অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার
প্রবন্ধ- মায়ের আঁচল
-সুমিতা দাশগুপ্ত
বাংলায় একটা কথা আছে “বন্যেরা বনে সুন্দর , শিশুরা মাতৃক্রোড়ে” । কোনও সন্দেহ নেই জগতের সমস্ত শিশুদের জন্যই এই কথাটি ধ্রুব সত্য। মানবশিশুর জন্য আরও একটি পরম ভরসাস্থল ধ্রুবতারার মতো চিরসত্য হয়ে বিরাজ করে , সেটি হলো মায়ের আঁচল।
এই জগতে মায়ের আঁচলের তুল্য আর আছেটা কী? ছেলেবেলায় স্নানের পর ভেজা চুল , খেলার মাঠ ফেরত ঘামে ভেজা মুখ,
অঙ্কের খাতায় কম নম্বর পাওয়ার চোখের জল , বাড়িতে আসা অচেনা অতিথির সামনে থেকে আড়াল খোঁজা , এইসব কিছুর জন্য , মায়ের আঁচলই তো চিরকাল শিশুদের একমাত্র ভরসাস্থল।
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও তাঁর “ছেলেবেলা”র
স্মৃতিচারণায় লিখেছিলেন সন্ধ্যাবেলায় গৃহশিক্ষকের কাছে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে লম্বা অন্ধকার বারান্দা দিয়ে ”ভূতের ভয় শিরদাঁড়ার উপর চাপিয়ে চলে যেতুম মায়ের ঘরে”…., সেই মায়ের আঁচলের ভরসায়।
কালের নিয়মে বয়স বাড়ে। শিশু থেকে বালক, বালক থেকে কিশোর , তরুণ ,যুবক — ক্রমশ সে স্বাবলম্বী মানুষ , পা বাড়ায় মুক্ত জীবনের পথে। তখন তার আর ঠিক সেইভাবে মায়ের আঁচলের দরকার পড়ে না , আঁচলের আওতা ছেড়ে বহির্বিশ্বে পা রাখার জন্য সে উদগ্রীব।
” রইবো না আর বদ্ধঘরে দেখবো এবার জগতটাকে , কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে” —প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের পক্ষে সেটাই তো স্বাভাবিক। মা-ও, সন্তানকে এগিয়ে দেন জীবনের যাত্রাপথে।
মায়ের আঁচলের ছায়া , কিছুটা নেপথ্যে রেখে তখন সে জীবন পথের পথিক।
পথ হাঁটতে হাঁটতে ক্রমে বেলা বাড়ে । অপরাহ্ণের আলো এসে পড়ে গায়ে মাথায়।জীবনের অতিবাহিত কাল ক্রমশ পিছে সরে সরে যায়। সংসারের নিত্য দিনের টানাপোড়েনে মায়ের ছায়া আবার মাঝে মাঝে মানসপটে উঁকি দিয়ে যায়, হয়তো বা সেদিন সে রৌদ্রদগ্ধ মানুষের মতোই ক্লান্তিতে বিধ্বস্ত , কখনও বা অকূল পাথারে দিশাহারা । মনখারাপের দিনে যেদিন সে নিজের সঙ্গে নিজে একেবারে একা ,খুব ইচ্ছে যায় মায়ের আঁচলের তলায় স্নিগ্ধ শীতল পাটির স্নিগ্ধ আশ্রয়টুকু আরও একবার ফিরে পেতে। মধ্যরাতের একা বিনিদ্র শয্যায় , নিভৃতে গড়িয়ে পড়া অশ্রুবিন্দু মুছতে মায়ের অদৃশ্য আঁচলখানিই যে তখন একমাত্র সম্বল। পৃথিবীর সমস্ত আলো নির্বাপিত হলেও, মায়ের স্নেহপরশটুকু আঁধার ঘরের প্রদীপ হয়ে জ্বলতে থাকে , জ্বলতেই থাকে অনির্বাণ শিখায়।