।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
ঠাকুরানীর দোর
-সুতপা মন্ডল
কলেজের বন্ধু অমলের দৌলতে জীবনে প্রথম গ্রাম দেখা সুপ্রতিমের। স্টেশন থেকে নেমে বাস, আবার বাস থেকে নেমে রিকশায় প্রায় চল্লিশ মিনিট, কলকাতায় বড় হওয়া সুপ্রতিমের কাছে যোগাযোগের এমন অবস্থা সত্যি আশ্চর্যের।
গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই চাষাবাদ করেন, যারা চাকরি করেন তারা কখনো সখনো গ্রামে আসলেও পূজা-পার্বণে, বেশিরভাগ বাইরেই থেকে গেছেন।
মন ভালো করা আতিথিয়তা আর মানুষের সারল্যে একবারে মুগ্ধ সুপ্রতিম।
ওর কাছে গ্রাম মানে ছিল শুধুমাত্র সিনেমায় দেখা, কিন্তু সত্যি যে গ্রামের রূপ এত সুন্দর হয় এখানে না এলে বুঝতে পারত না। সে যেন শুধু অমলের বাড়ির অথিতি নয় পুরো গ্রামের অতিথি।
তাই গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ি থেকে তার জন্য আসে নিমন্ত্রণ, ” আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসো গো বন্ধু”, খুব ভালো লাগে সুপ্রতিম এর। এই কথা তো সে কলকাতাতে ভাবতেই পারেনা। গ্রামের সবার বাড়ি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে একটা বাড়ি ওর মনে কৌতূহল জাগায়। বাড়িটাতে কেউ আছে বলে মনে হয় না তবুও মড়াই বাঁধা আছে, রান্না চালা আছে, যদিও প্রতিদিন রান্না হচ্ছে না, বড় বড় গামলা ধুয়ে মুছে রাখা যেন ওতে খাবার ছিল এখনই কেউ ধুয়ে রেখে গেছে ।
বাড়িটির বিশেষত্ব আলাদা, উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাড়িটির প্রবেশদ্বারে কোন দরজা নেই। একটা জায়গা রং করে তার উপরে অন্য রং দিয়ে লেখা আছে “ঠাকুরানীর দোর।” বাড়িটি যে খুব যত্নে আছে সেটা দেখলেই বোঝা যায়।
সন্ধ্যেবেলা গল্প করতে করতে তমালকে বাড়িটির কথা জিজ্ঞাসা করতেই উঠে এল এক অভূতপূর্ব কাহিনী।
ওই গ্রামেরই মেয়ে বাল্যবিধবা এক নারী শৈলজার কথা। আর তাও আজকের নয় প্রায় একশ বছর আগের একটি মেয়ে, স্বাধীনতার আগের একটি কাহিনী।
মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল শৈলজার। মেয়ে বারো বছরের হলেই শ্বশুরবাড়ি পাঠানো হবে এরকমই ঠিক করেছিলেন বাবা-মা। কিন্তু শৈলজার আর শ্বশুর বাড়ি যাওয়া হলো না, মাত্র নয় বছর বয়সেই বাপের বাড়িতে বসেই হয়ে গেলেন বিধবা। স্বামীর কথা তার কিছুই মনে নেই। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ দের তত্ত্বাবধানে শৈলজার শুরু হলো নিয়ম-কানুন শিক্ষা।
একটু বড় হতে না হতেই শৈলজা সাংসারিক বুদ্ধিতে নিপুন হয়ে উঠল, তাকে কেউ হারাতে পারত না।
এই গ্রামেরই মেয়ে হওয়ায় সব বৌদিদের সে ঠাকুরঝি আদরের ঠাকুরানী। দিনে দিনে শৈলজা নামটাই সবাই ভুলে গেল। তার নতুন নামকরণ ঠাকুরানী।
নিজের কোন সংসার ছিল না ঠিকই কিন্তু এই গ্রামের প্রতিটি সংসার ছিলো তার নিজের সংসার। মানুষের আপদে-বিপদে সবার আগে ছুটে আসতেন ঠাকুরানী। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে শলা-পরামর্শর জন্য সবার আগে ঠাকুরানীর কাছে আসতো সবাই। আবার তার শাসনও ছিল প্রচুর। আচার-বিচার নিয়ম-কানুন থেকে রক্ষা ছিলনা কারোর। সে যেমন মানুষকে ভালবাসতো তেমনি শাসন ও করত কড়া হাতে।
