।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার এর গল্প।।
পূর্বরাগ
-শচীদুলাল পাল
গঙ্গা তীরবর্তী চন্দননগর শহরে এক মধ্যবিত্ত সম্ভ্রান্তশালী পরিবারের দেবেশবাবু তার ছেলে অরিত্র ও মেয়ে রুমিকে নিয়ে থাকেন।কলকাতায় সরকারি অফিসের কর্মচারী। স্ত্রী বছর পাঁচেক আগে গত হয়েছেন। মেয়ের হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার পর আর পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। মেয়েকে সম্পুর্ণ ভাবে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে।ছেলে ক্লাস এইটের ছাত্র। একদিন দেবেশ বাবু বললেন ” দেখ মা রুমি! তোর মা গত হবার পর সংসারের হাল তোকে ধরতে হয়েছে। রান্না বান্না ঘর সংসারের যাবতীয় কাজ তোকেই করতে হয়। তার মাঝে তোর ভাই অরিত্রর পড়াশোনায় সাহায্য করিস। তোর প্রতি অনেক অবিচার হচ্ছে।
রুমি — অবিচার আবার কি? এটা তো আমার কর্তব্য।
— তাছাড়া অরিত্র এখন অনেক উঁচু ক্লাসে। ওর জন্য একটা প্রাইভেট টিউটারের ব্যবস্থা করেছি।
অরিত্র– না বাবা। দিদি বেশ ভালোই পড়াই।
— জানি। দিদি পড়াশোনায় ভালো। মা মারা যাবার পর সব ওলোট পালট হয়ে গেলো। তোর দিদির লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেল।
তোর পড়াশোনা বন্ধ যাতে না হয়, ভালো রেজাল্ট করতে পারিস সেজন্যেই একটা প্রাইভেট টিউটারের ব্যবস্থা করেছি। দু একদিনের মধ্যে এসে যাবে। ব্রিলিয়ান্ট স্কলার ছেলে। নাম প্রিয়াংশু।
রুমি — ঠিক আছে। তুমি যা ভালো বোঝ তাই কর।
দেবেশ — লোকালের সময় হয়ে এলো এখন অফিসে চলি।
কিছুক্ষণ পর অরিত্রও স্কুলে চলে গেলো। রুমি রান্নাবান্না ঘর সংসারের কাজে ব্যস্ত হলো।
×××××××××××_
বিকেল বেলা।
রুমি একটা কিছু পড়ছিলো।হঠাৎ
কলিং বেলের আওয়াজ।
রুমি বই ছেড়ে উঠে দরজা খুলে দিয়ে দেখলো সামনে এক এক সৌম্যকান্তি যুবক।
যুবকটি একদৃষ্টিতে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।
এভাবে কতক্ষন তাকিয়ে ছিল খেয়াল নেই।
হঠাৎ বাড়ির বাগানের এক পাখির শিশের আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে যুবকটি বলল—- আমি প্রিয়াংশু। এটি কি দেবেশ বাবুর বাড়ি?
