অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার
“শূন্যতার করাল গ্রাসে”
-সুমিতা পয়ড়্যা
হিরুবাবু মোটা মাইনের চাকরি করেন। ভরপুর সংসার। বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে আনন্দের ধরাধাম।কারুর নজর লেগেছিল কিনা জানা নেই।তাই ছেলে মেয়ে বড় হতে তাদের ভর্তি করা হলো কোনো এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় এক। হিরুবাবুর বাবা ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ডের কোন এক স্কুলে শিক্ষক ছিলেন। তিনি বলেই বসলেন, আমরা বাঙালি ;ছেলে মেয়ে মাতৃভাষায় বড় হবে এটাই গর্বের। পিতার মুখের উপর কথা বলবে এমন সাধ কোনকালেই ছিল না।
তাই হল। পিতৃদেবের আজ্ঞা শিরোধার্য। হিরুবাবু ছেলে মেয়েকে নিয়ে বাবার কাছে চলে এলেন। ছেলে মেয়েকে বাংলা মিডিয়ামে ভর্তি করানো হলো কিন্তু তাদের থাকতে হলো ঠাকুমা দাদু কাকু কাকিমার কাছে। হিরুবাবু ফিরে গেলেন। কিন্তু অত ছোট ছোট ছেলে মেয়ে বাবা মাকে ছেড়ে দাদু ঠাকুমার কাছে থাকা- এ যেন কোন এক অচেনা অজানা দ্বীপে পাড়ি দেওয়া। হিরু বাবু কিছু বলছেন না তো তাদের মায়ের কান্না দূর অস্ত।
ছেলে অভ্র আর মেয়ে অনিমা ভর্তি হল স্কুলে। যথারীতি পড়াশোনা করতে করতে এক বছর পার হলো । বাবা মায়ের আদরের ছেলে-মেয়ে আজ ঠাকুমা দাদু কাকা কাকুর অনুগত। উনারা যা বলেন তাই শুনতে হয়। তার ফলে অভ্র খানিকটা মানিয়ে নিলেও অনিমা সারাক্ষণ মন খারাপ করে আর মায়ের জন্য কাঁদতে থাকে। যারপরনাই পরের বছরই অনিমা আবার বাবা-মার কাছে ফেরত চলে যায়। অভ্রকেও যেতে বললে সে আর গেল না। অভিমান থেকে সে বলেই বসলো—তোমরা কি শুরু করেছ! একবার এখানে, একবার ওখানে, আমি কোথাও যাবো না। এখানেই থাকবো। অভ্র তখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। অনেক দুঃখ- ক্ষোভ-বেদনা নিয়ে তার পথ চলা শুরু হয়। কাউকে কোনো কথা বলত না । নীরবে সব কাজ সম্পন্ন করে যেত।ঠাকুরমা অভ্র কে অবশ্য খুব ভালোবাসতো। আর ভালোবাসত তার বন্ধুরা।কারণ বন্ধুদের কাছে অভ্রর কোনো না নেই।সব কর্মকাণ্ডে অভ্র সঙ্গী। একমাত্র ঠাকুরমাই অভ্র নাএলে খেত না, দুজনে একসঙ্গে গল্প করতো। এই ভাবেই চলছিল অভ্রর বড় হওয়া। হিরো বাবু মাসে মাসে মোটা অংকের টাকা বাবার হাতে তুলে দিতেন। কোনদিন হিসেবে নেন নি কিংবা জিজ্ঞাসা করেননি। ওদিকে হীরু বাবুর বাবা মানে অভ্রর ঠাকুরদা ঐ মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে শুধু জমি আর জমি কিনতে লাগলেন।
এরপর অভ্র পড়া শেষ করে বিটেক, এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করে। চেষ্টা করে চাকরিও পায়।
কিন্তু যে অনুপাতে তার পড়াশোনা ভালো করা উচিত ছিল তা পারেনি। কাকু কাকিমার গঞ্জনা, দাদুর বকুনি সব মিলেমিশে এক নৈরাশ্যের রাজ্যে বিরাজ করতো।
দিন যায় রাত যায়। এমনই এক দিনে হিরুবাবুর বাবা মারা যান।তখনও অভ্র ঠাকুরমার সাথে।