বাবা মা চলে যাবার পর আরো একা হয়ে যায় শৈলজা। তখন আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরতে থাকে গ্রামের মানুষ গুলিকে।
পুরো গ্রামের মানুষ যেমন ভালবাসতো তেমনই মান্য করত। গ্রামের প্রতিটি জিনিস ছিল ঠাকুরানীর নখদর্পণে। ঠাকুরানীর চোখ এড়িয়ে কোন কিছু সম্ভব ছিল না। এই গ্রামের মেয়ে হওয়ার সুবাদে পুরুষদের সাথে কথা বলতেও তার কোন ভয় ছিল না কখনো কখনো তারাও সাংসারিক বুদ্ধি ধার নিতো ঠাকুরানীর কাছে। ঠাকুরানী ছিল ন্যায়ের পক্ষে তার কথা মান্য করবে এই গ্রামের কারো সাহস ছিলনা। এক কথায় তিনি ছিলেন এই গ্রামের “রাজ্যহীন রাজকন্যা” ভালোবাসার শাসক।
একবার বন্যায় আশেপাশের সব গ্রাম ডুবে যায় ক্ষতি হয় এই গ্রামের বেশ কিছু মানুষের। মানুষের আর্তনাদে মন কেঁদে ওঠে ঠাকুরানীর। তার ঘরের উঠোনে কাটা হয় বড় বড় উনুন । নিজের ঘরের ধানের গোলা খুলে দেন সর্বহারা মানুষগুলোর জন্য। মানুষগুলো ঠাকুরানীকে আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরে। বন্যার জল আস্তে আস্তে সরে যায়। স্বাভাবিক হতে থাকে জীবন কিন্তু ঠাকুরানীর মনের মধ্যে রয়ে যায় একটা বিরাট দাগ, এই বিপদ আবার আসতে পারে, তখন কি হবে সেই ভাবনায়।
তার পরেই তিনি এই অভাবনীয় পরিকল্পনা নেন। এই গ্রামের প্রতিটি সচ্ছল পরিবার থেকে প্রতিদিন একজনের মত খাবার দিয়ে আসতে হবে ঠাকুরানীর ঘরে ওনার নিজের জন্য নয়, তাদের জন্য যাদের খাবার জোটেনি সেদিন।
বিকেল হলেই ঠাকুরানী বেড়িয়ে পড়তেন লাঠি নিয়ে, সবার ঘরের দরজায় একটা হাঁক ” কিগো বউ কত দেরি সাঁঝ হয়ে এলো যে” ।
ঠাকুরানীর ঘরে খাবার খেতে আসতো আশেপাশের বহু গরিব গরিব মানুষ, যতদিন ঠাকুরানী বেঁচে ছিলেন ততদিন তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থাকতেন ওদের খাবার সময়।
ঠাকুরানীর কথা ছিল “কেউ যেন না খেয়ে ঘুমায় না, তাতে যে গৃহস্থের অকল্যাণ হয়” । এই গৃহস্থ বলতে তিনি তার গ্রাম বলতেন।
ঠাকুরানীর জমি থেকে যা আয় হত তা খরচা হত গ্রামের কল্যাণের কাজে।
গরিবের বাড়ির মেয়ের বিয়েতে আরো নানারকম সমাজকল্যাণমূলক কাজেতে।
ঠাকুরানী তৈরি করিয়েছিলেন এই গ্রামের পাঠাগার। বিদ্যালয়ের বাড়িটিও তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
তিনি যতদিন ছিলেন তার সবকিছু দেখভাল তিনি নিজেই করতেন কিন্তু তিনি চলে যাবার পর গ্রামের মানুষরা নিজেরাই এর পরিচালনা করতে থাকেন।
মানুষের মনে আজও বিশ্বাস ঠাকুরানী এখনো এই গ্রামে লাঠি ঠুকে ঠুকে ঘুরে বেড়ান, তার লাঠির আওয়াজ নাকি এখনো সন্ধ্যেবেলা পাওয়া যায়, সন্ধের আগেই সব বাড়ি থেকে খাবারের থালা আজও চলে আসে ঠাকুরানীর দোরে। কোন অভুক্ত যেন না খেয়ে ঠাকুরানীর ঘর থেকে যায়।
রাতের আঁধারে এখনো অনেক মানুষ খেয়ে যান ঠাকুরানীর দোরে।
গ্রামের ছেলেরা পাত পেরে খাওয়ায় তাদের।
সুপ্রতিম স্তম্ভিত। মনে মনে প্রণাম করেন সেই মৃত্যুঞ্জয়ীকে।
কি জানি তিনি হয়তো গ্রামের আনাচে-কানাচে সত্যিই ঘুরে বেড়ান।
……সমাপ্ত………