গল্প- মানবিক ও অমানবিক

।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।। 

 

মানবিক ও অমানবিক
অমিত কুমার জানা

 

 

মেদিনীপুর শহরের গোলাপীচকের যুবক ছেলে সুভাষ পেশায় মারুতি ড্রাইভার। সে তার বয়স্ক বাবা এবং অসুস্থ মায়ের সঙ্গে এককামরার একটা একতলা বাড়িতে থাকে। ওর মা মারাত্মক ‘নার্ভ ডিসঅর্ডার’ রোগে আক্রান্ত। ড্রাইভারি করে ওর যা উপার্জন হয় তার বেশিরভাগটাই মায়ের ওষুধ কিনতে খরচ হয়ে যায়। তবুও এতটুকু বিরক্ত না হয়ে মাতৃসেবা থেকে সুভাষ নিজেকে কখনও বিরত রাখে না।মা অসুস্থ থাকায় রান্নাবান্নার কাজটাও তাকেই সামলাতে হয়। প্রতিদিন সকালে রান্নাবান্না এবং স্নান, খাওয়া সেরে নটার মধ্যে মালিকের মারুতি নিয়ে সে চলে আসে কেরানীটোলায়। ওখানে অনেক মারুতির সাথে সেও অপেক্ষা করে ভাড়া ধরার জন্য।

সুভাষের একটি বিশেষ গুণ হলো পরোপকার। অপরের বিপদে আপদে নিজের সমস্যাকে হেয় করে সে সর্বদাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই তো মাসখানেক আগের কথা:
সুভাষ মারুতি নিয়ে অপেক্ষা করছিল রোডের পাশেই। হঠাৎ দুটো মোটর বাইকের মুখোমুখি এক্সিডেন্ট। একজন বাইক আরোহী লুটিয়ে পড়লো রোডের উপরে । তার অচেতন দেহ থেকে রক্তস্রোত বেয়ে পড়ছিল। সুভাষ বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে মারুতিতে করে আহত আরোহীটিকে পৌঁছে দিয়েছিল নিকটবর্তী জেলা হাসপাতালে। ডাক্তার তার খুব প্রশংসা করে বলেছিল যে বেশি দেরী হলে অত্যধিক রক্তক্ষরণের জন্য বাঁচানো সম্ভব হতো না। এতে সুভাষ যেন অমূল্য পুরস্কার প্রাপ্তির এক অনাবিল আনন্দ পেয়েছিল। কেননা আর যাই হোক সে একটা জীবন বাঁচিয়েছে তো।

প্রতিদিনের ন্যায় সেদিনও সুভাষ মারুতি নিয়ে কেরানীটোলায় পৌঁছেছিল যথাসময়ে। মারুতির মধ্যে বসেই ছিল সে। কিন্তু সেদিন তার পেট ব্যথা করছিল খুব। হয়তো বদহজম হয়ে গেছিল। সে আর বিলম্ব না করে পার্শ্বস্থ মেডিসিন শপে গেল অ্যন্টাসিড কিনতে। তার চোখে পড়লো দোকানের সামনেই পড়ে রয়েছে এক বান্ডিল টাকা। প্রথমে সে হকচকিয়ে গেল। তারপর টাকার বান্ডিলটা হাতে তুলে নিয়ে দেখল বান্ডিলের সবকটি নোটই দুহাজারের। গুনে দেখলো মোট পঞ্চাশ হাজার টাকা রয়েছে। সে তৎক্ষণাৎ ওই মেডিসিন শপে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো যে এটা ওদের কারও কিনা। দু একজন মিথ্যা বলে ঐ বান্ডিলটা আত্মসাৎ চেষ্টাও করলো। অথচ যে হতভাগা মারুতি চালিয়ে সামান্য উপার্জন করে মায়ের জটিল রোগ নিরাময়ের চেষ্টায় নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে তার ঐ টাকার প্রতি কিঞ্চিৎমাত্র লালসা নেই। সত্যিই এ যুগেও কোন কোন মানুষের অভাবেও স্বভাব নষ্ট হয় না। সুভাষের মতো কেউ কেউ শত কষ্ট নির্বিঘ্নে সহ্য করেও অমূল্য মানবতা ও সততাকে আঁকড়ে ধরে রাখে।
এই ঘটনার মাত্র মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সেখানে হাজির হলো বহুমূল্য প্যান্ট শার্ট পরিহিত এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। এসে না এসেই মেডিসিন শপে জিজ্ঞেস করলেন ,-“আমি এইমাত্র আপনার দোকান থেকে ফিরে গেছি। কিন্তু আমার পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা বান্ডিল এখানেই পড়েছে বোধহয়। কেউ যদি…”
শপকীপারের মুখ থেকে শুনলেন ঐ ভদ্রলোক শহরের বিখ্যাত মেডিক্যাল রিপ্রেসেন্টেটিভ ।নাম প্রকাশ রায়। সুভাষ প্রকাশ রায়ের নামটা কোথায় যেন শুনেছে। সে প্রাণপণ মনে করে চেষ্টা করলো।
সুভাষ টাকার বান্ডিলটা প্রকাশ রায়ের হাতে তুলে দিয়ে বললেন,-“গুনে নিন ,ঠিক আছে কিনা।”
প্রকাশ রায় সুভাষের সততায় ভীষণ অভিভূত এবং আনন্দিত হয়ে বললেন,-” এই উপকারের বিনিময়ে তুমি কি চাও বলো?”

