।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
সাংসারিক (দ্য স্টোরি অফ এ ফ্যামিলি ভায়োলেন্স)
– উজ্জ্বল সামন্ত
সংসার একসাথে থাকার অঙ্গীকার। সং এবং সার শব্দের গভীর অর্থ রয়েছে। সেই সত্য যুগ থেকে চলে আসছে সাংসারিক নিয়ম। পরিণত বয়সের পর একটি যুবক যুবতী বিবাহবন্ধনে ,সামাজিক জীবনে আবদ্ধ হয়। দাম্পত্য জীবনে কলহ কখনো কখনো গার্হস্থ্য অশান্তির সূচনা হয়।
ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স তিন ধরনের হতে পারে ১) শারীরিক ২) মানসিক ৩) অর্থনৈতিক।
শুধুমাত্র পণ নয়, কোনও অভিসন্ধি বা স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে কিংবা কোনও অপরাধ প্রবণতাকে তৃপ্ত করতে গিয়ে কেউ যদি কারও উপরে শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ভাবে অত্যাচার চালান বা কেউ যদি কোনও রকম যৌন হিংসার শিকার হন অথবা তাঁর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাঁকে কোনও অপরাধমূলক কাজে লাগানো হয়, তাহলে এই ধরনের অপরাধ প্রবণতাকে গার্হস্থ্য হিংসা বা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স হিসেবে গণ্য করা হয় Domestic Violence Act 2005 অনুসারে। ঘটনা কখনো চোখের সামনে আসে, কখনো আসে না।
আদালত চত্বরে অন্যমনস্ক ভাবে দাঁড়িয়ে আছে অনির্বাণ। মনটা ভারাক্রান্ত আজ তার জীবনের একটা অধ্যায় শুরু বা শেষ হবে। নিজেকে সামলে নিয়ে অতীতের কিছু স্মৃতি ভিড় করে মনে। অনির্বাণ সৎ নির্ভীক পেশায় চাকুরীজীবী , বয়স বছর তিরিশের মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে।
৪ বছর আগের কথা, অনির্বাণ বিবাহের জন্য অনলাইন ম্যাট্রিমনিতে একটি আইডি খোলে। ম্যাট্রিমনিয়াল সাইট থেকে একজন যুবতী বারবার ফোন করে। স্যার অফার চলছে। আপনি ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটে ভিজিট করেছিলেন। কিছুক্ষণ কথোপকথনের পর ৫০০০ টাকায় আপনার আইডিটি খুলে দিতে পারব যদি আপনি রাজি থাকেন। পুজোর পরে এরকম অফার আর থাকবে না। বাবা ৩০ বছর আগে মারা গেছেন , ওর তখন মাত্র ২ বছর বয়স ছিল। বর্তমানে সংসারে দুটি মানুষ মা ও ছেলে। আত্মীয়-স্বজন থাকলেও দূরে থাকে , তাই আত্মীয়তায় অনেক ব্যবধান থেকে গেছে।
অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এসে মায়ের সঙ্গে আলোচনা করে। দিন দুই পর ম্যাট্রিমনিয়াল সাইট এ আইডি খুলে নেয়। ছবি কন্টাক্ট নম্বর সমেত অনেক বিবাহযোগ্যা মেয়ের প্রোফাইল দেখতে পায়। দিন সাতেকের মধ্যে একটি প্রোফাইল দেখে পছন্দ হয়, ফোন করে। ফোনে প্রাথমিক কথাবার্তা বলে । ব্যস্ততার কারণে রবিবার দেখে মেয়ে দেখতে যায়। দু’পক্ষের আলোচনার পর কিছুদিনের মধ্যেই মধ্যবিত্ত ওই পরিবারে বিবাহ হয়। স্ত্রী শিক্ষিতা, সুন্দরী।
অনির্বাণ মনে মনে খুব খুশি। কিন্তু তাঁর সুখ স্থায়ী হল না। বিবাহের বর কনে বিদায়ের সময় সামান্য কারণে কিছু অশান্তি হয় অনির্বাণের আড়ালে। বিবাহের এক মাসের মধ্যেই সংসারের চরম অশান্তিতে তাসের ঘরের মতো স্বপ্নগুলো ভেঙে যায়। ওর স্ত্রীর আচার-আচরণ খুব একটা স্বাভাবিক ছিল না। সংসারের কোনো কাজকর্ম করত না। সারাদিন ঘন্টার পর ঘন্টা কার কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলতো । সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটেও ব্যস্ত থাকত। ফোনে কার সাথে কি কথা বলতো পাশ থেকে শোনা যায় না।বিয়ের আগে একটি ছেলের সঙ্গে ৪ বছরের বেশী সম্পর্ক ছিল নন্দিতার । ছেলেটির বাড়িতে যাতায়াত ছিল। বিয়েও ঠিক ছিল ওই ছেলের সাথে এমনকি বিয়ে বাড়ি ভাড়াও হয়েছিল। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বিবাহটি ভেঙে যায়।
সন্দেহবাতিক ,বদমেজাজী, স্বার্থপর,লোভী, কোন বিশেষণ ই যথেষ্ট ছিল না নন্দিতার জন্য।তাহলে কি মানসিক অসুস্থতা ছিল নন্দিতার?
