বেলেল্লাপনা
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
সন্ধেবেলায় শাঁখটা বাজিয়ে সবে বসেছেন ঠাকুরের সামনে জপ করতে এমন সময় হাসির বিকট আওয়াজ শুনে চমকে উঠলো পুতুল কাকীমা।
পুতুল কাকীমার পাশেই বসেছিল কাকীমার ছোট বোন বুলবুল। সে তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, বাপ রে কোন মেয়েছেলে এমন করে হাসছে তোদের বাড়িতে। একে তিন সন্ধ্যা বেলা। এইমাত্র শঙ্খধ্বনি হলো। সেইসব কোনো কিছুর মানা মানি নেই। বলিহারি মেয়েছেলে সব।
পুতুল কাকীমা বোধহয় জপ করতে শুরু করে দিয়েছিলেন তাই তিনি হাত তুলে তার ছোট বোনকে তখনকার মতো চুপ করতে বললেন।
কিন্তু নিজে কিছুতেই জপ করতে পারছেন না একমনে। বারবার তার মনে আসছে চল্লিশ বছর আগেকার তার শাশুড়ির একখানা কথা, ‘তুমি তো আচ্ছা বেহায়া মেয়েছেলে। শ্বশুর, ভাসুর সকলের সামনে এমন হেসে উঠলে যে বাড়িখানা কেঁপে উঠলো!’
সবে মাত্র মাস চারেকের নতুন বৌ তখন পুতুল কাকীমা। বয়স হবে আঠারো প্লাস।কলেজে ওঠা মাত্রই মাস্টার পাত্র পেয়ে যেতেই কাকীমার বাবা বিয়েটা দিয়ে কন্যাদায় থেকে মুক্ত করে ছিলেন নিজেকে।
পুতুল কাকীমারা চার বোন। আর পুতুল কাকীমাই ছিল বড়। সুতরাং তার বিয়ের চিন্তাই ছিল সবচেয়ে বেশি তার পরিবারে।
পুতুল কাকীমা পড়াশোনা ও খেলাধূলাতে ছিল তুখোড়। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে লাল লাঠি কিংবা ঝুলন ঝাঁপ সবেতেই নাম্বার ওয়ান। স্কুলের বাৎসরিক ক্রীড়া অনুষ্ঠানে তার সাফল্যের হার থাকতো সবার থেকে বেশি।
কিশোরী বয়সে স্বপ্ন দেখতো তার বাবার মতো পুলিশ হবে সে। কিন্তু যৌবনের দোড়গোড়ায় পা রাখা মাত্রই তার ঠাকুমা ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন বড় নাতনিকে পরগ্ৰোত্র করার জন্য।
পুতুল কাকীমার বাবা তাই ইস্কুল মাস্টার জামাই পেয়ে একদম দেরি না করে মেয়ের বিয়েটা সেরে ফেলেছিলেন। চঞ্চল, চপলা, ডাকাবুকো মেয়েটা শ্বশুরবাড়িতে কিভাবে মানিয়ে নেবে এই চিন্তায় অস্থির হয়ে থাকতো শুধু পুতুল কাকীমার মা।
শ্বশুরবাড়িতে এসে দেওর, ননদের সাথে তার বেশ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই দিনটা ছিল দোল পূর্ণিমা। দুপুরে দেওর, ননদের সঙ্গে আবীর আর বাঁদর রং মেখে বেশ একটু আধটু হুল্লোড় করেছিল সে। কিন্তু সন্ধ্যা বেলায় চায়ের আসরে ঘটেছিল বিপত্তি।
পুতুল কাকীমার ছোট ননদ সুলতা চা খেতে খেতে বলে, ‘বৌদি মেজদা আর সেজদাকে কিন্তু রং মেখে পুরোই বাঁদর মনে হচ্ছিল। ওদের পিছনে খড় দিয়ে একটা লেজ করে দিলে ভালো লাগতো। মনে হতো ঠিক মুখ পোড়া বীর হনুমান।’
এই কথাটা শোনা মাত্রই পুতুল কাকীমা আর নিজের হাসি চেপে রাখতে না পেরে উচ্চস্বরে হো হো করে হেসে ওঠে। সুলতা যদিও পুতুল কাকীমার হাসি থামানোর জন্য নিজের চোখ টিপে ইশারা করতে থাকে। কিন্তু পুতুল কাকীমা কিছুতেই নিজের হাসি আর বন্ধ করতে পারছিল না।
আর যখন হাসি বন্ধ হলো তখন পুতুল কাকীমার দু’চোখ জলে ভরে উঠেছিল। দৌড়ে গিয়ে নিজের ঘরের দরজা দিয়েছিল। সেদিন তার অভিমান ভাঙাতে কেউ আসে নি। রাতে তার স্বামী অনুপ বাবু ঘরে এসে গম্ভীর স্বরে বলে ছিলেন,’স্থান, কাল, পাত্রের জ্ঞান তোমার কি একেবারেই নেই? বাবা, জেঠু, দাদাদের সামনে এমন বেলেল্লাপনা করার আগে একবার ভাবলে না তুমি!’
