Site icon আলাপী মন

অনুবাদ- ছায়া-ছবি

ছায়া-ছবি
( আদা নেগ্রি )
-বর্ণালী জানা সেন

 

 

 

সওদাগরি অফিসের সামান্য টাইপিস্ট সে। বয়স চল্লিশ ছুঁইছুঁই। তার মতো খেটে খাওয়া মেয়েরা যেমন হয় তেমনটা চালাকচতুর সে নয়। একটু কুঁজো হয়ে সে হাঁটে। পোশাক আশাকেরও কোনো চাকচিক্য নেই। সেই একঘেঁয়ে ছাইরঙা নয়তো গাঢ় বাদামি রঙের জামা। মাথায় ফেল্টের টুপি। টুপিটাকে টেনে টেনে সে মুখের ওপর নিয়ে আসে বার বার। তার চোখ, পাতলা আঁখিপল্লব একেবারে ঢেকে যায় টুপির আড়ালে। আর সব মহিলার মতো সেও চুলটাকে বব করে একটু কেতাদুরস্ত হতে চায়। কিন্তু চুলের এই ফ্যাশন তাকে মানায় না। পাতলা কয়েক গাছি চুল মাথাতেই লেপটে থাকে। আবার চুলটা বিনুনি করে একটা খোঁপা বাঁধতে চাইলেও আরেক বিপত্তি। হেয়ারপিন দিয়ে আটকানো যায় না তার পাতলা চুল। তার আলতো খোঁপা ঘাড়ের ওপর এলিয়ে পড়ে না স্বপ্নপরীদের মতো। এই চুল নিয়ে তার বড্ড অস্বস্তি। ছোটখাটো খোলামেলা পোশাকেও একেবারে মানায় না তাকে। বকের মতো ঢ্যাঙা পা দুটোকে তো ঢেকে রাখতে হবে। তার ওপর নাইলনের মোজা তার গোড়ালির ওপর উঠেই কেমন কুঁচকে যায়। উফফ অসহ্য! মোজা এমন হলে মেয়েদের সৌন্দর্যটাই নষ্ট হয়ে যায়। কেমন যেন ঘরকুনো গিন্নিবান্নি লাগে।
একা মানুষ সে। বাবা-মা সেই কবেই মরে ফৌত। তার শুকনো আপেলের মতো অসংখ্য ভাঁজ পড়া রক্তশূন্য ফ্যাকাশে মুখের দিকে কোনো পুরুষ চেয়েও দেখেনি। বলিরেখাময় মুখের দিকে মাঝে মাঝে চেয়ে মনে হয় বুঝিবা জন্ম থেকেই সে বুঝি এমন পারা…এমন বুড়োটে। অফিসটাও তার তেমনি। ঢুকলেই মন খারাপ করে আসে। শহরের একেবারে মাঝখানে ঘুপচি অফিসে জানালা দিয়ে আলোও ঢোকে না ভালো করে। জানালা দিয়ে শুধু দেখা যায় ঘিঞ্জি গলি। দিনের বেলাতেও অফিসে জ্বলে বিজলি বাতি। অফিসজুড়ে শুধু নতুন, পুরোনো কাগজ…কপি করার কালির গন্ধ…টাইপরাইটারের ঘটাং ঘটাং…আর ভাগ্যের জাঁতাকলে পড়া কিছু অসহায় মানুষ। মাসের সাতাশ তারিখ বেতনের দিকে তাকিয়ে যাদের দিনগত পাপক্ষয়। তাছাড়া এই ছোট অফিসে লোকই বা আর কত? যারা আছে তাদের আবার নজর ওই ঢলঢলে মেয়েটার দিকে। সেও টাইপিস্ট। কচি মুখ। তারও চুল বব করা। তবে তার লিপস্টিক ভেজা ঠোঁট আর চোখের গাঢ় মাস্কারাতেই যেন আটকে রয়েছে তার বয়স। জামা কাপড় দেখলে মনে হয় অফিস তো নয় যেন সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে এসেছেন তিনি। কোনো জামাই তার হাঁটু অবধি পৌঁছয় না। জামাগুলো তার এমন ভাবে তার শরীরে লেপ্টে থাকে যে খালি চোখেই শরীরের সব উঁচু, নীচু…কোমরের বিপজ্জনক সব ভাঁজ ঠাওর করা যায়।
আমাদের এই কেরানি শুকনো আপেলের মতো মুখ নিয়ে বৃহস্পতি কি শনিবার বিকেলে যায় সিনেমা দেখতে। কখনো সখনো রবিবারও। আর সপ্তাহের বাকি দিনগুলো শুধু ভাবে…সিনেমার নানান দৃশ্যের কথা। আর পরের সিনেমাটা কবে দেখা হবে তারই অধীর আগ্রহে বসে থাকে সে।