অবশেষে হিরুবাবুর চাকরি জীবনের অবসান ঘটে। তখন ছেলের কাছে তারা চলে আসে। সেখানেই জায়গা কিনে বাড়িঘর করেন। বেশ চলছিল এইভাবে।
অভ্রর মা বেশ রাজরানী হয়ে ছিলেন। কোনদিন হিসেব-নিকেশ এর মধ্যে যাননি। খরচ করতে করতে একসময় টাকা শেষ হতে থাকে। তবুও তারমধ্যে মেয়ের বিয়ে ছেলের বিয়ে সব তিনিই দেন। ছেলে চাকরি পেলেও মোটা মাইনের চাকরি ছিল না। তাই তার পক্ষে খুব বেশি খরচ করা সম্ভব ছিল না।হিরু বাবুই ছেলের বিয়ে দিলেন।
অভ্রর বিয়ের পরে সংসারের নিত্যনৈমিত্তিক অশান্তি লেগেই থাকত। সেই অশান্তি থেকে মুক্তি পেতে অভ্রর মা একদিন বলেই বসলেন, আলাদা থাক, শান্তিতে থাক।
যেই বলা সেই কাজ। অভ্র তার স্ত্রীকে নিয়ে চলে গেল এবং আলাদা থাকতে শুরু করলো। যথারীতি বাবা মায়ের প্রতি তার দায়বদ্ধতা কমে গেল। স্ত্রীকে নিয়ে সুখের ঘরে আড়ম্বরের, পরিপাট্যের ঝাঁ-চকচকে জীবনে অভ্যস্ত হলো। নিজের ছেলে হল।অন্নপ্রাশন থেকে পড়াশোনা কোনো কার্পণ্য নেই অভ্রর।স্ত্রীর সমস্ত চাহিদা পূরণ,স্বপ্ন পূরণ সবটাতেই অভ্রর কমিটমেন্ট ভরপুর।অথচ বাবা-মা-বোন এদের থেকে দূরে বহুদূরে সরে গেল। একবারের জন্যেও ফিরে তাকায় নি। অভ্রর পরিবর্তন লোকচক্ষুর আড়াল হল না। তবুও সে নির্বিকার।
এদিকে হিরুবাবুর জমানো টাকা ক্রমশ শেষ হতে হতে তলানীতে ঠেকলো। কিন্তু কাউকে কিছু বলার নেই। ছেলেকেও না।
যেহেতু ছেলে ছোট থেকে বাইরে মানুষ হয়েছে তাই বাবা মায়ের প্রতি তার এমনিতেই অসন্তোষ ছিল। আর বিয়ের পরে আলাদা হয়ে আরো পাষাণ হয়ে গেল। ভুলেই গেল যে বাবা-মা তার আপনজন।
যথারীতি হিরুবাবু চিন্তা মগ্ন হয়ে পড়লেন। যখন চাকরি করতেন তখন বেশিরভাগ টাকাটাই বাবার হাতে তুলে দিতেন। তখন এত চিন্তা ভাবনা করেন নি। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে হিরুবাবু দেখতে পান কিছু জমি ছাড়া তার আর কিছু নেই। প্রায় সবটাই ছোট ভাইয়ের দখলে। হিরুবাবু এমনই এক মানুষ যিনি কখনো কারো সঙ্গে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হন নি। তার এই উদারচিত্ত আজ তাকে চিন্তায় ফেলেছে।চিন্তা করতে করতে অবসাদগ্রস্ত জীবনে চলে গেলেন। যেটুকু ছিল সেটুকু দিয়েই কোনরকমে চলছিল, আর মেয়ে এসে খানিকটা সামাল দিয়েছিল।
তবুও দিনে দিনে তিনি এক বিরাট শূন্য গহবরে তলিয়ে যেতে থাকলেন। যেখান থেকে মানুষ আর মানুষের মত ফিরে আসতে পারে না। নানা রোগে আক্রান্ত হলেন। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তার আর কোন উপায় রইল না। শেষে ডাক্তারও জবাব দিলেন। আর কিছু করার নেই। যে কদিন বাঁচবেন এমনই বাঁচবেন।
এমন শূন্যতার দ্বীপে পৌঁছে গেলেন যেখানে মানুষ হয়েও, এতকিছু করার পরও সবকিছুই শূণ্য।
পরে ছেলে বড় চাকরী করলেও বাবা-মাকে আর কাছে টেনে নেয় নি। বাবার পাশে দাঁড়িয়ে সেদিন বলেনি, আমি আছি চিন্তা কিসের! কিছুটা ভরসার হাত বাড়ালে হয়তোবা এত শুন্যতা আসতো না। জীবন এতটা অন্ধকারময় হোত না।
———