Site icon আলাপী মন

প্রবন্ধ- লীলাময়ী লীলা মজুমদার

।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।। 

 

লীলাময়ী লীলা মজুমদার
-সুমিতা দাশগুপ্ত

 

 

বড়ো ইচ্ছে, তাঁর জন্মদিনে একখানা হলদে পাখির পালক উপহার দিই ।
তুমি বলবে — ওমা সে তারিখ তো কবেই পেরিয়ে গেছে !
আমি বলি তাতে কী? তারিখ পেরিয়ে গেলেই তো আর জন্মদিনটা মিথ্যে হয়ে যায় না , বিশেষ করে আপামর বাঙালির বুকের মধ্যে একখানি মায়ার পিদ্দিম জ্বালিয়ে দিয়েছেন যিনি তাঁর তো প্রতিটি দিন‌ই জন্মদিন!
হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, তিনি হলেন আপামর বাঙালি পাঠকের প্রিয় লীলাময়ী, লীলা মজুমদার ।
এখন মুশকিল হলো উপহারটা যে দেব ,তা সেই পালকখানা পাই কোথায়? তাকে তো ঝগড়ু আর ঝগড়ুর ভাই ছাড়া কেউ দেখেই নি !
গুণুপন্ডিত বললে -” তা ওকেই শুধোও না গিয়ে।”
আহা, তা কি আর আমি ভাবিনি ভাবছো , মুশকিল হলো ঝগড়ুকেই বা পাই কোথায়!।সে তো বোগি আর রুমুকে সঙ্গে নিয়ে সারা দুপুর ,খোয়াই এর মধ্যে সেই ফুল খুঁজে বেড়ায় ,যা নাকি কক্ষনো শুকোয় না। কবে থেকে যে খুঁজেই চলেছে,আজ‌ও পায় নি -তবে কিনা চায়‌ও না পেতে! বলে, পেয়ে গেলেই তো সব মজা মাটি!
গণশা পরামর্শ দিলে — “পদিপিসির বর্মীবাক্সটা একবার খুঁজে দেখলে হতো না? ধনরত্নের মধ্যে যদি একখানা পালক‌ও লুকিয়ে থাকে! ” শুনে গুপির সে কী হাসি !বললে
“ওরে সে বাক্স তো এখন খালি।ওর ভিতরের সোনাদানা, মণিমুক্তো,মায় , বিয়ের আসর থেকে চুরি যাওয়া মন্তরের পুঁথিখানা পর্যন্ত কবেই ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়ে নিয়েছে সবাই।”
তাহলে উপায়?
আচমকা পেরিস্তানের চোরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কালোমাস্টার বললে—
“সবাই জানে আমি মানুষটা মোটেও সুবিধের ন‌ই, কাউকে যেচে পরামর্শ দিই নে, কিন্তু এই যে ছেলেটা এর মতো এতো ভালো মনের মানুষ
ভূ ভারতে আর কোথাও দেখলাম না। আমায় আশ্রয় দিয়ে, লুকিয়ে রেখেছে ওর গোপন আস্তানায়, বাড়ি থেকে খাবার চুরি করে এনে খাওয়ায়।
তাই হদিশখানা বলেই দিচ্ছি। ঐ সামনের পাহাড়ে পাকদন্ডী বেয়ে উপরে উঠে যাও দিকিনি, ওখানে পাহাড়ের ঢালে বড় লামা থাকে ।ওর পুষ্যি হলো ধিঙ্গিপদ , সারা দিনমান ,হেথা হোথা ঘুরে ফিরে কাজকর্ম করে , দুনিয়ার খবর তার নখদর্পণে। শোনো তাকে আবার আহ্লাদ করে ঘাস খাওয়াতে যেও না যেন , সে কেবল সুয্যির আলো খায়।”
বড়লামার বাড়ি পৌঁছে দেখি,ধিঙ্গিপদ রোদে কাঠকুটো শুকোতে দিচ্ছে , আমাদের তো পাত্তাই দেয় না,বড় গুমোর তার, অনেক সাধ্যসাধনার পর, বললে
” যতদূর জানি পাহাড়চূড়োয় মেঘের দেশে যে বাতাসবাড়ি, হলদে পাখি ইদানীং সেখানেই আশ্রয় নেছে ,আর কিছু জানি নে ,যাও ভাগো” ।
তাড়া খেয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। তারপর ধিঙ্গিপদর কথামতো
পাকদন্ডী বেয়ে উঠছি তো উঠছিই , চারপাশে সে কী ঘন বন, বনের মধ্যে হু- হু করে হাওয়া বয় , পাতার ফাঁক দিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া সূর্যের আলো , আড়াল থেকে কারা যেন উঁকি ঝুঁকি মারে , তাকালেই চট করে সরে যায় ,সে ভারি রোমহর্ষক ব্যাপার! ভয় কাটাতে গুপি পকেট থেকে টিনের ব্যাঙ্ কটকটিখানা বের করে যেই না, কটকট করতে লেগেছে ওমনি কোথা থেকে একদল নোংরা জামাকাপড় পরা ছেলে মেয়ে এসে আমাদের পাশে পাশে হেঁটে ভয়ের রাস্তাটুকু পার করে দিয়ে গেল। একটাও কথা ক‌ইলে না। বোবা নাকি রে বাবা!