সিনেমায় সে একাই যায়। কোনো বান্ধবী জোটেনা । আসলে তার কোনো বন্ধুই নেই এ পৃথিবীতে। সে অবশ্য কারো সঙ্গে বন্ধুত্ত্বও করতেও যায়নি। শুধু আজ বলে আজ নয় সেই স্কুলের দিনগুলোতে যখন যে এই এতটুকুনি তখন থেকেই সে একা…নির্বান্ধব। এমনিতেই সে একটু মুখচোরা…লাজুক। আর একটু হীনমন্যতাও আছে ভেতরে। লোকের সঙ্গে সে মিশতে পারেনা। সে এমনই…জন্ম থেকেই। নিজের কথা কিছুতেই মুখ ফুটে বলতে পারে না । কাউকে বিশ্বাস করে উঠতে পারে না। কারো কাছে কিছু চাইতে পারে না নিজের জন্য। এ সংসারে কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের দেখলেই লোকের বিরক্তি আসে। আবার কিছু লোক আছে যাদের চারপাশে সারাক্ষণ মাছির মতো ভনভন করে গুণমুগ্ধের দল। অনেকে আবার আছে যারা কোনো দলেই পড়ে না। পৃথিবীতে তারাই দুঃখ পায় সবচেয়ে বেশি। জীবনে তারা একাই থেকে যায়। নিজের নামটা শুনলেও বিরক্তি লাগে তার। কী একখানা নাম! বিজিয়া। আসলে লুইজিয়া। লোম্বার্ডির কথ্য ভাষায় অপভ্রংশ হতে হয়ে দাঁড়িয়েছে বিজিয়া। এই নামটা শুনলেই যেন চোখের সামনে ভেসে আসে ঘন কুয়াশা…গোধূলির মরা আলো…আর ঝম ঝম বৃষ্টি।
বেছে বেছে সবচেয়ে ভালো সিনেমা হলেই সে যায় যেখানে দেখানো হয় দুর্দান্ত সব ছবি। এই করে মাসমাইনের অর্ধেকটাও খসে যায়। তাতে কী! এমন মানস ভ্রমণের সুযোগ আর কোথায়ই বা পাবে সে! ছায়া ও ছবির এই দুনিয়ায় ভেসে ভেসে সারা দুনিয়ায় ঘুরে বেড়ায় সে। এই ভ্রমণে তার সবসময় ফার্স্ট ক্লাসের টিকিটই চাই… ফার্স্ট ক্লাসের সব আরাম…সব বিলাসিতা চাই। সিনেমা হলেই ঢুকতে না ঢুকতেই শুরু হয়ে যায় তার যাত্রা। গেটে পা দিয়েই নিজের কল্পনায় বুঁদ হয়ে যায় সে। তারপর সে আসে লবিতে…হলের প্রশস্ত লবিতে সব মোটা মোটা সব থাম…সেখানে সব চোখ-ঝলসানো ঝাড়বাতি…কত সুন্দর সুন্দর সব মূর্তি! দেওয়ালে রঙিন জ্বলজ্বলে সিনেমার পোস্টার। সেখানে বড় বড় করে লেখা সিনেমার নাম…নীচে চটুল রগরগে সব ছবি। সে যখন হলে ঢোকে ততক্ষণে সিনেমা শুরু হয়ে গেছে। পিচ কালো অন্ধকারে মনে হয় সব আসনই যেন খালি…নিশ্চয়ই কোনো এক চমক লুকিয়ে রয়েছে তার জন্য…বুক ঢিপ ঢিপ করে তার। অন্ধকারে নিজের সিটে বসে নিজের অজান্তেই ছোঁয়া লেগে যায় পাশে বসা মানুষটার গায়ে। প্রতিবারই শিহরণ খেলে যায় তার শরীর জুড়ে। সে নিজেও জানে না পাশের মানুষটা পুরুষ না নারী। তবে যাই হোক না কেন রক্তমাংসের মানুষ তো বটে। পাশে বসা মানুষটার নিঃশ্বাস প্রশ্বাস সে অনুভব করে। মানুষটার মুখ সে দেখতে পায় না। আর তার মুখও দেখতে পায় না কেউ। এ নিয়ে অবশ্য তার কোনো অপরাধবোধ নেই। বিরতির সময় হঠাৎ করে আলো জ্বলে উঠলে সে দেখতে পায় পাশে বসা মানুষটার মুখ। সে মানুষ কখনো পুরুষ কখনো বা নারী। কিন্তু একবার আলো জ্বলে উঠলে মানুষটাকে নিয়ে তার আর কোনো আগ্রহ থাকে না। কারো দিকে চেয়ে থাকলে সে মানুষটাও তো তাকে নজর করে দেখবে। আর এটাই সে চায় না। নিজেকে সে জানে। সে যে বড়ই সাদামাটা…আলুথালু। আহা এমনটা যদি হত…এমনটা যদি হত যে কেউ কারো মুখ না দেখেই সারা জীবন এমন করেই একে ওপরের গা ঘেঁসে জীবন কাটিয়ে দেওয়া যেত!