— হ্যাঁ। দেবেশবাবু আমার বাবা। কিন্তু উনি তো এখন বাড়িতে নেই। অফিস থেকে এখনো আসেননি। ফিরতে সন্ধ্যা সাতটা বেজে যাবে।
— ও।তাহলে আজ আসি।
— কিছু দরকার থাকলে আমাকে বলতে পারেন।
— ক্লাস এইটের একটা ছেলেকে টিউশন পড়ার কথা বলেছিলেন।
— ও আচ্ছা! স্টুডেন্ট আমার ভাই অরিত্র। আপনি ভেতরে আসুন। ভাই এখনি এসে যাবে।
প্রিয়াংশু আড়ষ্ট বোধ করলেও কেমন যেন এক অদৃশ্য টানে ভিতরে প্রবেশ করল।
রুমি যুবককে সোফায় বসতে বলল — আপনি বসুন। আমি চা করে নিয়ে আসি।
প্রিয়াংশু মেয়েটির চলে যাবার মরাল গতির সুন্দর ছন্দের দিকে তাকিয়ে রইল। মুগ্ধ হলো।
কি সুন্দর গোছানো পরিপাটি আসবাবপত্রে সজ্জিত ড্রয়িং রুম।
কিছুক্ষন পর রুমি এক কাপ চা ও তার সাথে প্লেট ভরতি জলখাবার এনে সামনে দাঁড়ালো।
বাইরে খোলা জানালা দিয়ে পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম আলো অষ্টাদশী রুমির আপাদমস্তক দেহে ঠিকরে পড়ছে। ফর্সা গালে বিকেলের লাল আভায় রুমিকে মনে হচ্ছে যেন কোনো দেবী প্রতিমা।
যতই দেখছে তত যেন তার আকাঙ্খা আর মিটছে না।
অন্য কেউ হলে রুমি ঘরে ঢুকতে দিত না, বা দিলেও চায়ের প্লেট টেবিলে রেখে চলে যেতো।কিন্তু তারও কেমন যেন ভাল লেগে গেছে যুবকটিকে। অপরূপ, উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত চোখ।
রুমি বলল — কি শুধু তাকিয়েই থাকবেন নাকি প্লেটটা ধরবেন?
প্রিয়াংশু লজ্জিত হয়ে বলল – সরি।
প্লেট টি হাতে নিয়ে ভাবলো। এর আগে সে তো অনেক মেয়ে দেখেছে। কিন্তু এরকম এক অনুভুতি তার কখনো আসেনি। নিজেকে আজ তার কেমন অপরাধী বোধ হতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পর অরিত্র এসে গেলো।
— এই আমার ভাই, অরিত্র। আপনার ছাত্র।
অরিত্র তুই যা,তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে আয়। আজ থেকেই উনি তোকে পড়াবেন। তোর মাষ্টার মশাই।
ঘন্টাদুয়েক পড়ানোর মাঝে রুমি আরেকবার চা দিয়ে চলে গেছে।
প্রিয়াংশু অরিত্রকে বললো, তোমার দিদিকে ডাকো। আমি এবার আসি। দিদি দরজার আড়ালেই ছিল। এগিয়ে এসে বলল—অরিত্র! স্যারকে প্রণাম কর।
প্রিয়াংশুকে অরিত্র প্রণাম করতেই বলল — আমি তোমাকে তোমার স্কুলের সেরা ছেলেদের মধ্যে একজনে পরিনত করব। তুমি কিন্তু মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে যাবে।
আজ চলি।
প্রিয়াংশু যতক্ষন না দৃষ্টির অগোচরে চলে গেলো রুমি অপলকে তাকিয়ে রইল।
তার হৃদয় তন্ত্রীতে এক অভূতপূর্ব সুরের ঝংকার ধ্বনিত হতে লাগলো।
প্রাইভেট টিউটার প্রিয়াংশু নিয়মিত আসতে লাগলো। পড়াশোনায় অনেক অনেক উন্নতি হলো অরিত্রর।
দেবেশ বাবু রেজাল্ট দেখে খুব খুশি।
রোজ নিয়মিত চা জলখাবার এগিয়ে দিত রুমি। মাঝেমধ্যে দুচার কথা। একদিন পড়ানো শেষে রুমি বলল আজ আপনি খেয়ে যাবেন।
— এইতো প্রতিদিন জলখাবার খাওয়াচ্ছ আবার কি!
— আজ আপনার জন্য কিছু স্পেশাল রান্না করেছি। আপনাকে খেতেই হবে।
— আচ্ছা।
রুমির হাতের রান্নার খাবার খেতে খেতে অভিভূত হয়ে
— বা! কি চমৎকার রান্না। আমার মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো।
— আপনার মা! আপনার বাড়িতে আর কে কে আছে?
— আমার মা ছিল। অনেকদিন আগেই দেহ রেখেছেন।
— আর কে কে আছেন।
— আমার মা বাবা ভাই বউ কেউ নাই। আমি শুধু একা থাকি।
— আর খাওয়া দাওয়া?