বন ছাড়িয়ে একটু উপরে উঠেই দেখি, মাথার উপরে উপুড় করা প্রকান্ড একখানা গামলার মতো কী চমৎকার নীল আকাশ,রাস্তার ধারে ধারে, বাগান ঘেরা চমৎকার সব বাড়িঘর। সাদা রেলিং দেওয়া কাঠের বারান্দায় সারি সারি টবে র‌ঙবেরঙের ফুল ফুটেছে, বাগানে নাসপাতিগাছে , সোনালীরঙা রস টুপটুপে পাকা ফলের বাহার । আরে এইটিই তো তাঁর ছেলেবেলার বাড়ি।
এরপর যতো এগোই পাকদন্ডীর প্রতিটি বাঁকে ,থুড়ি পৃষ্ঠায় কতো যে বিখ্যাত মানুষের ঠিকানা! তাঁদের অতুলনীয় কীর্তি কলাপ , অসামান্য জীবনযাপনের মনকাড়া গপ্পো।
ও হরি !এতক্ষণ বলি নি বুঝি , হলদে পাখির পালক খোঁজার অছিলায় তাঁর‌ই লেখা বই নিয়ে বুঁদ হয়ে আছি আবারও। আহা ,যদি সত্যি হতো এই পথ চলা ! হঠাৎ শুনি মনের ভিতর ঝগড়ুই কথা কয়ে উঠলো
“সত্যি যে কোথায় শেষ হয়,আর স্বপ্ন যে কোথায় শুরু বলা মুশকিল।কেন তোমাদের রবিঠাকুর‌ই তো বলে দিয়েছেন ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি ,ঘটে যা ,তা সব সত্য নহে’ —পড়ো নি বুঝি!”
এতক্ষণে হয়তো বিজ্ঞজনের ভ্রূ কুঁচকে গেছে। —এটা আবার কী ধরনের প্রবন্ধ ! গুরুগম্ভীর একখানা বিষয়, থান ইটের মতো শক্ত শক্ত শব্দ আর, তথ্যের বুনটে ঠাসা থাকবে , তবেই না বুঝি! কিন্তু কী আর করা , যাঁর সম্পর্কে লিখতে বসেছি তিনি মানুষটাই যে এমন‌ই। সহজ সরল ভাষায় ,কখন যে মনের মধ্যে সেঁধিয়ে যান ,কেউ টেরটিও পায় না। তাঁর চরিত্রদের কেউ বা “বারান্ডাওয়ালা” টুপি পরে, আবার কারোও বা উত্তেজনায় চোখ “জ্বলজ্বলিং”।
যাঁর বর্ণনার এমন সহজ সরল ভাষা, তাঁর জন্য এমন ভাষাই তো লাগস‌ই ,কী বলো!
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভাইঝি, সুকুমার রায়ের বোন ,এই পরিচয় পাশে সরিয়ে রেখে , অনায়াসেই নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছেন শিশুসাহিত্যের পোক্ত জমিতে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় ছাত্রী, স্বর্ণপদকসহ , রবীন্দ্র পুরস্কার ,দেশিকোত্তম আরও কতশত সম্মাননায় ভূষিত, কর্মজীবনে কখনও বা রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে বিশ্বভারতীর শিক্ষকতা আবার কখনও বা কেন্দ্রীয় সরকারে উচ্চপদের গুরুদায়িত্ব ,এইসব সামলেও, তিনি অনায়াসেই খেলতে নেমে পড়েন শিশুমনের আঙিনায়।
কথায় বলে , নিজের ছেলেবেলা ভুলে যাওয়া নাকি মহাপাপ। লীলা মজুমদারের কলমের মায়ায় ,ঘটে যায় সেই শাপমুক্তি। কতো কী-ই যে মনে পড়িয়ে দেন তিনি! বাথরুমে বন্দী কতশত দুষ্টু শিশুকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন সাবানের ফেনার রঙিন বুদবুদে রামধনু তৈরী করার ফন্দি ফিকির , আঙুলের ডগায় স্কেল নাচানোর খেলা , তিনিই তো শিখিয়ে দিয়েছেন কতগুলো ফুটোকে ময়দা দিয়ে জুড়ে তৈরী হয় পাঁউরুটি।
সেইসব মনে পড়তেই প্রাপ্তবয়স্করাও নিজেদের অজান্তেই সামিল হয়ে যান শিশুদের সঙ্গে পথ হাঁটতে। চলে লম্বা শোভাযাত্রা ‌।সেই শোভাযাত্রায় থাকে , কানকাটা নেড়ি ,ডানা ভাঙা পাখি,পকেটমার , বাঁশ বাগানের ভূতের দল, মায় রাতের বেলায় পুল পার হ‌ওয়া মালগাড়ির চেনে লেগে থাকা গানের সুর , টং -লিং – টং লিং।
দৈনন্দিন জীবনের ব্যথা বেদনায় দরদী হাতে মলম লাগিয়ে দিতে তাঁর জুড়ি নেই। বুঝিয়ে দেন এই পৃথিবীটা মোটেও স্বর্গরাজ্য নয় , ভালো লোকের পাশাপাশি চোর জোচ্চোর ফেরেববাজের‌ও অভাব নেই কিন্তু তাই বলে ‌তোমার মনের ভিতরে মায়ার প্রদীপখানি কিছুতেই নিভতে দেওয়া চলবে না। কারণ তুমি যে ‌মানুষ!
তাঁর মুখচ্ছবিতে তামাম বাঙালি খুঁজে পায় নিজের ঠাকুমার আদল , আদর করে‌ সকলের মনেই গেঁথে দিয়ে গেছেন জিয়নকাঠির মন্ত্র।তাই তো মনখারাপের আঁধার পেরিয়ে আজও ভোরের আলোয় হেসে ওঠে বাঙালি ,পায় প্রতিদিনের পথ চলার নতুন উৎসাহ।

Exit mobile version