সম্পর্কের কঙ্কালসার চেহারা প্রকাশ পায় নন্দিতার কটূ কথায়। তার বয়স্কা শাশুড়িকে নখের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করে একদিন। রক্ত বের হয়ে আসে। অনির্বাণ থানায় এফ আই আর করতে পারতো । কিন্তু বাড়ির বউ , মান-সম্মান ইত্যাদি চিন্তা করে পিছিয়ে যায় পরিবার। হাসপাতালে মায়ের প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়ে বাড়ি ফিরে আসে ।
এরপর অনির্বাণ স্ত্রী শুরু করলো মানসিক অত্যাচার । অনির্বাণ কে ভয় দেখাত , ৪৯৮ এ মামলা করবে, জেলে পুড়বে। কিন্তু কোনো দিন এমন কোনো আচরণ করেনি অনির্বাণ ,যে তাকে হাজতবাস করতে হয়। স্ত্রীর নিত্যনতুন আবদারে বিলাসিতায় অনির্বাণের হয়তো আয়ের থেকে ব্যয় বেশি হচ্ছিল। কিন্তু তাও কোন রকমে এডজাস্ট করে সংসার করছিল। সাধ্যমত স্ত্রী দাবি দেওয়া মেটানোর চেষ্টা করছিল। তুচ্ছ কারণে সংসারে অশান্তি লেগেই থাকত। অনির্বাণ এর সব থেকে প্রিয় ছিল মান সম্মান।
নন্দিতা চেয়েছিল শাশুড়ী মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিতে। সংসার তাহলে পিছুটান বলে কিছু থাকবে না। ও স্বাধীন থাকবে নিজের মত। ইচ্ছে মত অনির্বাণ কে চালনা করবে। সংসারের মাথা হয়ে ছড়ি ঘোরাবে । কোন দায় দায়িত্ব নেবে না সংসারের। ইচ্ছে মত ঘুরতে যাবে, শপিং এ যাবে। যা খুশি তাই করবে। কিন্তু অনির্বাণ শিরদাঁড়া নোওয়া বার পাত্র নয়।
সম্মানহানি ও তাকে বিপদে ফেলতে নন্দিতা ও শ্বশুর বাড়ির লোকজন সব রকম চেষ্টা করতে লাগল। ফ্যামিলি কাউন্সেলিং সেন্টার এ অভিযোগ করলো। নির্দিষ্ট দিনে সেখানে উপস্থিত হয়ে ঘন্টাখানেক সেশন শেষ করে বাড়ি ফিরে এলো। কিন্তু আবার সেই এক ঘটনা। একদিন কথাকাটিতে নন্দিতা অনির্বাণকে এক চড় মারল। অনির্বাণ হতভম্ব কি করবে বুঝতে না পেরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। ঘন্টা ২ পর বাড়ি ফিরল। কয়েকদিন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোন বাক্যালাপ থাকলো না। যোগাযোগ নেই এরকম আগে প্রায়ই হয়েছে । মাসে একবার করে বাপের বাড়ি যেত নন্দিতা। কখনো ১৫ দিন কখনো একমাস টানা থাকতো।