— দূরে একটা মেস কাম হোম ডেলিভারি আছে। সেখানেই খায়।
— আপনি বলবেন, যেদিন অসুবিধা হবে আমার কাছে খেয়ে যাবেন।
— খেতে পারি একটা শর্তে।
— শর্ত আবার কি?
— আমাকে আপনি বলা চলবেনা। আমাকে তুমি বলতে হবে।
রুমি মনে মনে ভাবলো এটাতো আমারও মনের কথা। মিষ্টি হেসে বলল
—- ঠিক আছে। আমাকেও আপনি বলা চলবেনা। তুমি বলতে হবে।
বাহ্। দুজনের হৃদয় তন্ত্রীতে এক সেতারের সুর ঝংকারিত হলো।
এভাবে তারা দুজনে দুজনের মনের কাছাকাছি পৌঁছাতে লাগলো। ভালোলাগা থেকে ভালোবাসায় পরিনত হলো। একদিন না দেখলে রুমির মন উদাস হয়ে যেতো।সব কিছু যেন বিবর্ণ মনে হতো। একেই কি ভালোবাসা বলে। তাই ভালোবাসার টানে, ছুটির দিনে সকালে দুপুরে রাতে সময়ে অসময়ে প্রিয়াংশু ছুটে আসতো রুমির কাছে।
একবার হঠাৎ দিনকয়েক প্রিয়াংশুর দেখা নেই। সে আর পড়াতেও আসেনা। প্রতিদিন প্রতীক্ষায় দিন কাটে।সে কেন আসছে না? নানান অশুভ চিন্তা তাকে গ্রাস করলো।
একদিন বাবার সামনে
বলল– বাবা তুমি কি প্রিয়াংশু দার বাড়ির ঠিকানা জানো?
একবার খোঁজ নিয়ে দেখো কেন সে আসে না।
—– আমি সেসব পারবোনা।
— তাহলে আমাকেই ঠিকানাটা দাও আমি অরিত্রকে পাঠিয়ে খোঁজ নেব।
ওর একটা বায়োডাটা দিয়ে বলল
— এই নে। সযত্নে রাখবি।
বায়োডাটা দেখে রুমির চোখ চড়কগাছ। ওরে বাপরে! এতো অনেক ইন্টেলিজেন্ট ছেলে। এম টেক ইন কম্পিউটার সাইন্স।প্লাস আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি র মতো অত্যাধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। এছাড়া আই টি’র অনেক প্রফেশনাল কোর্স করেছে।
এতো ভালো ছেলে অরিত্রকে পড়াতে আসতো। আমারতো বিশ্বাস হচ্ছে না।
— ছেলেটা আমাদের পাড়াতেই এক পুরানো বাড়ি কিনে এসেছে। কাছাকাছি টিউশানি চাইছিল। আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা ওকে আমাদের বাড়ির টিউটার হিসেবে পেয়েছি।
রুমি মনে মনে ভাবলো সে একাই যাবে প্রিয়াংশুর খোঁজে আজই।
ডিনার শেষে বাবা ও অরিত্র যখন ঘুমিয়ে পড়ল, রুমি বিছানা ছেড়ে উঠে পা টিপে টিপে বাইরে বেরিয়ে এলো। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। টিপ টিপ বৃষ্টিও পড়ছে। রুমি ছাতা মাথায় দিয়ে এগিয়ে গেলো। বৃষ্টি বাড়তে বাড়তে মুষলধারে পড়তে লাগলো। বায়োডাটায় উল্লেখিত বাড়ির ঠিকানায় সঠিক স্থানে পৌঁছালো।
দরজায় কলিং বেল টিপতেই প্রিয়াংশু দরজা খুলে দেখলো সামনে রুমি দাঁড়িয়ে। তাকে দেখে সে আশ্চর্য হয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো।
— কি দরজা আগলে দাঁড়িয়ে থাকবে? নাকি ভেতরে আসতে বলবে?