সিনেমার মধ্যে চড়া দাগের রোম্যান্সই তার পছন্দ যেখানে অবাস্তব সব ঘটনা ঘুরে ফিরে আসে…প্রেমে উথালপাথাল হয় মানুষ। এই কল্পনার আশ্রয় তার যে বড় দরকার। নাহলে এই দমবন্ধ করা নিঃসঙ্গ জীবন থেকে মুক্তি পাবে কী করে! তার যদি অনেক পড়াশোনা আর টাকাপয়সা থাকত তাহলে সে তো পটের বিবি সেজে নাটকে…থিয়েটারে যেতে পারত। তবে নাটক বা অপেরার মাপা হাসি মাপা কথা তার ভালোলাগে না একেবারেই। তার মতো মোটা দাগের রুচির মানুষের ওসব পোষায় না। তার চাই রুপোলি পর্দার রগরগে আমোদ…একবারে এলোমেলো, পাগল করে দেওয়া বিষাক্ত আনন্দ। একেবারে প্রথম দৃশ্য থেকে সে পর্দার মানুষগুলোর সঙ্গে একেবারে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। পর্দার নায়িকার সঙ্গে নিজেকে এক করে ফেলে। নায়িকার সঙ্গে সঙ্গে সেও হাসে, কাঁদে, ভালোবাসে…ঘৃণা করে…কষ্ট দেয়…কষ্ট পায়…প্রেমের জন্য জীবন বাজি রেখে বসে…তারপর শেষপর্যন্ত সে জিতে যায়। সিনেমা হলের ওই দু-তিন ঘণ্টার মধ্যে কখনো সে মারী পিকফোর্ডের মতো মিষ্টি…সুন্দরী, আবার কখনো মে মুরের মতো… একরাশ বাদামি চুল আর স্পষ্ট তেকোনা নাসারন্ধ্র নিয়ে লাস্যময়ী। সেই তো গ্রেটা গার্বো। পেলব বেতের মতো শরীর…জাদুমাখা নীল চোখে অনন্যা। কখনো সে পলা নেগ্রি…কখনো বা বেবে ড্যানিয়েলস। নায়িকাদের আসল জীবনের কথা সে ভাবে না। পর্দায় নায়িকারা যে চরিত্র ফুটিয়ে তোলেন তারই সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে ফেলে সে।
এই দু-তিন ঘণ্টা ধরে সে ভেসে বেড়ায় স্বপ্নের দেশে। সে দেশে সে কোনোদিন যায়নি আর যাবেও না। তবু দেখামাত্রই চিনে ফেলে। অদ্ভূত আরাম পায়। মনে হয় যেন কতজন্ম ধরে ওদেশেই রয়েছে সে। দামি দামি গাড়ি…কখনো উল্কার গতিতে ধেয়ে আসা ট্রেনে চড়ে ঘুরে বেড়ায় সে। প্লেনে করে আকাশে উড়ে যায়। ঝাঁ চকচকে…প্রাসাদের মতো হোটেলে থাকে সে…যেখানে শুধু রাজারানিদেরই মানায়। মহার্ঘ্য জিনিসপত্রে সাজানো বসার ঘরে কত রইস, খানদানি মানুষজনের সঙ্গে মোলাকাত করে। গয়নায় মোড়া থাকে তার সারা শরীর…ঠিক যেন কোনো দেবীপ্রতিমা। কখনো আবার সে সাহসী…টানটান। আমেরিকার পশ্চিমে প্রেইরি তৃণভূমিতে কোনো রংচটা, ভাঙাচোরা সরাইখানার মালকিন হয়ে বসে ভাগ্যের সন্ধানে…সোনার সন্ধানে আসা মানুষজন, জেলফেরত আসামী আরো কতশত লোককে অভ্যর্থনা জানায় সে। পরনে তার লো-কাট জামা, গলায় ডোরাকাটা স্কার্ফ, মাথায় বাহারি ফুল। এই দুনিয়ায় কত বিচিত্র ঘটনা ঘটে…মানুষের লোভ, ষড়যন্ত্র দেখে সে ভয়ে কেঁপে ওঠে, কষ্ট পায়। কতবার তার জীবন বিপন্ন হয়, কিন্তু ভাগ্যের জোরে বার বার