।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
সাপ লুডো
-সুতপা মন্ডল
কোর্ট থেকে বেরোনোর পর অনীক বুঝে উঠতে পারে না তার এখন কি করা উচিত। আজ ফাইনালি ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর সে খুশি হবে না দুঃখ পাবে।
তবে একটা কথা ঠিক, সুচেতনাকে নিয়ে তার আর কোন দায়িত্ব রইল না।
শুধু বাচ্চাগুলোর জন্য খারাপ লাগলেও কে জানে বাচ্চাগুলো আমার তো! নিজের মনে নিজেই হেসে ওঠে অনীক।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে একটা ট্যাক্সি ধরে বলে বাবুঘাট।
নদীর ধারে সিঁড়িতে বসে থাকে চুপচাপ।
এই জায়গাটা তার প্রিয় ছিল একসময়, মন খারাপ হলেই চলে আসতো এখানে।
অবশ্য সুচেতনাকে নিয়েও বহুবার এসেছে এখানে বিয়ের আগে।
সুচেতনার সাথে বিয়েটা প্রেম করেই হয়েছিল। সত্যিই প্রেম!
এক বন্ধুর মারফত আলাপ হয়েছিল। স্মার্ট সুন্দরী সুচেতনা কে দেখলে যে কোন ছেলেই প্রেমে পড়তে বাধ্য।
অনীক তখন ডিপ্লোমা পাস করে একটা এমএনসি তে জুনিযার হিসেবে ঢুকেছে। মধ্যবিত্ত ঘরের সাদামাটা ছেলে কি করে একটু বেশি টাকা রোজগার করবে সেটা নিয়েই ভাবতো অন্য কিছু নিয়ে ভাবার অবস্থা তার ছিল না।
আর মেয়েদের ব্যাপারে তার একটু অনীহায় ছিল স্কুল-কলেজও খুব একটা মেয়ে বন্ধু নেই শুধু ‘ শ্রী’ ছাড়া, পাশাপাশি একসাথে বড় হয়েছে তারা।
ওই বন্ধু একদিন বলেছিল চল তোকে, আজকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব , ‘আমি একজনকে বুক করেছি’। খুব খারাপ লেগেছিল অনীকের।
মন সায় দেয়নি ওর সাথে যেতে তবু বন্ধুর পীড়াপীড়িতে একরকম বাধ্য হয়েই সঙ্গী হয়েছিল।
সেই মেয়েটি ছিল সুচেতনা যে প্রফেশনালি একজন কল গার্ল।
অনীকের ব্যবহারে সে বুঝে গিয়েছিল তথাকথিত কাস্টমার আর অনীক এক গোত্রের নয়।
একটা অন্যরকম বন্ধুত্বের শুরু হয়ে গিয়েছিল সেদিন।
এরপর ওরা মাঝে মাঝে দেখা করতে থাকে, না ক্লায়েন্ট হিসাবে নয় একজন আরেকজনের বন্ধু হয়ে। ওদের মেলামেশায় ওরা অনুভব করতে থাকে অন্য টান।
একদিন অনীকই বলেছিল কথাটা ” সু, তুমি এই জীবনটা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারো না”!
-তোমার ভালো লাগে রোজ রোজ অন্য মানুষ।
-কি করবো বলো? আমি তো কোন চাকরি পাব না আমার মত মেয়েদের ঘর সংসারের স্বপ্ন দেখতে নেই।
সব কথা জেনে কোন সুপুত্তর বিয়ে করবে বলো?
-ধরো আমি যদি বলি আমার সাথে বাকি জীবনটা কাটানোর কথা।
– পারবেনা সু সবকিছু ভুলে আমার সাথে একটা সংসার গড়তে।
– অনি তুমি যা বলছ ভেবে বলছো তো!
তোমার মা-বাবা কেন মেনে নেবে আমার মত মেয়েকে তাদের ছেলের বউ হিসেবে।
-তুমি রাজি কিনা বল মা বাবার সাথে আমি কথা বলবো।
সুচেতনা হাতটা অনীকের হাতের উপর রাখে।
মা বাবা সব শুনে বলেছিলেন কোন মেয়ে এই জীবনটা চায় না নিশ্চয়ই অনেক যন্ত্রণায় বাধ্য হয়েছে এরকম একটা জীবন বাছতে। ” তুমি যদি মন থেকে মেনে নিতে পারো আমাদের কোন অসুবিধা নেই”।
আমাদের কোনো মেয়ে নেই আমরা ওকে নিজের মেয়ের মতো করেই রাখবো।
-অনীকের বন্ধুরা অবশ্য বারবার বারণ করেছিল সে শোনেনি, তার মনে হয়েছিল একটা মেয়ে শুধুমাত্র পরিস্থিতির শিকার কেন সুস্থ জীবনে ফিরতে পারবে না নিশ্চয়ই পারবে।
-তারপর চার হাত এক হতে বেশি দেরি হয়নি।
বিয়ের পর প্রথম দু’বছর শত্রুদের মুখে ছাই দিয়ে খুব সুখে কাটে।
কিন্তু তারপর থেকে হঠাৎ হঠাৎ দুপুর বেলা একটু ঘুরে আসি করে বেরিয়ে পড়তে থাকে সুচেতনা কোথায় যাবে কাউকে কিছু বলে না, তারি মাঝে আসে সুখবর।
অন্তঃসত্ত্বা বৌমাকে যত্ন করা দেখে পাড়া-প্রতিবেশী অনেক কথাই বলত কিন্তু অনীকের মা বলতেন ও তো আমার মেয়ে, ছেলের বউ নয় গো।
ওর দেখা শোনা করবো না তো কার দেখাশোনা করব!