১ বছর এরকমই চললো। অবশেষে নন্দিতা থানায় মিথ্যা অভিযোগ করলো। এক সন্ধ্যায় থানা থেকে ফোন এলো, ইনভেস্টিগেশন অফিসার ডেকেছেন অনির্বাণকে ওর স্ত্রী অভিযোগে । প্রাথমিক কথাবার্তার পর কিছু তথ্য প্রমাণ ও সাক্ষী সামনে রাখলো অনির্বাণ । তদন্তকারী অফিসার তখন বললেন , মশাই আপনি কি অন্ধ হয়ে বিবাহ করেছিলেন? আপনার স্ত্রী অভিযোগ জানাতে এসেছিল। কয়েকমিনিট তাকে দেখে কথাবার্তা বলে তো সুস্থ মনে হলো না। অনির্বাণ বলল আমাকে গোপন করা হয়েছিল। কয়েক মিনিট দেখে আমরা কিছু বুঝতে পারিনি যখন মেয়ে দেখতে যাই। সরল বিশ্বাসে ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন এর কথাবার্তায় আচার-আচরণে বিশ্বাসই করতে পারেনি যে ঐরকম একটা মেয়ে ও জঘন্য পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক হবে।
অনেক এডজাস্ট করার পরেও নিতান্তই নিরুপায় হয়ে অনির্বাণ এক সময় সম্পর্ক বিচ্ছেদের মামলার আবেদন করে এই মিথ্যা সম্পর্কের ইতি টানতে। বিগত কয়েক মাস হল ব্লাড প্রেসারের পেসেন্ট। । অনির্বাণ মন থেকে নন্দিতা কে ভালবেসে ছিল ,নন্দিতা ছিল তার স্ত্রীর থেকেও বেশি কিছু।
হঠাৎ অনির্বাণ সম্বিৎ ফেরে আর্দালির ডাকে, কেস নাম্বার… হাজির হো… কাঠগড়ায় উঠলো। মাননীয় বিচারকের সামনে দুপক্ষের উকিলবাবু জোরদার সওয়াল জবাব করলেন।
এর পর প্রায় তিন বছর যাবৎ বিবাহবিচ্ছেদের মামলার চললো। একসময় নন্দিতা মিচুয়াল ডিভোর্সে রাজি হয়ে বেশ কয়েক লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করলো খোরপোষ এর নামে। অনির্বাণ দাস ওর পৈত্রিক সম্পত্তি, বাড়ি বন্ধক রেখে টাকা ধার নিয়েছিল চড়া সুদে।
এই সমাজে নারীদের উপর শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারের ঘটনা অনেক শোনা যায় । সংবাদ পত্রিকায় ও টিভিতে বধূ নির্যাতনের নানা খবর প্রকাশ হয়। কিন্তু পরিহাস এটাই যে স্ত্রী ইচ্ছা করলেই যখন তখন স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ (৪৯৮) কেস আনতে পারে। কিন্তু যদি উল্টোটা ঘটে স্বামী কিন্তু তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনতে পারে না। কিন্তু এমন অনেক ঘটনা ঘটে যেখানে নিরীহ শ্বশুরবাড়ির লোকজনের ওপর বৌমা অত্যাচার করে । স্বামীকে বাধ্য করে সম্পর্কের ইতি টানতে। খোরপোষ নিয়ে হয়তো কিছু অর্থ আদায় হয় ঠিকই কিন্তু সম্পর্ক ? সম্পর্কে তো আর ফিরে আসা যায় না? ভবিষ্যতেও হয়তো কারো সঙ্গে কারো দেখা হয় না। সম্পর্ক ভেঙে অচেনা হয় দুটি মানুষ চিরদিনের জন্য আর এটা চলতেই থাকে আধুনিক সমাজ জীবনে…