পুতুল কাকীমার চোখ কাঁদতে কাঁদতে ফুলে উঠেছিল। আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখ মুছে স্বামীর চোখে চোখ রেখে গর্জে উঠেছিল তরুনী পুতুল। ‘আমার হাসিটা তোমাদের কাছে বেলেল্লাপনা? তাহলে তো খুব মুশকিল তোমাদের এই বাড়িতে আমার থাকা। এটা তো একটা বাড়ি। এখানে মানুষ বাস করে।তারা আনন্দ করতে পারবে না, ফুর্তি করতে পারবে না এমনকি একটু প্রাণ খুলে হাসতে ও পারবে না? এই রকম বাড়িতে থাকার চেয়ে জেলের গরাদে থাকা অনেক ভালো।
অনুপ বাবু সেদিন পুতুল কাকীমার কষ্টটা সামান্য হলেও বুঝতে পেরেছিলেন তবুও স্বামী সুলভ আচরণ প্রকাশ করে বলেছিলেন, বিয়ের পর মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতে এসে কিছু বিধি নিষেধ মানতে হয়। না হলে লোকে তো খারাপ বলবে।
সেদিন রাতে অভুক্ত অবস্থাতেই শুয়ে পড়েছিল পুতুল কাকীমা। যদিও রাতে ছেলেদের খাওয়া দাওয়া শেষে শাশুড়ি এসে একবার ডাক দিয়ে গিয়েছিল খাওয়ার জন্য। কিন্তু পুতুল কাকীমা সেদিন না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল।
পরের দিন সকালে ভোর থাকতে উঠে বাসি কাপড় ছেড়ে গম্ভীর মুখে রান্নাঘরে ঢুকে ছিল। সুলতা ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই বৌদির সাথে কথা বলতে চাইলে পুতুল কাকীমা গম্ভীর স্বরে বলেছিল, সুলতা তুমি এই বাড়ির মেয়ে আর আমি এই বাড়ির বৌ।এটা কিন্তু ভুলে যেও না কখনও।
তারপর ধীরে ধীরে কখন যে সদা হাস্য, প্রাণোচ্ছ্বল মেয়েটা পাল বাড়ির রাশভারি ন বৌ হয়ে গেল তা কেউই লক্ষ্য করে নি।
মিনিট দশেক জপের আসনে বসে থাকার পর পুতুল কাকীমা হাত তুলে ঠাকুরকে নমস্কার পর্বটা শেষ করে বললেন, বুলবুল একবার ছেলে মেয়েগুলো আর অবশ্যই বৌমাকে ডেকে আনতো আমার কাছে।
বুলবুলকে আসতে দেখে পুতুল কাকীমার মেয়ে মৌলি শুচিস্মিতাকে বলে, বৌদি ছোটো মাসী আসছে আমাদের ঘরের দিকে। মনে হচ্ছে মা পাঠিয়েছে। একটু আগেই যা জোরে আমরা হাসির রোল তুলেছিলাম। নির্ঘাৎ মা রেগে গেছে।
শুচিস্মিতা আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করে, তোমাদের বাড়িতে জোরে হাসতে নেই বুঝি?