দুটি ফুটফুটে যমজ সন্তান হয় ওদের। বেশ কিছুদিন সুখেই কাটে। বাচ্চা গুলো একটু বড় মানে এক বছর, আবার বেরিয়ে পড়তে থাকে সুচেতনা, দুধের শিশু গুলো কাঁদতে থাকে কিন্তু তবু সে বেরিয়ে পড়ে।
অনিকের মা অনেক বারণ করেছেন তোমার কি চাই বল আমরা এনে দিচ্ছি নয়তো বাবুকে বলো সে এনে দেবে, নয়তো বাবু ফিরলে একসাথে বেরিয়ো। তুমি এই সময় বাইরে বেরিও না, কিন্তু কে শোনে কার কথা, সে রোজ বেরিয়ে পড়তে থাকে ।
একদিন একটি ফ্লিম ম্যাগাজিনের কভার ফটোতে সুচেতনার আবেদনময়ী ছবি দেখে অবাক অনীক।
এ কোন সুচেতনা! অনীক তো এ ব্যাপারে বিন্দুবিসর্গও জানেনা।
এই ম্যাগাজিন যদি তাদের আত্মীয়-স্বজনরা দেখে, পাড়া-প্রতিবেশী দেখে তাদের যে বদনাম হবে, কেউ সহজভাবে নিতে পারবেনা, আর কিছু নয় তারা তো মধ্যবিত্ত।
সুচেতনাকে জিজ্ঞাসা করতেই রেগে ওঠে বলে তোমার যা রোজগার তাতে তুমি আমার কোন শখ-আহ্লাদ মেটাতে পারবে বলে মনে হয় না।
– তাই যা করেছি বেশ করেছি।
– ভালোই হলো তুমি জেনে গেলে আর লুকোচুরি দরকার হবে না।
তোমার এই মধ্যবিত্ত জীবন মানতে আমি পারবো না।
সুচেতনা ব্যবহারে কষ্ট পায় অনীকের মা-বাবা।
পাড়া-প্রতিবেশীর চোখের চাওনি রাস্তাঘাটে চেনা মানুষের ব্যবহার প্রতিনিয়ত মানুষ দুটো কে কুরে কুরে খাচ্ছিল তবে বেশিদিন সহ্য করতে পারেননি ওনারা। এক মাসের মধ্যেই মাত্র দু’দিনের ব্যবধানে ওনারা চলে যান ‘না ফেরার দেশে’।
মা বাবা চলে যাওয়ার পর আরও অশান্তি বাড়তে থাকে।
কোন কোন দিন রাতে বাড়ি ফেরে না সুচেতনা।
কোন কোনদিন মাঝরাতে আকণ্ঠ পান করে ফেরে বাড়ি।
অনীক মানতে পারছিল না তবুও চেষ্টা করছিল, বোঝাতে চাইছিল সুচেতনাকে।
কিন্তু সে তখন টাকার নেশায় বুঁদ।
একদিন নিজেই বলে অনী আমার মনে হয় আমাদের আলাদা থাকাই ভালো তাতে তোমার শান্তি আর আমার মুক্তি।
আজ ফাইনালি ডিভোর্স হয়ে গেল।
বাচ্চা দুটিকে কাস্টডিতে নিয়েছে সুচেতনা।
অনি জানেনা তাকে বাবা বলে ডাকা বাচ্চা দুটোর সত্যিই সে বাবা কিনা!
পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে একদম অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল অনীক হঠাৎ কাঁধে একটা আলতো স্পর্শ তাকিয়ে দেখে ‘ শ্রী,’ এখন ওর একমাত্র বন্ধু, অনীকের যন্ত্রণার দিনেও সব সময় পাশে থেকেছে।
শ্রী বলে জানতাম তুই এখানেই থাকবি তাই সোজা চলে এলাম এখানে।
এবার ওঠ বাড়ি চল, কাল থেকে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে যে।
………. সমাপ্ত…………