গল্প- শাশুড়ির মৃত্যুর পর

।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।। 

 

শাশুড়ির মৃত্যুর পর
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

 

 

চুড়ির রিনিরিনি সেই শব্দটা বারবার কেন শুনতে পাই আমি? নিঃশব্দে শাশুড়ি অমলা বালার ছবির সামনে কাঁদতে কাঁদতে কথা টা বলে চলেছে অনুশ্রী।

আজ তার শাশুড়ির বাৎসরিক শ্রাদ্ধ শান্তির ক্রিয়া কর্ম।অমলা বালার আকস্মিক মৃত্যু টা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না অনুশ্রী।

তার শাশুড়ি মাতা রোজ ভোর বেলায় উঠে বাগানে ফুল তোলা টা সেরে ফেলতো। তারপর বৃদ্ধা তাদের কুলমন্দির গিয়ে মন্দির চত্বরে জল ছিটানো, গোবরের ছড়া দেওয়া, মন্দিরের ভিতরের লাল মেছে টা জল দিয়ে শুকনো করে মুছে দেওয়া, নিত্য পূজার কাঁসার বাসন গুলো তেঁতুল দিয়ে ঘসে ঘসে পরিষ্কার করা এইসব কাজ করতো।
তার এই রুটিনের কোনোদিন অন্যথা দেখেনি এই পনেরো বছরে অনুশ্রী।

মন্দিরের পর্ব সেরে এসে অমলা বালা নিজের বাড়ির পূজার ঘরটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে ধুনো জ্বালাতো। তারপর গোটা বাড়ির উপর নিচে ঘুড়ে ঘুড়ে ধুনো দেখাতো।আর তখন অমলা বালার চুড়ির রিনিরিনি শব্দ টা বেশ কানে আসতো অনুশ্রীর।

অমলা বালার হাতে থাকতো মোটামোটা শাঁখা পলা আর চার গাছা চার গাছা করে মোট আটা গাছা চুড়ি। আওয়াজ টা তাই মন্দ হতো না।অনুশ্রী তাড়াতাড়ি করে গায়ের চাদরটা দিয়ে কানটা বন্ধ করার চেষ্টা করতো।আর অমলা বালা ছেলে অরুনের তো কোনো অসুবিধা হতো না চুড়ির রিনিরিনি শব্দে।কারণ ছোট থেকেই তার কান দুটো ভোরবেলায় এই আওয়াজ শুনতে অভ্যস্ত।

ধুনো দেখানোর পর্ব সারা হলে অমলা বালা অনুশ্রীর ঘরের দরজায় কড়া নেড়ে বৌমা কে ঘুম থেকে ওঠাতো।

যদিও অমলা বালার মেয়ে ছবি বহুবার তাকে বারন করেছে এই কান্ড কারখানা টা না করতে।

তখন অমলা বালা হেসে মেয়েকে উত্তর দিতো, দেখ ছবি তুই অফিস যাস না কিন্তু বৌমা তো অফিসে যায়। নটার মধ্যে ঘর থেকে না বেরোলে কি করে অফিস পৌঁছাবে দশটায়।

ছবি তখন মুখ বেঁকিয়ে বলতো যার অফিস তার হুশ নেই ।মহারানী বেলা সাতটা পর্যন্ত পড়ে পড়ে নিদ্রা সারবেন আর তুমি তার জন্য চিন্তা করে মরবে!

_কি করবি বল দেখছিস তো এতগুলো বছর হয়ে গেল তবু সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে পারল না। তবে সকালে ঘুম থেকে ওঠে না ঠিকই কিন্তু রাতে তো সবার শেষে ঘুমাতে যায় বৌমা।

আর অফিস যাওয়ার সময় আমি তো সেদ্ধ ভাত ছাড়া কিছুই রেঁধে দিতে পারি না। সাতটার সময় ঘুম থেকে উঠেই বৌমা হাঁকুপাঁকু করে মেয়েকে স্কুলে পাঠাবার জন্য। আর রিম্পাকে তো চিনিস ।সে তো আরো ঘুমকাতুরে। আটটার মধ্যে মেয়েকে স্কুল ভ্যানে তুলে তারপর বৌমা কোনরকমে একটু লেবু দিয়ে লিকার চা দুটো বিস্কুট খেয়ে ছোটে স্নানঘরে। তুই বল কখন সে রাঁধবে?