বেঁচে যায় সে। সে বার বার জীবন খোয়াতে বসে…আবার বার বার ফিরেও আসে। যে মানুষ মানুষটাকে ভালোবাসে সে মোটেই ফেয়ারব্যাংকের মতো চাষাভুষো নয়। আবার ঘিওনেও মতো গুণ্ডাগিরি সে করে না। তার ভালোবাসার মানুষ ভদ্র, নম্র, পরিশিলীত। তার দাঁড়ি- গোঁফ পরিষ্কার করে কামানো। প্রাণখুলে সে হাসতে পারে। সে যাই করুক না কেন একটা মৃদু হাসি সবসময় লেগে থাকে তার ঠোঁটের কোণে। তাকে অবশ্য হতে হবে অ্যাংলো-আমেরিকান। মাঝেমাঝেই এই মানুষটার মধ্যে তার অফিসের বসের আবছা আদল খুঁজে পায় বিজিয়া। তার তরুণ, ঝকঝকে, স্মার্ট বস। দূর তা আবার হয় নাকি। অফিসে তার বসের টেবিল তার টাইপরাইটার টেবিলের মধ্যেকার কয়েক হাতের ব্যবধান বাস্তবে যেন শত সহস্র যোজন হয়ে দাঁড়ায়। এই দূরত্ব সে অতিক্রম করতে পারে না। করার সাধ্যি নেই তার। কিন্তু সিনেমার পর্দার মানুষটাকে সে ছুঁতে পারে…তার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস অনুভব করতে পারে। সে মানুষটার সঙ্গে পক্ষীরাজে সওয়ার হয়ে সে এই পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে চলে যেতে পারে। এক নিমেষে সে চলে যায় দূর সমুদ্রের তীরে…যেখানে সে যাওয়ার কথাও ভাবতে পারেনি কোনোদিন। সে যে সমুদ্রই দেখেনি কোনোদিন। যা দেখেছে তা ওই ছায়া আর ছবিতে। তাও সে সমুদ্রের গর্জন শুনতে পায়…সে কান পেতে শোনে পাড়ে ঢেউ ভাঙ্গার শব্দ…ছলাৎ ছল ছলাৎ ছল। সমুদ্রের লোনা স্বাদ সে অনুভব করে। উচ্ছল সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে নিজেকে বাঁধনহীন মুক্ত মানুষ বলে মনে হয়। তবে প্রবল গর্জনে একের পর এক ঢেউ আছড়ে পড়া দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে তার। সমুদ্র কি এমনই উত্তাল থাকে সবসময়। সে কি শান্ত হয়না কখনো? নাকি শান্ত হয়েও সে এমনই বাঁধভাঙ্গা দুরন্ত! পর্দার ওপারে সব ঘটনা এমন চোখের নিমেষে ঘটে যায় যে মাঝে মাঝে সে তাল রাখতে পারে না। পর্দার মানুষগুলো নানান অঙ্গভঙ্গি, তাদের আসা-যাওয়া, হাঁটা- চলা, হাসি-কান্না, আদর-ভালোবাসা…এমনকী তাদের কুকর্মগুলোও কেমন যেন চোখের পলক ফেলতেই সব ঘটে যায়। তারপর আসে ক্ল্যাইম্যাক্স। সিনেমা হলে যদি একটুও আলো থাকে তবে সে ব্যালকনির সিটের দিকে একবার চেয়ে দেখে। সে দেখে রুদ্ধশ্বাস মুখের সারি…দমবন্ধ করে বসে রয়েছে সব…বিস্ফারিত চোখ…উত্তেজনায় কুঁকড়ে যাওয়া মুখ। চোখের সামনে যদি একখানা আয়না থাকত তাহলে সে দেখতে এত তার চোখ মুখের দশাও ঠিক তেমনি।
