Site icon আলাপী মন

গল্প- রামুকাকুর ফুচকা

।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ।।

 

রামুকাকুর ফুচকা
-অঞ্জনা গোড়িয়া

 

 

সেদিন যখন রামুকাকুর সাথে দেখা হলো মুখটা কেমন বিষন্ন লাগছিল ।রামুকাকুর সেই বিষন্ন মুখটা বারবার চোখে ভেসে উঠছে মুনিয়ার।
থমথমে সে চোখের দৃষ্টিতে একটা কষ্ট লুকিয়ে ছিল।যা মুনিয়ার চোখকে এড়াতে পারে নি ।
মুনিয়া মুখ ফুটে জানতে চেয়েছিল। কি হয়েছে কাকু? আজ এমন মন খারাপ?

কথাটা না শোনার ভান করে বলেছিল, “আর দুটো বেশি করে ফুচকা বানিয়ে দিই মুনিয়া। পয়সা দিতে হবে না। আমি খুশি করে খাওয়াচ্ছি।
কি যে বলো কাকু। পয়সা না দিয়ে খাবো কেন? কত কষ্ট করে বানিয়েছ। যা দাম তাই দেব।বলো না কাকু কি হয়েছে?
কিছু হয় নি খুকি। তোকে দেখে আমার মেয়েটার কথা বড্ড মনে পড়ছে।
আমার মেয়েটা ঠিক তোমার মতো। কথায় কথায় শাসন করে আমাকে।
বলে কি জানিস , “দিন রাত এত খাটতে হবে না বাবা”
বয়স হচ্ছে তোমার। কিছু হলে,কে দেখবে আমাদের”?
পাগলি মেয়ে একটা। আমাকে নিয়ে খুব চিন্তা।
আমার মেয়েটার খুব ইচ্ছে বড় হয়ে দিদিমনি হবে। তাই মন দিয়ে পড়াশোনা করে।
মুনিয়া বলেছিল বাহ তোমার মেয়ে তো গুনী মেয়ে। দেখবে খুব বড়ো হবে।
আর কী বলে জানিস, বলে আমার খুব নাম হবে। জশ হবে। সবাই বলবে ফুচকাওয়ালার মেয়ে দেখো দিদিমনি হয়েছে। গর্বে বুক ভরে যাবে।
তাই না মুনিয়া?
শুধু মাঝে মাঝে কেন যে এমন শরীর খারাপ করে মেয়েটার? তখনই কেমন ঝিমিয়ে যায়।
ও, তাই বুঝি তোমার মন খারাপ। ডাক্তার দেখিওছো কাকু?
চিন্তা করো না। তোমার মেয়ে নিশ্চয় দিদিমনি হবে।
তুমি এত ভালো। তোমার মেয়ে আরও ভালো।
এক দিন আলাপ করবো কাকু। নিয়ে আসবে তোমার মেয়েকে।
রামু চাচু মুচকি হেসে বলল, ঠিক আছে মুনিয়া, পরের দিন মাকে বলে রেখো। আমার বাড়ি তোকে নিয়ে যাবো।
আমার মেয়ে তো আসতে পারবে না।
ওর খুব শরীর খারাপ।
তুই যাবে তো মুনিয়া?
সেদিনের পর আর যাওয়া হয় নি। আর আসতে ও পারে নি রামুকাকু । শুরু হলো লকডাউন।
রামু কাকুর কথাগুলো বারান্দায় দাঁড়িয়ে বড্ড মনে পড়ছে।
মুনিয়ার মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এখন বাড়িতে থাকে।

প্রতিদিন মুনিয়াদের বাড়ির সামনে রামু কাকু ফুচকা নিয়ে আসত। মুনিয়া পাড়ার সবার সাথে তৃপ্তি করে খেত ফুচকা। রামু কাকুর হাতে নাকি জাদু আছে। আর অন্য কারোর বানানো ফুচকা ওর ভালো ই লাগে না। যেমন মুচমুচে খাসা তেমন ই সুস্বাদু।
সঙ্গে থাকে আলু-কাবলি, চানা মশলা। কত নামডাক রামুকাকুর।
আসলে রামুকাকুর ব্যবহার সবাই কে মুগ্ধ করত। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলে,তবে ই ফিরে যেত বাড়ির দিকে।

সেই স্কুল জীবন থেকে মুনিয়া রামুকাকুর বানানো ফুচকা খায়। কত হাসি খুশি মেজাজ। সবার প্রিয় ফুচকাওয়ালা। শেষের ফুচকা টা রামু কাকু স্পেশাল করে বানিয়ে দিত।অনেক রকম মশলা দিয়ে।
একদিন যদি না আসে, মুনিয়ার সে কি অভিমান। পরের দিন এলে ই প্রশ্ন, কি ব্যাপার কাকু।কাল যে এলে না? কখন থেকে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তবু তুমি এলে না। কেন শুনি?
রামুকাকু হাসতে হাসতে বলত,পাগলি মেয়ে একটা। আমার বুঝি শরীর খারাপ করতে পারে না? যদি আর আসতে না পারি, তখন কি করবে মুনিয়া ? কে বলতে পারে,কাল আর যদি না থাকি।
কথা গুলো শুনে ই মুনিয়া চেঁচিয়ে উঠে বলে ছিল, খবরদ্দার কাকু,এসব কথা আমার সামনে বলবে না। তোমার কিচ্ছু হবে না। তুমি না এলে ফুচকা খাবো কি করে? রোজ আসতে হবে। বুঝলে।

