বিমলবাবু
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়
বিমলবাবু রিটায়ার করার পর রোজ সকাল বিকেল নিয়ম করে হাঁটেন পার্কের ভিতরের রাস্তা ধরে। রিটায়ারমেন্টের পরেই ডাক্তারের পরামর্শে আর নিজে সুস্থ থাকার তাগিদে শরীরটা একটু সচল রাখার চেষ্টা। যদিও বাজার, দোকান, ব্যাঙ্ক ও নানা দরকারী কাজে তাকে বেরোতেই হয়। এমনিতে বাড়িতে থাকার অভ্যেস তেমন নেই। বেরোবার জন্য খালি উসখুস করেন। আর কি’বা করবেন… বাড়িতে থাকলেই ছোটখাটো ব্যাপারে খিটিমিটি লেগে যায় বউয়ের সাথে। বউয়ের এমনিতেই বাতের ব্যথা…মেজাজটা সপ্তমে চড়ে থাকে। তারমধ্যেই ঘরের সব কাজ করতেই হয়… যদিও বাসনমাজা, ঘরমোছার লোক আছে। রান্নাটা উনি নিজেই করতে পছন্দ করেন। তাছাড়াও সংসারের সাতসতেরো কাজতো আছেই।
বিমলবাবুর একমাত্র ছেলে চাকরী নিয়ে বাইরে থাকে… ওর সাথে বউ আর বাচ্চাও থাকে। বছরে ছুটিছাটায় আসে। বিমলবাবুর এক মেয়েও বিবাহিত… শ্বশুরবাড়ি দূরে। সেও খুব একটা আসতে পারেনা। অগত্যা কর্তা, গিন্নী বাড়িতে থাকেন। নাতি-নাতনীদের দেখতে ইচ্ছে করে। এখন ভিডিও কলিং-এ ভরসা। তাতে কি আর কাছে না থাকার কষ্ট কমে? খানিকটা একাকীত্ব আর মনখারাপেই কাটে ওনাদের। অসুখবিসুখ করলে তো আরো বিপদ! তাই খুব নিয়মেই থাকার চেষ্টা করেন ওনারা।
পার্কে একটু হেঁটে বেঞ্চে বসলেই দেখেন একটা ছোট্ট মেয়ে এসে দাঁড়ায়। খুব মিষ্টি মুখ মেয়েটার কিন্তু মুখটা বড় দুঃখী… গায়ের ফ্রকটাও মলিন। ওর হাতে দু’টো টাকা দেন…কখনো লজেন্স, বিস্কুটও কিনে দেন। ও না’কি পার্কের পাশের ঝুপড়িতেই থাকে। একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন “কি রে তুই লেখাপড়া করিস না?”
“করি তো… ওই এক দিদিমণি এসে আমাদের ফুটের বাচ্ছাদের পড়ায়… খেতে দেয় তো” বলে মেয়েটি। “একটা কবিতা শোনা তো” বলতেই মিষ্টি গলায় তিন চারটে ছড়া শোনায় মেয়েটি। অঙ্কের ছোট ছোট হিসেবও মুখে মুখে দিব্যি করে দেয়। ওকে দেখে বিমলবাবুর মনে হয় বেশ বুদ্ধিমতী… সুযোগ পেলে হয়তো বেশ ভালো হতো পড়াশুনোয়। মনটা খারাপ হয়ে যায় ভেবে।
“তোর নাম কি ” জিজ্ঞেস করলে মেয়েটি বলে “লক্ষ্মী”।
বিমলবাবু মনে মনে ভাবেন “ফুটপাতের লক্ষ্মী “… সত্যিই কি কষ্টের জীবন যেখানে স্বয়ং মা লক্ষ্মীও উঁকি দিতে আসেন না ওদের জীবনে।
একদিন ফুটপাত ধরে হেঁটে ফিরছিলেন হঠাৎ দেখে লক্ষ্মী ওর কচি গলায় ডাকছে “ও দাদু ও দাদু” বলে। ভারী ভালো লাগে বিমলবাবুর। মেয়ের ঘরের নাতনীর মুখটা মনে পড়ে যায়। পাশে ওর মা দাঁড়িয়ে হেসে বিমলবাবুকে বললো “বাবু, আমার মেয়ে আপনার কথা খুব বলে, “ভালো দাদু” বলে ডাকে।”
“তুমি কি কাজ করো” জিজ্ঞেস করলে মেয়েটির মা জানায় –ও লোকের বাড়ি কাজ করে… লক্ষ্মীর বাবা নেই…ওর মাকেই রোজগার করতে হয়। তারপর দিনকাল ভালো নয়… মেয়েকে নিয়ে ফুটে থাকতে ভয় লাগে… কিন্তু কিই’বা করবে!”