ইসস জীবনটা যদি সত্যিই এই রুপোলি পর্দার মতো হত! চোখের সামনে দরজাগুলো কেমন আপনা থেকেই খুলে যেত! দরজার ঠিক ওপারেই রূপকথার রাজ্য। সেখানে পথ, ঘাট আলো হাওয়া সব স্বপ্নের মতো। সেখানে বিপদে পড়লে ঠিক কেউ না কেউ এসে উদ্ধার করে। সেখানে কোনো নিষেধের বেড়ি নেই। মনের সব ইচ্ছেরা ডানা মেলে ওড়ে সেখানে। মনের সব সাধ পূরণ হয়।
কিন্তু এসব কিছুই তো মিথ্যে। সব কল্পনা। কল্পনার এই জগতে ভেসে বেড়ানো কি মানুষের উচিত? বিজিয়ার মা যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে তো মেয়ের এই ব্যাপার স্যাপার শুনে তিনি রীতিমতো ভিরমি খেতেন। তিনি হয়তো বলেই বসতেন… ‘নিজের কী ছিরি একবার তাকিয়ে দেখেছিস?’ তবে এখনকার ছুঁড়িরা অবশ্য মায়ের কোথায় পাত্তা দেয় না। তাদের সাফ কথা… ‘নিজে রোজগার করছি…যা মন চাইবে তাই করব’। বিজিয়ার মা ইহজগতে আর নেই…সেটাই যা রক্ষে। শুধু মা কেন এই দুনিয়ায় কেউ নেই বিজিয়ার…কেউ কোনোদিন হবেও না। শরীরের মধ্যে শুধু ধিকিধিকি একটা আগুন জ্বলে যায়। সে অবশ্য নিজে এটা মানতে চায় না। বাইরে তার কোনো লক্ষণও দেখায় না। কিন্তু ছায়াছবির পর্দার কল্পনার ঘোরে মিশে তার এই বুকের আগুন একটু নেভে। তার মনের উত্তেজনা হাজার দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সে নিজে একটু শান্ত হয়। এখন একটা মহা সমস্যা হয়েছে তার। মাঝেমাঝেই তার এই দুটো সমান্তরাল জীবন একে অন্যের ঘাড়ে এসে পড়ছে। দুটো জীবনে আটকে পড়া তার দুটো সত্তা একে অপরের সঙ্গে লড়াই করে ছিন্নভিন্ন, রক্তাক্ত হচ্ছে। এখন সিনেমা হল থেকে বাড়ি ফিরে গনগনে তাতে পুড়ে যায় সমস্ত শরীর। নাড়ির গতি চঞ্চল হয়। চোখে ঘুম আসে না তার। মনের বিকারে সিনেমায় দেখা দৃশ্য জীবন্ত হয়ে বার বার চোখের সামনে ফিরে ফিরে আসে। কল্পনায় সে নানা ছবি দেখে । বিছানায় ছটফট করতে করতে ভোরের দিকে চোখটা একটু লেগে আসে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নেরা মায়াজাল বোনে। ঘুঁটেকুড়ুনি থেকে সে হয়ে যায় কোনো ডাচেস বা বিশাল কোটিপতির কন্যা। ভালোবাসার মানুষের জন্য প্রাসাদের সব আরাম সব বিলাসিতা ছেড়ে সে বেরিয়ে আসে পথে। নয়তো বা সে হয়ে যায় সেই রোবট-নারী…যার ছলাকলার কাছে হার মানে রক্ত মাংসের মানবী। তার রূপের আগুণে পতঙ্গের মতো ঝাঁপ দেয় শত শত পুরুষ।
ঘুম থেকে আর উঠতে ইচ্ছে করে না। তার জিভ ভারী হয়ে আসে। সে কিছু মনে করতে পারে না। মাথার মধ্যে সব জট পাকিয়ে যায়। অফিসেও কোনো কাজে মন বসে না। সবসময় অন্যমনস্ক। টাইপরাইটারের সামনে বসে দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে। কাজে ভুল হয়ে যায় বিস্তর। যেখানকার সংখ্যা সেখানে বসে না। কলাম ঠিকঠাক থাকে না। নিজেকে সে একেবারে হারিয়ে ফেলে। অফিসের বস ভাবেন… ‘উনি বোধহয় অসুস্থ’। তাই আর তাকে ছাঁটাই করাও হয় না।
