।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
মধুমাসের আলিঙ্গনে
-পায়েল সাহু
হ্যাঁ, ওরা ভালোবাসে দুজন দুজনকে, শত অমিল, ভুল বোঝাবুঝি, ঝগড়া সব কিছু পার করেও শেষ পর্যন্ত একসাথেই হাত ধরে চলে |
ওরা নীলাভ আর চন্দ্রিমা | দুজনেই বিবাহিত এবং জমিয়ে সংসার করে ছেলেমেয়ে নিয়ে, তবু কোথাও একটা বড়ো ফাটল ছিলো লোকচক্ষুর অন্তরালে দুজনের সংসারেই, যতটা ফাটল থাকলে একটা গোটা মানুষ ঢুকে পড়তে পারে অন্যের মনের জগতে, দখল নিতে পারে অন্যজনের সম্পূর্ণ অস্তিত্ত্বের |
নীলাভ বেশ বড়ো মাপের ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, সমস্ত দিনের ব্যস্ততা সামলেও তার শখ কবিতা পাঠ এবং আবৃত্তি করা, অন্যদিকে চন্দ্রিমা বহুদিন ধরে বাচিক শিল্পের সঙ্গে যুক্ত এবং বেশ নামী শিল্পী |
আলাপের সূত্র বাচিক শিল্প হলেও সম্পর্কটা বন্ধুত্ব থেকে আরো বেশিদূর এগোতে সময় নেয়নি |অথচ কেউই তার সংসারের ফাটলের কথা কখনো কারো কাছে স্বীকার করেনি, শুধু অনুভব করেছে অন্যের একাকিত্বের, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত রকম অভ্যাস হয়ে উঠেছে একে অপরের |
দিনটা ছিলো পয়লা বৈশাখ, শান্তিনিকেতনের সোনাঝুরিতে অনুষ্ঠিত অপূর্ব এক সাহিত্য বাসরে অংশগ্রহণ করতে এসেছিলো ওরা দুজন, বাচিক স্কুলের আরো অনেকের সাথেই |
কিন্তু ফেরার সময় কিভাবে যেন আলাদা হয়ে গেলো সবার থেকে, হয়তো বা ইচ্ছে করেই | অবশ্য এমনটাই প্ল্যান ছিলো ওদের, দুজনে একা হওয়ার | নাই বা হলো নিভৃতি, তবু পাশাপাশি হাত ছুঁয়ে হাঁটা, দুজনের হাজার কথা বলা, একসাথে পাশাপাশি বসে বাড়ি ফেরার সময় টুকু একসাথে থাকা | ফোনে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দেওয়ার সময় কেউ তো কাউকে দেখতে পায়না, তাই মুখোমুখি, পাশাপাশি বসে বন্ধুত্বের উদযাপন করার সুযোগ নিলে ক্ষতি কি !
কিন্তু ওরা যখন সত্যিই একা হলো,সামান্য একটু কথার পরেই দুজনেই যেন খেই হারিয়ে ফেললো, কি যেন বলার ছিলো, কি যেন অভিযোগ ছিলো, শুধু চুপ করে পাশাপাশি আঙুল ছুঁয়ে ফেরার গাড়িতে বসে রইলো ওরা,মাঝেমাঝে দুজন দুজনের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলতে চাওয়া ” আমার সব টুকুই তোমার, যা কিছু ভুল বোঝা ছিলো, আজ অনুভব করে নাও, সেসবই যে মিথ্যা “|
নেমে যাওয়ার সময় আগে এলো চন্দ্রিমার, বিদায় বেলায় নীলাভ আকুল হয়ে শুধু দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো চন্দ্রিমার হাত, চন্দ্রিমার চোখে তখন টলমল করছে মুক্তোর মতো অশ্রুবিন্দু |
নীলাভর চোখের মৃদু শাসনে মৃদু হাসিতে মুখ ভরিয়ে চন্দ্রিমা বলল ” এই স্পর্শটুকু সঞ্চয় করে রাখবো চিরকাল “|
চন্দ্রিমাকে বিদায় জানিয়ে নীলাভ যেন আজ নতুন হলো, নতুন পুরুষ হলো কারো জীবনে, বিগত পাঁচ বছরের সম্পর্কে যেন নতুন রং দিয়ে গেলো মধুমাসের প্রথম দিন, চন্দ্রিমার উষ্ণতার পরশে সত্যিই যেন বৈশাখ ছুঁয়ে গেলো তাকে , তার সলজ্জ দৃষ্টির ভাষায় যেন নতুন করে চিনলো তার প্রেয়সীকে | এ কি সত্যিই পরকীয়া?? নাকি বন্ধুত্বের থেকে আরো কিছু বেশি ভরসায়,বিশ্বাসে, আবদারে, অভিযোগে গড়ে ওঠা এক মধুর সম্পর্ক | নিজের মনেই হেসে ফেলে নীলাভ, অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকা সহযাত্রীদের দৃষ্টি উপেক্ষা করে আজ প্রাণখোলা আনন্দে উদাত্ত কণ্ঠে গেয়ে উঠলো
” দুচোখে হঠাৎ করে কালবৈশাখী/
চৈত্রের শেষ বেলা পাতা ওড়ে নাকি?/
গত বছরের মায়া ভেঙে যাবে বলে,/
রাজপথ ভেসে গেছে অচেনা কাজলে,/
তুমিও অঝোরে তাকে শুধু ভালোবেসো… এসো হে বৈশাখ, এসো এসো “|
সমাপ্ত