এবার প্রকাশ রায়ের কথা সুভাষের মনে পড়লো। সে কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা হৃদয়স্পর্শী ভিডিও দেখেছিল। হেডলাইনে লেখা ছিল “শহরের বিখ্যাত মেডিক্যাল রিপ্রেসেন্টেটিভের কি অমানবিক আচরণ।”
ভিডিওতে দেখাচ্ছে : কেরানীটোলার বাজারে প্রকাশ রায়ের দুটি পা ধরে একটা ক্ষুধার্ত পথশিশু ভিক্ষা চাইছে কিন্তু অসহিষ্ণু প্রকাশ রায় শিশুটিকে সপাটে চড় মেরে যাচ্ছে।

সুভাষ শিশু নিপীড়নের এই বেদনাময় স্মৃতির বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর প্রকাশ রায়কে মার্জিতভাবে বললো , -“এর বিনিময়ে আমার কিছু দাবি নেই। তবে আমার একটি পরামর্শ- আপনি ওই হতভাগা পথশিশুটির ওপর হাত তুলে ঠিক করেন নি। কারোর প্রতি সহানুভূতি না দেখাতে পারেন, তেমনই অসহায়ের প্রতি অত্যাচার করার অধিকারও আপনার নেই।”

ততক্ষণে সেখানে অনেক লোক জড়ো হয়ে গেছে। সুভাষের উপদেশবার্তা তাঁর মোটেই সহ্য হলো না। তিনি সুভাষকে টেনে তার গালে সজোরে দু চড় বসিয়ে দিলেন। তারপর ক্রোধের আগুনে জ্বলে উঠে বললেন, -” তোর এত বড় স্পর্ধা, তুই আমাকে জ্ঞান দিস্। ছোটোলোক কোথাকার…”
চারিদিকে যেন সবাই নির্বাক দর্শক! কেউ একজনও মানবিকতা প্রদর্শনের সাহস দেখাল না। একজনও এগিয়ে এলো না এই ঘৃণ্য অমানবিকতার বিরুদ্ধে সদর্পে প্রতিপাদ জানাতে।

আর বেচারা সুভাষ! তার তো আর কাজ নেই তাই পথশিশুর অত্যাচারের বিরুদ্ধে তার মার্জিত প্রতিবাদ করার মানবিকতা উপচে পড়ছে। পঞ্চাশ হাজার টাকায় তার মতো সাধারণ ছেলের হয়তো দশ- বারো মাস আরামেই কাটতো। তা না করে…
ইস্, সুভাষের মতো দুষ্প্রাপ্য নির্ভেজাল মানবিকতার প্রতীকটা যদি এমন ভাবতে পারতো!

এখনো কতিপয় সুভাষ বেঁচে আছে। বেঁচে আছে তাদের সততা,নিষ্ঠা, মনুষ্যত্ব। তারাই প্রকৃত জীবনের অর্থ উপলব্ধি করতে পারে। তারা যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব তা তারা প্রতিক্ষণে উপলব্ধি করতে পারে। এমন মহানুভবতার প্রতি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা উদ্ভাবিত হবেই হবে।
—–

Loading

Leave A Comment