তারপর ই লকডাউন। কতদিন থেকে মুনিয়া ছটপট করছে রামুকাকুর ফুচকার জন্য। রামুকাকুর জন্য।
রামুকাকুর মেয়েটা কেমন আছে? তাও জানা হলো না।
কাকুর হাসি মুখখানি ম্লান হয়ে গিয়েছিল কেন?খুব জানতে ইচ্ছে করছে । কেমন আছে এই লকডাউনে?
প্রায় এক মাস হয়ে গেল। রামুকাকু আসে না আর ফুচকা নিয়ে।
এক দিন মুনিয়া খাতা কিনতে যাওয়ার নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল । অবশ্য মুখে ছিল মাস্ক।

খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে গেল রামুকাকুর বাড়ি।
এক কামরা আধা মাটি আধা ইটের ঘর। রামুকাকু বলে হাঁক দিল। কেউ সাড়া দিল না। ফাঁকা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকল বেশ কিছুক্ষণ।
পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল একজন । তাকে জিজ্ঞাস্য করল,রামুকাকু কোথায়? এটা ই রামুকাকুর বাড়ি তো?
ভদ্রলোক বললো, রামুর মেয়েটা আর বেঁচে নেই। মেয়েটা থেলাসেমিয়া রোগী। তিন মাস অন্তর রক্ত দিতে হতো।অনেক কষ্টে রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল এত দিন।
লকডাউনে ফুচকা বিক্রি বন্ধ। সময় মতো রক্ত দিতে পারে নি। রক্তের সংকট দেখা দিল। দেরী হয়ে যাওয়ায় আর বাঁচানো যায় নি মেয়েকে।
মৃতদেহ গ্রামের আনলে কেউ দেখতে পর্যন্ত আসে নি। ছোঁয়াচে রোগটার ভয়ে। অনেক কষ্টে গ্রামের কয়েক জনকে নিয়ে পাড়ার শ্বশানে ই নিজের মেয়ের মুখাগ্নি করেছে।তারপর আর বাড়ি আসে নি রামু। কেউ জানি না রামু কোথায় এখন?

বাকরুদ্ধ মুনিয়া। রামু কাকুর স্বপ্ন টা চিতার আগুনে ই শেষ।
মুনিয়া চোখ ভরা জল নিয়ে ফিরে এল বাড়ি।
লকডাউন শেষ। শুরু হয়েছে বাজার হাট। যদিও খুব সাবধানে। আবার বিক্রি হচ্ছে সব কিছু। পাড়ায় পাড়ায় আসছে ফেরিওয়ালা,সব্জিওয়ালা।আসছে ফুচকাওয়ালা।
তবু আর ইচ্ছে করে না ফুচকা খেতে। রামুকাকু আসে না। বারবার রামুকাকুর সেই মুখটা ভেসে আসে।

হঠাৎ একদিন চেনা সেই হাঁক।
রামুকাকুর গলায়। ফুচকা খাবে মুনিয়া। আমি এসে গেছি। ডাক শুনে,ছুটে বেরিয়ে এল মুনিয়া। রামুকাকু ফুচকা নিয়ে হাজির।

মুনিয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে।কেমন আছো মুনিয়া? কত দিন দেখিনি তোমায়?
যত খুশি ফুচকা খাও,আজ আর তাড়া নেই বাড়ি ফেরার।
মুনিয়া বেটি মন দিয়ে পড়া কর। তোমায় দিদিমনি হতে হবে। আমি যেখানে ই থাকি ঠিক তোমার খবর রাখব। কেমন। আবার আসব ফুচকা নিয়ে।
মুনিয়া চুপ করে শোনে। কি বলবে। জানে না। চোখ ভরা জল নিয়ে মিলিয়ে গেল কাকু।

সকালে ঘুম ভাঙতেই রাস্তায় মোড়ে একটা গুঞ্জন শুনতে পেল। আহারে এত ভালো লোক টার এই পরিণতি হলো।
সবাই গোল হয়ে শুনছে সেই মারাত্মক খবর। রামুফুচকাওয়ালা আর নেই। কাল রাতে ই গাড়ি চাপা পড়ে মারা গিয়েছে। মেয়ে মারা যাওয়ার পর পাগলের মতো ঘুরে বেড়াতো এখানে সেখানে। মাথাটা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
মুনিয়া কিছু তেই মানতে পারল না। চিৎকার করে ওঠে। রামুকাকু বেঁচে আছে।নিশ্চয় ফিরে আসবে ফুচকা খাওয়াতে। রামুকাকুর সাথে দেখা হবে আবার।

Exit mobile version