশ আর অক্লান্ত বানরের , অঙ্কের চাইতে কিছু কম জটিল নয়!
কথায় বলে মাছে ভাতে বাঙালি।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের খালবিল যেন সোনালী, রুপালি আঁশে ভরা মছলি কাঁথার মাঠ, ফলে বাঙালি যে ‘ চিরকাল মৎস্য মারিবে খাইবে সুখে’ তা-তো স্বতঃসিদ্ধ।
বৈদিক যুগের মুণিঋষিদের ভ্রূকুটি অগ্রাহ্য করে বঙ্গবাসী মাছকে বেশ করে তেলে মশলায় , কষিয়ে ঝালে, ঝোলে অম্বলে রসনার তৃপ্তি সাধন করে এসেছে, এমনকি কণ্টকের কল্পনাতে ম্রিয়মান না হয়ে,নির্দ্বিধায় মাছের মাথা এবং কাঁটাচচ্চড়িটুকুও সাপটে খেয়ে নিয়েছে।
প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে নাকি সরষের তেলের প্রচলন ছিল না , পর্তুগীজদের হাত ধরে সর্বপ্রথমে বাঙালিই তৈলবীজ থেকে ঝাঁঝালো সরষের তেল নিষ্কাশনের ব্যাপারটা চালু করেছিলো। ভাগ্যিস্ ! ন‌ইলে আমরা তেল ক‌ই ,ইলিশপাতুরি ,চিতলমাছের- মুইঠ্যার স্বাদ পেতাম কী করে! আর আলু ভাতে মাখতে কাঁচালঙ্কার সঙ্গে এক ফোঁটা সরষের তেল !!
মাংসেও বাঙালির অরুচি নেই। প্রাচীন গ্রন্থে শূল্যপক্ক মাংসের উল্লেখ তো মেলেই ,আধুনিক যুগে মোগলাইখানার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তাও তার প্রমাণ। চপ কাটলেট, বিরিয়ানি- চাপ, ছাড়া আজ বাঙালির ভোজ‌ই অসম্পূর্ণ।
‌‌ চা-স্পৃহ চঞ্চল, বাঙালির স্ট্রিটফুডে আসক্তির তুলনাও মেলা ভার। ফুচকা , সিঙারা, আলুরচপ, ঝালমুড়িই তার প্রমাণ।
বাঙালি সর্বদা
মধুরেণ সমাপয়েৎ-এ বিশ্বাসী।বাংলার পোশাকি মিষ্টির জগৎজোড়া সুনামের পাশাপাশি, ঘরোয়া নলেন গুড়ের পায়েস পিঠে, ,নাড়ু,মোয়া ,মুড়কিও কম আদরণীয় নয়!
এক কথায় পুরো বঙ্গসংস্কৃতিতেই জুড়ে রয়েছে সুখাদ্যের আঘ্রাণ।
এইখানে উল্লেখ করা ভালো , কোলোষ্টরেলের তোয়াক্কা না করা, শ্রমবিমুখ বাঙালির শরীর স্বাস্থ্য ,তাকে প্রায়ই বিপদে ফেলে।
এই রসগোল্লার আবিষ্কারক হিসেবে বাঙালি যতোই কৃতিত্বের দাবিদার হোক না কেন ,বহির্বাংলায় চিরকাল‌ই সে ‘বাঙালিবাবু’ নামে টিটকিরির পাত্র। তবে সুখের বিষয় আধুনিক বাঙালি এখন অনেক বেশী স্বাস্থ্যসচেতন , সুষমখাদ্য‌ ও শরীরচর্চায় মনোযোগী।
বাঙালির সংগীত, শিল্প , সাহিত্য , ছেলেভুলানো ছড়া, ব্রতকথা– এককথায় সম্পূর্ণ জীবনচর্যায় নানাভাবে খাবারের প্রসঙ্গ,প্রমাণ করে দেয় বাঙালির খাদ্যরসিক তকমাটি কতোটা উপযুক্ত।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর মানসীর উদ্দেশ্যে
লিখেছিলেন ,
‘একালে চলে না সোনার প্রদীপ আনা
সোনার বীণাও নহে আয়ত্তগত ,
বেতের ডালায় রেশমি রুমাল টানা
অরুণবরণ আম এনো গোটাকত।’
এতেই পরিষ্কার, কবি মাত্রেই বায়ুভূক নয়। তাঁরাও দিব্যি রসে বশে জীবন কাটিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং রান্না নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে ভালোবাসতেন। তাঁদের বাড়িতে বিদ্বদজনসভায় প্রচুর সুখাদ্য পরিবেশিত হতো যদিও কবি স্বয়ং ভোজনরসিক হলেও ভোজনবিলাসী ছিলেন না।
সুকুমার রায়ের মন্ডাক্লাবের‌ও এই বিষয়ে যথেষ্ট সুনাম ছিল। অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তিই এই সভার নিয়মিত সভ্য ছিলেন।
কাজী নজরুল ইসলাম‌ও কম যেতেন না। জেলবন্দী থাকাকালীন নিয়মিত মোগলাইখানা রেঁধে নিজে তো খেতেন‌ই, সঙ্গে রাজবন্দীদের‌ও খাওয়াতেন। শিবরাম চক্রবর্তী যখন স্বদেশী আন্দোলনের জেরে জেলে গেলেন, নজরুল ইসলাম যারপরনাই খুশি হয়ে, তাঁকে খাইয়ে দাইয়ে, এমন একখানা মোগলাই চেহারা বানিয়ে দিলেন যে , সারা জীবনেও সেই চেহারা একটুও টসকায়নি।
সাম্প্রতিকতম উদাহরণ
জুনিয়র উইম্বলডন চাম্পিয়ান, আমেরিকাবাসী বঙ্গসন্তান সমীর‌ ব্যানার্জি ।একটি সাক্ষাৎকারে,নিজেকে বাংলার বিরিয়ানি আর চাটের ভক্ত বলেই দাবি করেছেন । আরও অজস্র উদাহরণ পেশ করাই যায়, তবে মনে হয় তামাম বঙ্গসন্তানের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ স্বাদটি বোধহয় দিনশেষে, শৈশবের নৈশাহারে, ঘুম জড়ানো চোখে মায়ের হাতের রূপকথার গন্ধমাখা গরাসখানাতেই মেলে।

Loading

One thought on “প্রবন্ধ- খাদ্যরসিক বাঙালি

Leave A Comment