এবার প্রিয়াংশু সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললো — এত রাতে তুমি! আমি তো বিশ্বাস করতে পারছিনা। এসো রুমি। ঘরে এসো। একি তুমি এক্কেবারে সম্পুর্ণ ভিজে গেছো।
— তুমি কোথায় ছিলে? কেন যাওনি আমার কাছে? আমাকে কেন ভুলে গেলে? তোমার কি হয়েছিলো?…..
রুমি হাজার প্রশ্নবাণে জর্জরিত করলো।
আমি একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে ভিনরাজ্যে গিয়েছিলাম।
তাছাড়া তোমার বাড়িতে যাওয়াটা পাড়ার লোকেদের পচ্ছন্দ নয়।অন্য চোখে দেখতে শুরু করেছে।
— কেউ কিছু বলেছে।
— হ্যাঁ নানান চর্চা। বিভিন্ন ঠেকে বিভিন্ন ভাবে।
— তুমি তো খুব বীর পুরুষ। লোকে কিছু বলবে বলে তুমি আমাকেই ছেড়ে দেবে। আমিতো তোমাকেই ভালোবাসি।
রুমি এগিয়ে গিয়ে সিক্ত বসনে প্রিয়াংশুকে জড়িয়ে ধরলো। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁঁচবো না প্রিয়াংশুদা। প্রথম নারী স্পর্শ লাভে প্রিয়াংশু শিহরিত হলো।
— তুমি তো অনেক ভিজে গেছো। দাঁড়াও তোমাকে একটা শুকনো কাপড় এনে দিই। প্রিয়াংশু কিছু না পেয়ে একটা শুকনো বিছানার চাদর এনে দিয়ে বললো
— এই নাও এটা নিয়ে ওই ঘরে গিয়ে ভিজে কাপড় গুলি চেঞ্জ করে এসো।
— না। আমি কোথাও যাবনা। তুমি আমারই। আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমারই।
রুমি একে একে সব ভিজা কাপড় প্রিয়াংশুর সামনে খুলে ফেলতে লাগলো।
প্রিয়াংশু অষ্টাদশী সুন্দরী ফর্সা রমনীয় রুমির রূপ লাবণ্যে মোহিত হলো। রুমির ঘনকালো মেঘের মতো কেশদাম,টিকলো নাক, পানপাতার মতো মুখ, বিম্ব ফলের মতো ওষ্ঠ, থরথর কম্পিত অধরপ্রান্ত, গুরু নিতম্ব,পীন পয়োধর বিভাজিকা, ক্ষীণ কটিদেশ, ত্বন্বী রুমির সুডৌল জঙ্ঘা অবলোকন করতে বাধ্য হলো। পুলকিত হলো। রোমাঞ্চিত হলো। আবেগ অনুভূতিতে দিগবিদিক জ্ঞান শুন্য হলো। হঠাৎ কড় কড় কড়াৎ শব্দে বাজ পড়লো। রুমি ভয়ে উত্তেজনায় প্রিয়াংশুকে জড়িয়ে ধরল। বাইরে প্রকৃতি উত্তাল।প্রবল শব্দে ঝড় জল। শন শন আওয়াজে মুষলধারে বৃষ্টি।ভিতরে তাদের দুজনেরই মহাপ্রলয় ঘটে গেলো। প্রকৃতির নিয়মে তারা আরও ঘনিষ্ট
হলো।
রাতভর প্রবল বর্ষণ।তাদের এই মিলন ঈশ্বরের দান মনে করে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে সমর্পণ করল।সাক্ষী রইলো উত্তাল প্রকৃতি।
রাত শেষ হলো। ঘড়িতে চারটা বাজে। রুমি ধীর পায়ে নিজের বাড়ির দিকে অগ্রসর হলো।
ঘরে এসে সন্তর্পণে দরজা বন্ধ করে পোশাক পরিবর্তন করে নিজের রুমের বিছানায় শুয়ে পড়লো। কাক পক্ষীটি টের পেলনা তার অভিসারের কথা। তার প্রস্ফুটিত নব যৌবনের জলতরঙ্গের সুমধুর সুর মনকে আচ্ছন্ন করে রাখলো।
এরপর থেকে প্রিয়াংশু যখন খুশি আসতে লাগলো।
একদিন দেবেশ বাবু অফিস থেকে বাড়ি ফিরছে। সেসময় পাড়ার মাতব্বর ও ক্লাবের ছেলেরা বলল
—দেবেশ বাবু!এটা সম্ভ্রান্ত পাড়া। সবাই শিক্ষিত ও আভিজাত্যপূর্ণ। আপনার মেয়ের বেল্লেনাপনায় আমরা অতীষ্ট। টিউশনি টীচারটি যখন তখন আপনার ঘরে আসে। আপনি ওদের মেলামেশা বন্ধ করুন।
দেবেশ বাবু ঘাড় নেড়ে সহমত ব্যক্ত করল।
দেবেশবাবু ঘরে এসে রুমিকে শাসন করতে করতে বলল— —এসব চলবেনা। প্রিয়াংশু কে বলে দিবি ও যেন না আসে। নির্লজ্জ বেহায়া। আমি তোর বিয়ে দিয়ে দেব। ছেলেও দেখে রেখেছি।
— আমি বিয়ে করব না বাবা। কেন করবি না।
তোর কি ভালোবাসার কেউ আছে?
