।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ।।
ফেরিওয়ালা
-উজ্জ্বল সামন্ত
স্টেশনে দাঁড়ায় ছুটে এসে, বাড়ি থেকে অনেকটা পথ পায়ে হেঁটেই আসতে হয়। একটা ভাঙা সাইকেল ছিল কিন্তু সেটা বয়সের ভারে অকেজো হয়ে গেছে। সেই ভোর বেলায় উঠে নানা রকম কাঁচামাল কেটেকুটে রেডি করে মালপত্র গুছিয়ে ব্যবসায় বের হতে হয়, অনেকদিন ধরেই এই রুটিন চলছে। সকালের প্রথম ট্রেনটা মিস হয়ে গেল। ওখানে অনেক ডেলি পেসেঞ্জার যাতায়াত করে। বেশ কিছু বিক্রি হয় । মদন মজুমদারের মসলা মুড়ি খাইনি এমন কোন ডেলি প্যাসেঞ্জার নেই ওই ট্রেনে।
শিয়ালদায় নেমে আবার এ লোকাল সে লোকাল ট্রেন ধরে সারাদিন বিক্রি করে। দুপুরে এক ফাঁকে শিয়ালদার স্টেশন সংলগ্ন রাস্তার হোটেলে ভাত খেয়ে নেয় । সবজি ভাত। প্রতিদিন তো আর মাছ ,মাংস ,ডিম জোটে না। কতটুকুই বা বেচাকেনা হয়। বাড়িতে দুটো বাচ্চা মেয়ে আছে । ওদের জন্য সপ্তাহে একদিন একটু মুরগীর মাংসের ছাঁট নিয়ে যায়। মেয়ে দুটো বড্ড ভালোবাসে খেতে। স্কুলের মিড ডে মিলে একটা করে ডিম দেয়। দুটো ডিম মেয়েরা লুকিয়ে বাড়িতে নিয়ে এসে আধখানা করে চারজন মিলে খায় রাত্রে । ওইটুকু মেয়েও বোঝে তারা গরীব।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, এক পিস চিকেন, ভাত খাওয়ার সময়। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনা। কোনরকমে ভাতগুলো মুখে ভরে। মুড়ির বাক্স সমেত ঝোলা নিয়েই স্টেশনের বাইরে ৪/৫ জন হকারকে মসলা মুড়ি বানিয়ে দিয়েই স্টেশনে ছোটে লোকাল ধরতে। স্টেশনের বাইরে ওই হকার গুলো প্রতিদিন ওর কাছে মসলা মুড়ি কিনে খায় দুপুরে। অনেকদিন হয়ে গেল একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে ওদের মধ্যে। পুজোর আগে স্টেশনের বাইরে ১জন হকার মেয়ে দুটোর জন্য জামা দেয় বিনামূল্যে। বেশ কয়েক বছর দিয়ে আসছে।
আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। কাল রাতের ঝড়ে ঘরের টালির ছাদে কটা টালি ভেঙেছিল। প্রচুর বৃষ্টি তে ঘর প্রায় জলে ভেসে গেছে। সারারাত চারটি প্রাণীর কোন ঘুম নেই। কোথাও বালতি কোথাও হাড়ি কোথাও থালা দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি। তাই বুঝি নিজেই ওদের বস্তি থেকে একটা মই জোগাড় করে টালি গুলো বসাবে। ধার করেই টালি লাগাবে এখন। অমর দা বলেছেন পরে টাকা দিলেই হবে।
অন্য মনস্ক হয়ে ট্রেন থেকে রানিং অবস্থায় নামতে গেলে বৃষ্টিভেজা প্লাটফর্মে পা হড়কে ট্রেনের স্লিপারের নিচে পা আটকে যায়। ফাস্ট প্যাসেঞ্জার স্টেশনে থামলে ,প্ল্যাটফর্মে মদন অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে আছে। বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ মারাত্মক জখম হয়েছে। হাড় ভেঙে মাংস ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে। আরপিএফ বা অন্যান্য হকাররা ছুটে আসে। মদন কে সরকারি হসপিটালে ভর্তি করা হয়। প্রাণে বেঁচে গেলেও অপারেশন করে মদনের হাঁটুর নিচের অংশ কেটে বাদ দিতে হয়। এর কিছু দিন পরই অতি মারির প্রকোপ শুরু হয়। লকডাউন চলতে থাকে। বাস-ট্রেন সব বন্ধ। রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। বাড়ি ফিরে এসে মদন বিছানায়। সুস্থ হতে মাস খানেক সময় লাগবে।
সংসারের বেহাল অবস্থা। দুবেলা দুমুঠো ভাত জোটানো এখন চিন্তার। ওর স্ত্রী দু বাড়ির ঝিয়ের কাজ করতো। কিন্তু ছোঁয়াচে রোগের কারণে বাড়ির মালিক বারণ করেছে কাজে আসতে। ওর মধ্যে এক বাবু বলেছেন তোকে কাজে আসতে এখন হবেনা । আমি মাস মাইনে দিয়ে দেবো। ওর অ্যাক্সিডেন্টের খবর পেয়ে বস্তির আরো তিন চার জন হকার বন্ধু এসেছিল, যে যা পেরেছে কিছু কিছু অর্থ সাহায্য করেছে। কিছুদিন আগে একটা এনজিও এসে চাল ডাল তেল নুন দিয়ে গেছিল। ওই কটা দিন মোটামুটি চলেছে। রেশনের ফ্রী চাল ও গম পেয়েছে তাই এক বেলা কোন রকমে কিছু মুখে তুলতে পারছে। কিন্তু তারপর কি হবে , এই ভেবে ভেবে মদনের রাতের ঘুম উড়ে যাচ্ছে। একটা কৃত্রিম পা লাগাতে গেলেও অনেক খরচা। কোথায় থেকে পাবে এত টাকা!
হকার বন্ধু অজয় আজ সন্ধ্যায় এসেছিল মদনের সঙ্গে দেখা করতে। লকডাউনে তার ও তাদের মত হকারদের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। বস্তির কয়েকজন ছোঁয়াচে রোগের কারণে মারা গেছে। ওদের এক হকার বন্ধু গতকাল রাতে হসপিটালে ভর্তি হয়েছে। অবস্থা খুব একটা ভাল না। মদন ক্র্যাচ নিয়ে ওকে এগিয়ে দেয়। বলে লকডাউন উঠে গেলে আর ঘুরে ঘুরে ব্যবসা করতে পারবে না। অজয় বলে স্টেশনের বাইরে তুই একটা ব্যবসা কর। হকার ইউনিয়নের সেক্রেটারিকে বলে একটা জায়গার ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে। আমি অশোকদা কে বলে দেব।মহাজনকে বলে ব্যবসার কিছু মালও বিনা অ্যাডভান্সে করে দেবো। তুই এত চিন্তা করছিস কেন ? মদন। আমি তো তোর বন্ধু, এখনো বেঁচে আছি !…..