সেদিন শনিবার। রাত এগারোটা। হেলিও সিনেমা হল থেকে সবে ছবিটা দেখে বেরিয়েছে সে। চোখের সামনে সবকিছু কেমন ঘোলাটে। কানে একটা ভোঁ ভোঁ শব্দ। শুকনো আপেলের মতো মুখে হঠাৎ যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়। একটা নতুন ভাবনা এসেছে মনে। রাস্তার চৌমাথা উপচে পড়ে ভিড়ে। নাইটক্লাবগুলো থেকে পিল পিল করে মানুষ বেরিয়ে আসে। ভিড়ে একজনের গায়ে ঘাড়ে আরেকজন এসে পড়ে। গাড়ি বিকট হর্নে কানে তালা ধরে আসে। রাস্তার চারপাশে হোর্ডিং আর সাইনবোর্ড…সাদা, বেগুনি, ঘননীল। কোনোটায় ঝুলছে লম্বা ফিতে, আবার কোনোটায় ঝালর। গাড়ির হেডলাইটে ভিজে রাস্তা ঝকমকিয়ে ওঠে। মাথার ওপরে আলো, নীচে আলো। মাথাটা ঘুরিয়ে যায় তার। সে বুঝে উঠতে পারে না কোথায় রয়েছে সে। কে সে? নিজেই মনে করতে পারে না। নিজেকে সে ভুলে যায়। এই একটু আগে পর্দায় সে র‍্যোমান্টিক কাহিনিতে বুঁদ হয়েছিল কিছুতেই তার রেশ কাটে না। চোখের সামনে ভেসে একের পর ঘটনা। না, সে ওই সওদাগরি অফিসের সামান্য কেরানি বিজিয়া নয়। সে জিনার্ভা। সবে কুড়িতে পড়েছে। প্রেমে পাগল। প্রেমের জন্য সবকিছু করতে পারে সে। স…ব কিছু। সে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্যারিসের রাস্তায়। একটু পরেই তার প্রেমিক গাড়ি নিয়ে আসবে। তখন সে একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়বে গাড়ির সামনে। এ জীবন আর রাখবে না সে। প্রেমিক আর তাকে ভালোবাসে না, তাকে বিশ্বাস করে না। তার প্রেমিক! তার একজন প্রেমিক আছে ভেবেই যে কী রোমাঞ্চ, কী আনন্দ, মন জুড়ে কী উথালপাতাল কাকে বোঝাবে সে! ভালোবাসার জন্য কাঁদা, ভালোবাসার জন্য কষ্ট পাওয়ার যে কী সুখ!… ‘ এবার আমি তার জন্য জীবন দিয়ে দেব’ নিজের মনেই বলে সে। কিন্তু সে কি আর সত্যিকারের মরবে? কিছুতেই না। একেবারে শেষ মুহূর্তে ঠিক তার প্রেমিক তাকে বাঁচিয়ে দেবে…তাকে বুকে তুলে নেবে। সে আবার তার প্রেমিকের ভালোবাসা ফিরে পাবে। প্রেমিক আবার তাকে বিশ্বাস করবে। সিনেমার নায়িকারা আবার কখনো মরে নাকি? কক্ষনো নয়।
ওই পর্দায় যেমন হয় তেমনই চোখের সামনে নিমেষের মধ্যে ঘটে যায় সব ঘটনা। রাস্তায় ব্যস্তসমস্ত হয়ে সব লোক হেঁটে যায়। সবার ভীষণ তাড়া। কেউ তার দিকে ফিরেও তাকায় না। চারদিকে চোখ ধাঁধানো আলো। শোঁওও শোঁওও করে এক একটা গাড়ি ছুটে যায়। বিজিয়া-জিনার্ভা জানে সে সুন্দরী, তার আলাদা একটা আভিজাত্য রয়েছে। রাশিয়ান ফারের কোটের মধ্যে থাকা