— হ্যাঁ।
— কে সে?
— তাকে তুমি চেনো বাবা।
— কে সে প্রিয়াংশু! ওই বেকার ছেলেটা।
— আমি ওই বেকার ছেলের সাথে তোর বিয়ে দেব না।
— সে এখন বেকার হলেও পরে ভালো চাকরি পেয়ে যাবে।
— ওই লম্পট ছেলেটাকে তুই বিয়ে করবি?
— না বাবা। ও লম্পট নয়। সে শুধু আমাকেই ভালোবাসে।
— তোর মায়ের মৃত্যুর পর আমি তোকে কোলে পিঠে মানুষ করেছি। মায়ের অভাব বুঝতে দিয়নি। আজ তুই আমাকে অবজ্ঞা করছিস।
— অবজ্ঞা কোথায় বাবা। আমি তো বলেছি আমি বিয়ে করবনা। তুমি না জোর করে আমাকে ঘাড় থেকে নামিয়ে গলগ্রহ বিদেয় করতে উঠে পড়ে লেগেছো।
— কথার উপর কথা বলবি। তোর সাহস তো কম নয়।
কাল তোর মজা বের করছি।
— হ্যাঁ। তুমি যা-ই বলো বাবা আমি সব কিছু মেনে নেব কিন্তু প্রিয়াংশু ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করব না।
দিন কয়েক পর
রুমি ঘরের জানলা দিয়ে দেখলো একটা ছেলে মোটর সাইকেলে হর্ণ বাজিয়ে রাস্তা দিয়ে চক্কর দিচ্ছে। প্রথম দিকে গুরুত্ব দেয়নি। এখন দিন কয়েক থেকে সময়ে অসময়ে ছেলেটি শিশ দিতে দিতে কখনো বা চীৎকার করে হেঁড়ে গলায় গান গাইতে গাইতে মোটর সাইকেলে চক্কর দিচ্ছে।
ছেলেটাকে রুমি চেনে। লিটন। লম্পট বদমায়েশ মাস্তান গুন্ডা ছেলেটা অনেক কিশোরী মেয়ের সর্বনাশ করেছে।
একদিন রুমি পাড়ার মুদীর দোকান থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে বাড়ি ফিরছে।দেখলো একটা নিরিবিলি জায়গায় লিটন রাস্তার পাশে বাইক রেখে দাঁড়িয়ে আছে।
রুমি কাছে আসতেই আকস্মিক তার হাত ধরে বললো — ডার্লিং। আই লাভ ইউ।
— হাত ছাড়ুন বলছি। নাহলে চীৎকার করে লোক ডাকব।
— কেন? আমিও তোমাকে ভালোবাসি সুন্দরী। তোমার প্রিয়াংশু মাষ্টারকে ঘরে ডেকে তোমার মধু পান করতে দিচ্ছ। আর আমার বেলায় অমন কেন করছো সুন্দরী? আমি তোমাকে বিয়ে করে ওই বেকার ছেলের চেয়ে অনেক ভালো সুখে রাখব।
—- ছাড়ুন।লম্পট।
কিন্তু লম্পটটা জোর করে তাকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরতে গেলে রুমি ওর হাতে কাঁমড় বসিয়ে দিয়ে রক্ত ঝরিয়ে দিয়ে পাশের সরু গলি দিয়ে চোঁচা দৌড় দিল। ছুটতে ছুটতে ঘরে এসে সজোরে দরজা বন্ধ করে দিল।
