গল্প,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

গল্প- ভারতমাতা

। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।

 

ভারতমাতা
– রাণা চ্যাটার্জী

 

 

শীতের জবুথবু আঁধার রাত। লম্বা বয়ে যাওয়া খাল পাড়ের পাশ দিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার ফুঁড়ে পথ হাঁটছিল রতন,পাশে তার কয়েক ঘণ্টা আগে পরিচয় হওয়া নতুন সঙ্গী হুকুম সিং। মাথায় পাগড়ী এমন ভাবে বেঁধেছে কেবল চোখদুটো ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো জ্বলজ্বল করছে। বিপক্ষকে পায়ের প্যাঁচে জড়িয়ে টুঁটি ধরে কয়েক মুহূর্তে নাস্তানুবুদ করা তার বাম হাতের খেল।ঘুটঘুটে অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে যখন রতন অনুভব করলো পিঠে ভরসার হাত, উত্তেজনায় টগবগ করে উঠলো রক্ত।যে দায়িত্ব রতনের ওপর সঁপেছে স্বদেশী দলের নেতৃত্ব তা পালন করতেই হবে নীরবে নিস্তব্ধ অন্ধকারের মতোই ।এই সংকল্প মনে প্রাণে রতনকে এতটাই উত্তেজিত করে দিচ্ছে ,শুধু ভাসছে মনে ভারত মায়ের শৃঙ্খল মুক্তির হাসি।

দেশের সকল প্রান্তের মতো বাংলা সহ এ তল্লাটে লাল মুখো বাঁদর ইংরেজরা আধিপত্য কায়েম রাখতে লোভ দেখিয়ে নেমকহারাম এ দেশীয় কিছু মানুষকে হাত করেছে। এরা ইংরেজ দের দালাল রূপে নানা তথ্য সংগ্রহের জন্য জাল ছড়িয়েছে। শুরু হয়েছে সাধারণ কৃষকদের জমি, মাটি,আম আদমির জীবন জীবিকা সর্বস্ব লুটেপুটে নেওয়ার অত্যাচার, শোষন রাজ।সকল দৃষ্টি এড়িয়ে এ দুইজনের ওপর দায়িত্ব পড়েছে সাত ক্রোশ পথ পাড়ি দিয়ে নদীর ওপারে বাংলাদেশ সীমান্তে যে রেল স্টেশন তার সন্নিকট গোলা গুলি বারুদ সব জাগরণ মঞ্চের গোপন আস্তানায় পৌঁছানোর।কালকেই ট্রেনের মধ্যে যাওয়া অস্ত্র লুট করার মোক্ষম সুযোগ,সেটা ভেস্তে যাওয়া মানে মৃত্যুর সামিল রতনের কাছে। অন্ধকারে হোঁচটে পায়ের বুড়ো আঙুলের নখটা উপড়ে যাওয়ার উপক্রম হতেই উফ বাবাগো করে বসে পড়লো রতন।মুহূর্তে দেশলাই জ্বালিয়ে নিজের খদ্দরের পাঞ্জাবির একদিকটা ফরাৎ করে ছিঁড়ে পায়ে বেঁধে দিয়ে হুকুম সিং বললো “উঠিয়ে বাঙালি দাদা, আভি বহুৎ কাম বাকি,উঠিয়ে”!

ভরসায় টগবগ করে পুনরায় রক্ত ফুটে উঠলো রতনের।তার থমকে যাওয়া মানা,থেমে যাওয়া মানে ভারত মায়ের অব্যক্ত যন্ত্রণার পাথর তারও বুকের ওপর যেন আরো জোরালো ভাবে বসানো।আজ জঙ্গলে সারা বিকাল, সন্ধ্যা জুড়ে মাস্টারদা’র জ্বালাময়ী ভাষণ দারুন উদ্দীপ্ত করেছে রতনকে। এখনো যেন চোখের মধ্যে ভাসছে স্বাধীনতার মুক্তির আকাঙ্খা,আরও জোড়ে পা চালায় দুই নও জওয়ান।

বাঁশ বাগানের পাশ দিয়ে গোয়াল ঘরের ভেতর অব্যবহৃত রাস্তায় পা টিপে নিজের কুঁড়ে ঘরে ঢুকতে গিয়ে অবাক হলো রতন। একি মা এখনো জেগে!রাস্তায় ঠায় লন্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে! তবে কি তার অপেক্ষায় গ্রাম বাংলার অভাবী হাড়ভাঙা পরিশ্রমের প্রতিবিম্ব তার জন্মদাত্রী মা এই রাত বারোটার সময়।”কি রে রতন এলি বাবা,আমি জানতুম তুই আসবি”বলে পথ ছাড়লো মা, এ যেন সাক্ষাৎ ভারত মাতা রতনের।সে মাতঙ্গিনির নাম শুনেছে,তার মা কোনো অংশেই কম সাহসী নয় এটাও মানে রতন।ইতিমধ্যে মায়ের ব্যবস্থায় রুটি,গুড় মাটির পাত্রে গরম দুধ হাজির দুজনের।

“ওঠ বাবা আর দেরি করিস না – কে”!ধরফর করে উঠে বসলো রতন।ঘড়িতে রাত সাড়ে তিনটা।তবে কি মা ঘুমায় নি! মা কি আঁচ করতে পেরেছে নতুন সঙ্গী রাতে বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার কিছু একটা দায়িত্ব রতন দের ওপর।জলদি রেডি
হয়ে মুখে কাপড় জড়িয়ে মায়ের পায়ে হাত ছুঁইয়ে প্রণাম করে অন্ধকার পথে পা বাড়ালো দুই স্বদেশী মন্ত্রে দীক্ষিত যুবক। ওদেরকে মা,গামছায় পোঁটলা করে চিঁড়ে মুড়কি বেঁধে ধরিয়ে দিতে ভুললেন না!

পরদিন বিকালে ওঠানে রতনের নিথর দেহ এসে পৌঁছালো। স্থানীয় সংবাদে বারবার নিউজ বুলেটিন বলছে কুমার দহ স্টেশনের কাছে ট্রেনের চেন টেনে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় স্বদেশী ও পুলিশের মধ্যে প্রবল খণ্ডযুদ্ধ হয়।গোলাগুলির মাঝে পড়ে মৃত্যু হয় রতন বসু রায়ের।বিপ্লবীরা প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার করে তাদের মিশন সফল করেছে,শুরু হয়েছে কারফিউ,ধরপাকড়। গ্রাম বাংলার বয়স্ক মা তাকে তো কাঁদতে নেই ! তার পায়ের সামনে পড়ে রয়েছে তার সন্তানের নিথর দেহ । তার রতন তো ভারত মায়ের শৃঙ্খলা মুক্তির জন্য বলিপ্রদত্ত ,আর তিনি শহীদের মা, আপামর ভারতবাসীর জননী” ভারত মাতা”।একদল যুবক “বলো হরি হরি বোল” সুরে শ্মশান মুখে নিয়ে যাচ্ছিল রতনের দেহ। বয়স্ক মা ছেলের মাথায় আশির্বাদ দেওয়ার নামে পা ছুঁয়ে প্রণাম করলো অমর শহীদের।

Loading

Leave A Comment

You cannot copy content of this page