গল্প- করোনাকাল

 ।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ।।

 

করোনাকাল
-সুতপা মন্ডল

 

 

ব্রেকিং নিউজ: করোনায় লকডাউন, চাকরি হারিয়ে আত্মঘাতী ইঞ্জিনিয়ার।

প্রত্যেকটি চ্যানেলে খবরটা বারবার দেখাচ্ছে। খবরটা শুনতে শুনতে পার্থ ভাবে তার মনের কথাটা জানল কি করে?

কাল রাতেই টারমিনেশন লেটার পেয়েছে মেলে, পাওয়ার পর থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না এই মুহূর্ত থেকে সে বেকার।
বারবার বাবা-মা, ছোট বোনটা, সুচেতার কথা মনে পড়ছে।

ভালো করে পড় বাবু, তোকে অনেক বড় হতে হবে। তুই যখন বড় হয়ে এই এত বড় চাকরি করবি তখন আমাদের আর কোনো দুঃখ থাকবে না।

দেখো মা, একদিন আমি অনেক বড় হবো, এত বড় চাকরি করব, আর বাড়ি বানাবো অনেক উঁচুতে ওই হারান জেঠুদের ঘর টার থেকেও উঁচুতে।

পার্থ হেড স্যার এসেছেন বাড়িতে।
আজ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়েছে বাবা, ” তুমি আমাদের স্কুলের, এই অঞ্চলের নাম রোশন করেছ। আশীর্বাদ করি তুমি অনেক অনেক বড় হও, দশজনের একজন হও।”

দাদা তুই জয়েন্টে চান্স পেয়েছিস! তুই এবার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বি?
ধুর বোকা মেয়ে, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে কত খরচ হয় জানিস? ওসব আমাদের জন্য নয়।

বাবা শুনতে পেয়ে বলেন এসব নিয়ে ভাবিস না বাবা, আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি, পুবের মাঠের জমিটা বেচে দিয়েছি আর তোর মায়ের গয়নাগুলোও আছে, তুই একদম চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে, তুই শুধু মন দিয়ে পড়াশোনাটা কর।
কিন্তু বাবা বোনের জন্য মায়ের গয়না গুলো-
তুই চাকরি করে বোনের জন্য গয়না। গড়িয়ে দিস।

দাদা চাকরি পেয়েছিস! কলকাতায় থাকবো আমরা! আমার বন্ধুদের কে বলব আমার দাদা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরি পেয়ে গেছে।

বাবাকে প্রনাম করে বলে চাকরি পেয়েছি এখনই মাইনে বেশি নয় তবে পরে উন্নতি হলে মাইনেও বাড়বে।

পাঁচ বছর হয়ে গেছে পার্থর চাকরি। সাধারন একজন এমপ্লয়ী থেকে পার্থ এখন ম্যানেজার, মাইনের রকম টাও ভালো।

বোনের বিয়ে তো ঠিক হয়ে গেছে, কিছু গয়না যে গড়াতে হবে বাবা।
চিন্তা করোনা বাবা, আমার ক্রেডিট কার্ড দিয়ে দিয়েছি বোনকে, বলে দিয়েছি ওর যা যা লাগবে কিনে নিতে। তুমি ভয় পেয়ো না বাবা, আমার স্যালারি থেকে মাসে মাসে কেটে যাবে।

বাবা গাড়ি কিনলাম তোমাকে আর মাকে নিয়ে মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়বো এখানে ওখানে ঘুরতে।
এখনই এত টাকা কোথায় পেলি বাবা, একটু বুঝেশুনে খরচা কর।
বাবা টাকা একসাথে দিতে হয়না E MI তে কিনেছি, আস্তে আস্তে শোধ হয়ে যাবে।

বাবা একটা ফ্ল্যাট বুক করলাম, তিনটে রুম বড় একটা হল ঘর রান্নাঘর নিচে গ্যারেজে আছে। আর ভাড়া বাড়িতে থাকব না। অনেক উঁচুতে ফ্ল্যাট শহরটাকে তোমরা ব্যালকনিতে বসে দেখতে পাবে।

খোকা ফ্যাট কিনতে যে অনেক টাকা লাগে বাবা!

বাবা কিছু টাকা দিয়ে বুকিং করেছি আর বাকি টাকা লোন করেছি, মাসে মাসে স্যালারি থেকে কেটে যাবে।
এখন টাকা জমিয়ে আর কেউ ঘর কেনে না, নিজের ঘরের আরামে থাকতে থাকতে কিস্তিতে কিস্তিতে লোন শোধ করে।

কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিয়ে হয়েছে পার্থর আর সুচেতার। সুন্দরী, সুশিক্ষিত সুচেতা সুন্দর করে সাজিয়েছে ঘর।
শাশুড়ি বউ দোকানে দোকানে ঘুরে ম্যাচিং করে কিনেছে পর্দা থেকে চাদর।
প্রতিটা ঘরের আসবাবপত্রের মধ্যেও একটা শৌখিনতার ছাপ। ঘরে ঢুকলেই দামি জিনিসের আভিজাত্য টুকু চোখে পড়ে।
এইতো মাত্র কয়েকদিন আগেই রান্না ঘরের ইন্টেরিয়র বদলে ফেলল। আগের ইন্টেরিয়ার এর সাথে লিভিংরুমের ইন্টেরিয়ার ঠিক ম্যাচ খাচ্ছিল না।

সব মিলিয়ে পার্থর এখন বেশ গোছানো সংসার। বোনের বিয়ে হয়ে গেছে।
বাবা মা সুচেতা পার্থ, বেশ সুখের সংসার।

করোনার জন্য সব লন্ডভন্ড, দেশজুড়ে তথা বিশ্বজুড়ে লকডাউন চলছে।
পার্থদের যদিও ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলছে।
কয়েকদিন আগে হঠাৎই ওদের প্রোজেক্ট বন্ধ হয়ে যায়, নতুন প্রজেক্ট এর আশা এখন প্রায় নেই।
কাল রাতে এসে গেছে টার্মিনেশন লেটার।
পার্থর চোখের সামনে ভাসতে থাকে ঘরের ইএমআই গাড়ির ইএমআই ক্রেডিট কার্ডের লোন ……
তারপর:-
সকাল থেকে টিভি চ্যানেল গুলোতে ব্রেকিং নিউজ, “লকডাউন এর জেরে চাকরি খুইয়ে আত্মঘাতী ইঞ্জিনিয়ার।”
পর্দায় ভেসে ওঠা ছেলেটাকে একদম পার্থর মত দেখতে।

….সমাপ্ত……

Loading

6 thoughts on “গল্প- করোনাকাল

Leave A Comment