একদিন পর ঘরে এসে জানলা দিয়ে শাঁসিয়ে দিয়ে গেলো।
— আমার প্রস্তাব মেনে নে। না হলে বদলা নিয়ে নেব। আমার নাম লিটন মাস্তান। তোর ওই মাষ্টারকে মেরে রাস্তায় ফেলে দিয়ে যাব।
এবার রুমি ভয়ে একদম জড়োসড়ো হয়ে গেলো। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলো।
কদিন থেকে প্রিয়াংশুদাও আসছেনা। কি যে করে! মনে মনে ঠিক করল আজ সে প্রিয়াংশুর বাড়ি যাবে। সতর্ক করে দিয়ে আসবে।
ডিনার শেষে বাবা ও অতনু একটা ঘরে শুয়ে পড়েছে। ড্রয়িং রুমের পাশের ঘরে সে একা শোয়। মধ্য রাত্রি। একটা বাজে।ঘুম আসছে না। রুমি বিছানা ছেড়ে উঠলো। উঁকি মেরে দেখলো বাবা ও অতনু গভীর নিদ্রামগ্ন। দরজাটা ঠেকিয়ে সে ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো। নিশুতি রাত। নিশাচর পাখির ডানা ঝটপটানির আওয়াজ। চারিদিক দেখলো রাস্তায় জনমানব নাই। গা ছমছম নিরবতা। ত্রস্তপায়ে প্রিয়াংশুদার বাড়িতে পৌঁছে দরজায় কলিং বেল
টিপলো।
প্রিয়াংশু দরজা খুলে ঘরে আসতে বললো। প্রিয়াংশুর ল্যাপটপ খোলা। সে কিছু একটা কাজ করছিল।
— তুমি আবার কদিন আমার কাছে যাওনি কেন?
— তুমি এসেছো।আজ আমার অনেক শুভদিন রুমি। আজ আমার মনস্কামনা পূর্ণ হলো।
— আমি কিন্তু তোমাকে কয়েকটা কথা বলতে এসেছি। তুমি আর আমাদের বাড়ি যাবেনা।
— কেন? আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া বাঁঁচবো না।
রুমি লিটন গুন্ডার তার উপর
কুদৃষ্টি ও কুপ্রস্তাবের ঘটনাটা জানিয়ে বললো
— তুমি আমাদের বাড়িতে যাবে না।লিটন আমাকে সম্ভোগ করতে না পেলে তোমাকে মেরে দেবে। ধমকি দিয়েছে।
—কিন্তু ওই লিটনের ধমকিতে ভয় পেয়ে তোমাকে হারাতে চাইনা।
— কিন্তু তুমি লিটনকে চেনোনা। ও যেটা বলে সেটা করেই দেখায়।
— যতই ও ফেরোশাস গুন্ডা হোক না কেন আমাদের প্রেমে, আমাদের মিলনে বাধা দিতে পারবে না। আমি হাইদ্রাবাদের যে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম। সেই চাকরিতে আমি সিলেক্টেড। এই দেখো
ই -মেলে এপয়েন্টমেন্ট লেটার এসে গেছে। আমি এবার জয়েন করে তোমাকে বিয়ে করেই এখান থেকে নিয়ে যাব।
—কই দেখি।
— এই দেখো।
— রুমি দেখে খুব আনন্দিত আপ্লূত হয়ে জিজ্ঞেস করবে ৯.৬ লাখ এটি কি?