বর্ষাকালে বিমলবাবু হাঁটতে যাননি বেশ কিছুদিন। বর্ষায় ঘরে বসে থাকতে অসহ্য লাগে… তাও উপায় নেই। তবে ছোটবেলায় বৃষ্টি বেশ উপভোগ করতেন তিনি..কাদামেখে ফুটবল খেলা… তারপর পুকুরে চান করে কাদা তুলে তবে বাড়িতে ঢোকা। বাড়ি ফিরলে মা গরম চা আর মুড়ি, তেলেভাজা দিতেন। সেসময় বাড়ির চারপাশে গাছগাছালি ছিলো প্রচুর… বর্ষায় ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ডাক শোনা যেতো। পুকুর পারের কদম ফুলের গাছটা ফুলে ভরে যেত এইসময়।
আর এখন এই বর্ষাটা বড্ড বাজে লাগে ওনার। রাস্তাঘাট পিছল, একটু বেশী বৃষ্টি হলেই জল জমে যায়। তাও কেনাকাটা করতে বেরোতেই হয়৷ তেমনি সেদিন দোকানে টুকিটাকি কিনে ফিরছিলেন পার্কের পাশের ফুটপাত ধরে। ওদের ঘরে উঁকি দিয়ে লক্ষ্মী বলে ডাকতেই ওর মা বেরিয়ে এসে বললো- বাবু,লক্ষ্মীর খুব জ্বর এসেছে। ঘরেও সমানে জল পড়ছে। বৃষ্টির জল লেগেই বোধহয়… ফুটিফাটা প্লাস্টিক চাপা দেওয়া ঝুপড়ি…চোখে জল এসে যায় বিমলবাবুর। বাচ্চাটা বড় মায়ায় জড়িয়েছে। উনি বলেন- ওকে নিয়ে আমার সাথে চলো…ডাক্তার দেখিয়ে তারপর আমার বাড়িতে থাকবে। যদি কিছু মনে না করো… আমার ওখানেই থাকতে পারো। তোমার মাসীমাকে একটু কাজে সাহায্য করবে। আর তোমার মেয়ের পড়াশুনোর দায়িত্ব আমি নেবো… ও খুব বুদ্ধিমতী।
ভেজা বর্ষায় ওদের আশ্রয় দিয়ে কোনো ভুল করেননি উনি। তাও ওর ছেলে -মেয়ে শুনে রেগে গেছে। বলেছে- রাস্তা থেকে যত উটকো লোক এনে ঘরে ঢোকাচ্ছো… এর ফল বুঝবে। এত বছর মানুষ দেখে অভিজ্ঞতায় মানুষ চিনতে ভুল হয়না বিমলবাবুর। ডাক্তারের ওষুধে দিব্যি ভালো হয়ে উঠলো লক্ষ্মী। একতলার সিঁড়ির নীচের ছোট্ট ঘরটাতেই মা-মেয়ে থাকে। মেয়েকে পাড়ার ইস্কুলে ভর্তি করে দিয়েছেন বিমলবাবুর। ওকে নিজেও পড়া দেখিয়ে দেন। বেশ সময় কাটে ওর সাথে লেখা -পড়া -গল্পে। কচি গলায় দাদু – ঠাম্মা ডাকে মুখর হয়ে ওঠে বাড়ীটা। বিমলবাবুর ঘরে লক্ষ্মী আলো করে থাকে। বিমলবাবুর প্রতিভাদেবীও খুব খুশী সর্বক্ষণের সাহায্যকারী লক্ষ্মীর মা মালতীকে পেয়ে।
বুড়োবয়সে ওদের ভরসা মালতী আর লক্ষ্মী। মালতীও খুব বুঝদার, চটপটে মেয়ে… সব কাজ পারে… খুব সুন্দর রান্নাও করে।এমনকরেই দু’টো পরিবার একে অপরের ভরসায় আনন্দে বাঁচে।।