মৌলি কিছু উত্তর দিতে যাবে তখনি বুলবুল এসে বলে, তোদের সকলকে দিদি ডাকছে ঠাকুর ঘরে। তিন সন্ধ্যা বেলাতেও হাসি, মশকরা তোদের বন্ধ হয় না। আর মৌলি, শিউলি তোরা তো মেয়েছেলে। আজ না হয় কাল পরের ঘরের বউ হয়ে যাবি। তখনও কি এই রকম পাড়া মাতানো হাসি হাসবি? কি আওয়াজ রে বাবা! ঘরদোর একেবারে কেঁপে উঠলো।
বুলবুল মাসি চলে যাওয়ার পর ছেলেমেয়েগুলো সব কিছুক্ষণ চুপ রইলো। অর্ক একটু ধমকের সুরে শুচিস্মিতাকে বলে, তোমার এতো জোর হাসির জন্য আজ বোনেরাও বকা খাচ্ছে। সত্যি তো মেয়েদের গলার আওয়াজ, হাসির আওয়াজ এইগুলো একটু কম হওয়া উচিত।
শুচিস্মিতা অর্কের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলে, পাঁচ বছর ধরে যখন প্রেম করেছো তখন নিঃশ্চয় আমার হাসির আওয়াজ বহুবার শুনেছো। কই কখনও তো কানে লাগছে একথা বলো নি। আর আমি একদমই মুখ টিপে হাসতে পারি না। হাসতে যদি হয় প্রাণখুলেই হাসবো।
অর্ক একটু বিরক্ত হয়ে বলে, দেখো শুচিস্মিতা তুমি কিন্তু মায়ের সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে কোনো তর্ক করতে যাবে না। মা যেটা বলবে চুপচাপ শুনে নেবে। মেয়েদের হাঁটা, চলা, বলা এইসবের মধ্যে শালীনতা থাকা দরকার। শান্ত,ধীর স্থির মেয়ে না হলে পদে পদে বিপদ।
অর্কের কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে শুচিস্মিতা মৌলি, শিউলির সঙ্গে পুতুল কাকীমার ঠাকুর ঘরে ঢুকলো। মৌলি আর শিউলির মুখ শুকিয়ে চুন। শুচিস্মিতাও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ক, হর্ষ, নিপেন ওরাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে। যাকে বলে pin drop silence.
এই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ হলো পুতুল কাকীমার গলার আওয়াজে। পুতুল কাকীমা জিজ্ঞাসা করে ওদেরকে, কার হাসির আওয়াজ এতো বিকট ছিল?
শিউলি আমতা আমতা করে বলে, মাসিমনি আসলে নিপেন দাদার ফুটবল ম্যাচের মজার গল্প শুনে হাসি পেয়ে গিয়েছিল খুব জোরে। আর নতুন বৌদির গলার হাসির আওয়াজটা ছিল খুব তীব্র। ওটাই বোধহয় তোমার কানে লেগেছে।
শুচিস্মিতার দিকে তাকিয়ে পুতুল কাকীমা জিজ্ঞেস করে, তুমি খুব জোরে জোরে হাসতে ভালোবাসো?
শুচিস্মিতা কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
পুতুল কাকীমা গম্ভীর স্বরে বলে, তা বেশ। নিজেদের ঘরের মধ্যেই প্রাণখুলে হাসতে পারলে আর লাফিং ক্লাবে ছুটতে হবে না।
তারপর গলাটা একটু নরম করে বলে, কখনো মাথায় আনবে না তুমি এই বাড়ির বউ বলে তোমার জোরে হাসা হাসি করা চলবে না। শুধু এইটুকু খেয়াল রাখবে তোমার হাসির আওয়াজে কারোর অসুবিধা যেন না হয়।
ছেলেমেয়েরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে অনুপ বাবু ঘরে ঢুকে বলেন, আমি তো ভেবেছিলাম তুমি ওদেরকে খুব বকাবকি করবে। বিশেষ করে বৌমাকে।
পুতুল কাকীমা একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, বৌমা শ্বশুরবাড়িতে থাকতে এসেছে জেলখানায় নয়।
অনুপ বাবুরও মনে পড়ে যায় চল্লিশ বছর আগেকার দোল পূর্ণিমার ঘটনার কথা। আর মনে মনে এখন অনুতাপের আগুন পুড়তে থাকেন। কেন সেইদিন তিনি পুতুল কাকীমার পাশে দাঁড়ানোর সৎ সাহস দেখাতে পারেন নি।