— এটাই আমার বাৎসরিক বেতন সুন্দরী। পরে আরও বাড়বে।
খুশিতে রুমি গেয়ে উঠলো “হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে, ময়ুরের মতো নাচেরে।”
আনন্দের আতিশয্যে রুমি নাচতে শুরু করলো। আঁচল খুলে গেলো। জড়িয়ে ধরে চুম্বনে চুম্বনে প্রিয়াংশুকে ব্যতিব্যস্ত করে দেবে। উত্তেজিত প্রিয়াংশু রুমিকে নিয়ে বিছানায়
ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এলো। সারারাত এভাবে একে অপরকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো । হঠাৎ রুমি এক নিশাচর পাখির ডাকে ধড়ফড় করে উঠে কাপড় পড়তে পড়তে বলবে—
—- এমা! সকাল হয়ে গেলো। জানাজানি হয়ে যাবে।
— হোক জানাজানি। কাল রবিবার। তোমার বাবা বাড়িতে থাকবেন। আমি সকালে যাব। তোমার বাবার কাছে আমাদের বিয়ের প্রস্তাব দেব।
প্রায় ছুটতে ছুটতে রুমি ঘরের দিকে রওনা দিল। ঘরে ঢুকতেই বাবা চীৎকার করে বলবে—
— কলঙ্কিনী । কোথায় রাত কাটিয়ে এলি। নিশ্চয়ই ওই টিউশন টীচারের ঘরে গিয়েছিলি। হারামজাদি।
তোর জন্য আমি মুখ দেখাতে পারব না। রেলে মাথা দিয়ে মরবো।
— তোমাকে আর মরতে হবে না।
— কাল প্রিয়াংশুদা আসবে তোমার সাথে কথা বলতে।
— ও আসার আগে আমি থাকব নাহলে ও থাকবে।
মনে হলো রুমি এই সময় খুলে সব বলে দেয়। কিন্তু প্রিয়াংশু এসে সাসপেন্স ভঙ্গ করে সারপ্রাইজ দেবে এই ভেবে চুপচাপ থাকলো।
🔔🔔🔔🔔🔔🔔🔔🔔🔔
রবিবার, ছুটির দিন সকালবেলা। দরজার সামনে অপেক্ষারতা রুমি। প্রিয়াংশু আসতেই রুমি নিঃশব্দে চুম্বন দিয়ে প্রিয়াংশুকে অভ্যর্থনা জানালো।প্রত্যুত্তরে প্রিয়াংশু রুমির বুকে চুম্বন চিহ্ন এঁকে দিলো।
ক্রুদ্ধ দেবেশ বাবু সোফায় বসে আছেন।
প্রিয়াংশু ঘরে ঢুকে দেবেশ বাবুকে প্রণাম করে বলল
—আমি আপনার মেয়ে রুমিকে বিয়ে করতে চাই।আমি চাই আপনার আশীর্বাদ।
— আমার এ বিয়েতে মত নাই।
আমি একজন বেকার ছেলের হাতে আমার মেয়েকে সমর্পণ করবো না।
—- আমি এখন আর বেকার নই স্যার। এই দেখুন গতকাল হাইদ্রাবাদ থেকে appointment letter এসেছে। আমি এক মাল্টিন্যাশন্যাল কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে গেছি।
দেবেশ বাবু চিঠি পড়ে উচ্ছসিত হয়ে —-
— ওয়েল ডান। বেতনও ৯.৬ লাখ প্রতিবছর।
খুব খুশি। আমার স্বপ্ন পূর্ণ হলো। দেখলো
মিষ্টির প্লেট হাতে রুমি দাঁড়িয়ে।
সেখান থেকে একটা মিষ্টি তুলে দেবেশ বাবু প্রিয়াংশুর মুখে পুরে দিয়ে বলল
—- আয়ুষ্মান ভবঃ।
রুমি মিষ্টির প্লেট প্রিয়াংশুর হাতে দিয়ে বাবাকে প্রণাম করল।
বাবা দু হাত তুলে আশীর্বাদ করল
— সৌভাগ্যবতী ভবঃ।
রুমি — আজ দুপুরে আমাদের এখানে আমার হাতের রান্না খেয়ে যাবেন প্রিয়াংশুদা।
— আজ আমার অনেক অফিসিয়াল কাজ বাকী। আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে।