আমি তো বাপু বেশ শক্ত পোক্ত আছি এখনো। তাই ভাতে ভাতটা বসিয়ে দিই। তা বলে যে বৌমা রান্না করতে জানেনা একথা তার চরম শত্রু কেউ বলতে পারবে না। বৌমার হাতের বিরিয়ানী, চিকেন চাপ, ডিমের চপ ওই যে কি বলিস ফিশ বল সেইসব তো তুমিও চেটেপুটে খাও মা।

থাক থাক আর করো না মা তোমার বৌমার রান্নার সুখ্যাতি। অরন্ধন এর সময় দু চারটে লোক বলতেও তোমরা আর পারো না আজকাল। আমার শ্বশুরবাড়ির সবাই কত ভালোবাসতো আমাদের বাড়ির অরন্ধন এ আসতে। সে সবে উঠেই গেছে তোমার বৌমা আসার পর থেকে।

শাশুড়ির পালন করা নিয়ম আচার-অনুষ্ঠান এইসব বৌমারাই আগে নিয়ে যায়। দেখো না আমাকে শাশুড়ীর পালন করা বার ,ব্রত, আচার অনুষ্ঠান এখন আমিই করি সব।

অমলা বালা মেয়ের গায়ে হাত বুলিয়ে বলতো, খুব ভালো করো মা। সংসারটা সংসারের মতই করা উচিত। বৌমা তো আর শুধু সংসার করে নাও তাকে অফিস টাও করতে হয়। তাই তাকে আমি কোনদিন জোর করে তার ওপর সংসারের নিয়ম, রীতিনীতি কিছু চাপিয়ে দিইনি।

এতক্ষণ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে অনুশ্রীকে কাঁদতে দেখে ছবি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার স্বর্গীয় মায়ের এইসব কথা মনে করছিল।

এবার সে একটু বিরক্ত হয়েই অনুশ্রী কে আওয়াজ দিল, অনেক হয়েছে কান্নাকাটি। জ্যান্ত থাকতে তো আর মানুষটার সেবা যত্ন করলে না। কোন ভোর থেকে উঠে বৃদ্ধ বয়সেও সংসারের হাল মা ধরেছিল এতদিন। এবার টের পাবে। কে তোমাকে অফিস যাওয়ার আগে মুখের সামনে ভাতের থালা তুলে দেয় এবার দেখবো?

অনুশ্রী তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে বলে, সত্যি ছবি আমার জীবনের চরম ক্ষতি হয়ে গেছে এখন বেশ বুঝতে পারছি।

_ এখন আর বুঝে কি হবে বৌদি? মায়ের শরীরটা নিশ্চয়ই ভিতরে ভিতরে তখন খারাপ ছিল। সঠিক সময়ে ডাক্তার দেখালে হয়তো এইভাবে মা চলে যেত না একবছর আগে।

_কিন্তু ডাক্তার তো বলছে মায়ের হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। এটা তো আগে থেকে টের পাওয়া যায় না তেমন ছবি।

ছবি ঠেস মেরে বলে, দেখো আমি বাপু তোমার মতো এত অফিস কাছারি করি না, তোমার মতো বাইরে বাইরে ঘুরি না, আমি বাপু ঘরেই থাকি তাই আমার জ্ঞান তোমার থেকে আশাকরি কম হবে। তবু এটা জানি নিশ্চয়ই মায়ের বুকে কষ্ট হচ্ছিল কদিন আগে থেকেই।

ওদের দুজনের কথোপকথনের মধ্যে অনুশ্রীর মেয়ে রিম্পা এসে জানায় পুরোহিত ঠাকুর এসে গেছে। বারোটা বাজলেই কিন্তু শ্রাদ্ধ তে বসবেন উনি।

শ্রাদ্ধশান্তির কাজ সারতে সারতে বেলা প্রায় তিনটে। মোটামুটি নির্বিঘ্নে অমলা বালা বাৎসরিক শ্রাদ্ধশান্তির সমস্ত ক্রিয়াকর্ম নিয়ম মেনে আচার মেনে সুসম্পন্ন করল তার ছেলে ও বৌমা।

শ্রাদ্ধশান্তি কাজ মিটে যাওয়ার পর ছবি শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় তার দাদার দুখানা হাত ধরে বলে, তোরা মাঝে মাঝে আমার শ্বশুর বাড়ি যাস দাদা। বৌদির তো অফিস আছে। আমার হয়তো সেরকম করে আর বাপের বাড়ি এসে থাকা চলবে না কথাটা পুরো শেষ না করেই হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো ছবি।

পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনুশ্রী তার ননদের ব্যথা যন্ত্রণা উপলব্ধি করার চেষ্টা করছিল। সে বলে, কেন ছবি তোমার বাপের বাড়ি আসা কেন চলবে না? আমি নাইবা থাকলাম ঘরে সকালের দিকটায়, সন্ধ্যার পর থেকে তো ঘরেই থাকবো। তখন তোমার আর কোন অসুবিধা হবে না।

ছবি এবার কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে, দেখো বৌদি বাপের বাড়ি এসেও আমি হাত পুড়িয়ে খেতে পারব না। তোমার যেদিন ছুটিছাটা থাকবে সেদিন বল এক বেলার জন্য আসবো আনন্দ করবো তারপর চলে যাব। শ্বশুর বাড়িতেও খাটাখাটনি বাপের বাড়িতে ও খাটাখাটনি এতো আমি পারবো না বৌদি।

অনুশ্রী আর কথা না বাড়িয়ে ননদকে বিদায় জানিয়ে ফিরে আসে।

সন্ধ্যের দিকে অরুণ যে বৃদ্ধা মহিলাকে তাদের কুল মন্দিরের কাজকর্ম করার জন্য রেখেছিল সেই মহিলাটি আসে। তাকে ডেকে পাঠিয়েছিল অনুশ্রী।সে এলে তার হাতে নতুন দুখানা শাড়ি আর হাজার টাকা দিয়ে অনুশ্রী বলে, আমাদের কালাশৌচ শেষ হয়ে গেল।আর তোমাকে কুল মন্দিরের কাজকর্ম করতে হবে না।

পাশেই ছিল অরুন।সে লাফিয়ে উঠে বলে, সেকি বন্ধ কেন করছো? এ আমাদের কুল মন্দির।দুই জেঠু বাইরে থাকে তাই সারা বছর আমাদের পালা থাকে। আর আমরা না পালন করলে এত দিনের মন্দির রক্ষা পাবে কি করে?

অনুশ্রী মৃদু হেসে বলে, চিন্তা করো না তোমাদের মন্দিরের কাজকর্ম বন্ধ হবে না আমি বেঁচে থাকতে। এবার থেকে মন্দিরের কাজকর্ম আমরা করবো।

_ সে কি করে সম্ভব!

_ সকালের নিত্য পূজার সমস্ত জোগাড় করেই আমি অফিস যাবো।আর সন্ধ্যা টা রিম্পা দেখিয়ে দেবে। আমাদের মন্দির যখন তার দায় ভার ও আমাদের।

আর এবার থেকে মা যে আচার অনুষ্ঠান গুলো করতেন তা আমি ও করবো।সামনেই তো ভাদ্র মাসের মনসা পূজা।আর আমাদের অরন্ধনের দিন।তাই আমি এইসময় দুটো দিন অফিস থেকে ছুটি নেবো।ছবির শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের এবার নেমন্ত্রন করবো।

রিম্পা আর অরুন একসাথে বলে ওঠে , তুমি একা হাতে পারবে এসব?

অনুশ্রী হেসে বলে,একা কোথায়! তোমরা তো থাকছো আমার সাথে। তুমি কিন্তু একটা দিন অফিস থেকে ছুটি নিও প্লিজ।

রিম্পা বলে ওঠে, আমার কিন্তু স্কুল থাকবে।
আমি কামাই করবো না।

অনুশ্রী ধমকের সুরে বলে, একদিন স্কুল কামাই করলে তেমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।
বাৎসরিক শ্রাদ্ধ শান্তির পর্ব মিটে গেল মানে এই নয় যে ঠাকুমা ফ্রেম বন্দী হয়ে গেল।তুই তো ঠাকুমাকে খুব ভালোবাসিস তাই না।তাই আমাদের উচিত আমরা যাকে ভালোবাসি তার চিন্তা ধারা, তার কর্ম জীবন এই গুলোকে আমাদের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখা। তবেই তার প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়।

এই একটা বছর ধরে অনুশ্রী কানে চুড়ির রিনিরিনি যে শব্দটা শুনতে পেতো তা আজকাল আরো তীব্র শোনায় যখন সে কুল মন্দিরের কাজকর্ম করে, বাড়িতে ধুনো দেখায় তখন। চুড়ির রিনিরিনি শব্দটা শুনতে পেলে আগে সে ভয় পেত কিন্তু এখন সে আর ভয় পায় না। বরং বেশ সাহস পায় তে তার শাশুড়ি সবার অলক্ষ্যে সমস্ত সাংসারিক কর্মের সঙ্গে আছে।

Loading

Leave A Comment