তাছাড়া তোমার হাতের রান্নাই তো সারাজীবন খেতে হবে।
এই বলে বিদায় নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লো। বারবার পিছন ফিরে রুমির দিকে তাকাতে তাকাতে
বাগান পেরিয়ে যেমনি বড় রাস্তায় পা দিয়েছে অমনি দূর থেকে লিটন গুলি চালালো। পরপর তিনটি। প্রথমটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও পরের দুটি প্রিয়াংশু কে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিলো।
রু— মি ———— বলতে বলতে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
রুমি দেবেশবাবু অরিত্র সবাই ছুটে এলো।
রুমির হাত ধরে অব্যক্ত যন্ত্রণায় চীৎকার করতে করতে জ্ঞান হারালো।
বাইক স্ট্রার্ট করে লিটন গুন্ডা নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেলো।
⛑️⛑️⛑️⛑️⛑️⛑️⛑️⛑️⛑️⛑️⛑️
সামনে দিয়ে একটা পুলিশ ভ্যান যাচ্ছিল রুমি হাত দেখিয়ে আটকালো। অত্যন্ত বিণীতভাবে সকরুন আবেদন জানালো
—-স্যার! আপনাদের পায়ে পড়ি আপনারা আমার প্রিয়াংশু কে বাঁচান। এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে চলুন। পুলিশের সহায়তায় ও সবাই মিলে ধরাধরি করে হাসপাতালে ভর্তি করল।
ICU তে।
সই করলো রুমি নিজে।
লিখলো রুমি মিত্র।
প্রিয়াংশু দত্তের বাগদত্তা স্ত্রী।
হাসপাতালের বেঞ্চে বিনিদ্র রজনী কাটলো রুমির।
দেবেশ বাবু বললেন
— সেই সকাল থেকে কিছুই খাসনি। কিছু একটা মুখে দে।
ইতিমধ্যে সার্জেন রুমি কে ডেকে বলেছে ৭২ ঘন্টা আগে কিছুই বলা যাবেনা। পেশেন্ট ইজ ক্রিটিক্যাল।
— না বাবা। ৭২ ঘন্টা কিছুই খাবনা।
🥦🥦🥦🥦🥦🥦🥦🥦🥦
অবশেষে ৭২ ঘন্টা অতিক্রান্ত হলে সার্জেন ডেকে পাঠালেন রুমিকে।
— মিস রুমি। প্যেশেন্ট ইজ আউট অব ডেঞ্জার।
একটা গুলি বগলের পাশে কাঁধের উপর আর একটা পায়ে লেগেছিল। আপনি একটু কথা বলতে পারেন। জ্ঞান ফিরে শুধু আপনার নাম করে ডেকেছে। সিস্টার বলল,শুধু ফ্যালফ্যাল করে
দরজার দিকে তাকিয়ে আপনারই প্রতিক্ষায় থেকেছে।
রুমি ধীরে ধীরে প্রবেশ করলো আই সি ইউ তে।
অপলকে প্রিয়াংশু রুমির দিকে তাকিয়ে রইলো । জলভরা চোখে রুমি এগিয়ে এসে প্রিয়াংশুর কপালে চুমু খেয়ে বলবে —-
প্রেমের দেবতা আমার প্রিয়াংশুকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। আর কোনো শক্তি আমার প্রিয়াংশুকে আমার থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবেনা।
বাইরে থেকে কোথাও সেই রবীন্দ্র সংগীতের সুর ভেসে আসছে।
“আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
পরানসখা বন্ধু হে আমার,
আকাশ কাঁদে হতাশসম
নাই যে ঘুম নয়নে মম,
দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম,
চাই যে বারে বার,
পরানসখা বন্ধু হে আমার,
আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
পরানসখা বন্ধু হে আমার। “