পোর্সিলিনের মূর্তিটার মতোই সুন্দর, পেলব সে। তার পায়ে নরম জালিকাটা মোজা। এই কাদাভেজা রাস্তায় তার দামি মুক্তোরঙা জুতোজোড়া বড় বেমানান। মাথায় তার টুপি নেই। একরাশ ঘন কোঁকড়ানো সোনালি চুল পিঠের ওপর লুটিয়ে পড়েছে। কোথা থেকে সে যে এমন সোনালি চুল পেল কেজানে! নিজেকে একবার আয়নার দেখতে খুব ইচ্ছে হয়। কিন্তু তারসঙ্গে তো কমপ্যাক্টের বক্স নেই। তাই আয়নাও নেই। রাস্তার দোকানগুলোও সব বন্ধ হয়ে গেছে। তাই কাচের জানলায় মুখটা দেখারও কোনো সুযোগও নেই।
একটা কথা সে জানে…সে সুন্দরী…তন্বী…লাস্যময়ী…সে অভিজাত। প্রেমে সে উন্মাদ। প্রেমের জন্য তার জীবন বাজি।
রাস্তার ওদিক থেকে তীব্র গতিতে ছুটে আসে গাড়ি। গাড়িটা ব্রেকও কষে। কিন্তু মরতে যে এত মরিয়া তাকে আর বাঁচাবে কে? চট করে কিছু বুঝে ওঠা যায় না। শুধু শোনা যায় তীব্র আর্তনাদ। পুলিশ ছুটে আসে। রাস্তা থেকে পাঁজাকোলা করে তাঁরা তুলে আনেন মহিলার দেহ। তার ছোট বাদামি জামাটা প্রায় কাঁধের ওপর উঠে গেছে। একেবারে আলুথালু অবস্থা। অনাবৃত দেহে স্পষ্ট দেখা যায় সব আঘাতের চিহ্ন। পা দুটো ভেঙে গেছে। যে গাড়ি তাকে ধাক্কা মেরেছে সেই গাড়িতে করেই তাকে হাসপাতালে আনা হয়। কৌতুহলী মানুষ সব ভিড় করে তাকে দেখতে। তারপর একসময় যে যার মতো চলে যায়। কেউ কেউ দীর্ঘশ্বাস ফেলে… ‘বেচারি’! কেউ আবার বলে ওঠে ‘উনি কে?’
কেউ নয়। সত্যিই কেউ নয়। সওদাগরি অফিসের সামান্য এক কেরানি। একা মানুষ। জীবনে একটাই নেশা ছিল তার…সিনেমা।

অনুবাদ—বর্ণালী জানা সেন
রচনা সম্পর্কে–
ইতালিতে মুসোলিনির ( ২৮ অক্টোবর ১৯২২- ২৫ জুলাই ১৯৪৩) শাসনকালের দমবন্ধ করা দিনগুলিতে প্রায় সকলের চোখের আড়ালে একটা বড়সড় বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন সেদেশের লেখিকারা। ফ্যাসিবাদী শাসকের চাপিয়ে দেওয়া কঠোর পুরুষতান্ত্রিক রীতি নীতির বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল তাঁদের কলম। তাঁরা নিজস্ব ভঙ্গিতে, নিজেদের মতো করে জানিয়েছিলেন তাঁদের চাওয়া-পাওয়া, প্রতিবাদের কথা। গত কুড়ি বা তিরিশের দশকে ইতালিতে যত লেখিকা পুরোভাগে এগিয়েছিলেন তেমনটা আর কখনো হয়নি। রচনার ধরন, বিষয়বস্তুর অভিনবত্বে পাঠকদের মন জয় করার পাশাপাশি সাহিত্য সমালোচকদের সমীহও আদায় করে নিয়েছিলেন তাঁরা। সে যুগেরই এক অন্যতম প্রতিনিধি আদা নেগ্রি। জন্ম ১৮৭০ এ। কবিতা লিখতে শুরু করেছিলন ১৮ বছর থেকেই। কবিতার পাশাপাশি উপন্যাস ও ছোটগল্প লিখে গেছেন সমানে। মূলত সমাজের যারা নীচু তলার মানুষ তাদের জীবন সংগ্রাম, আবেগ, অনূভূতি ফুটে উঠেছে তাঁর রচনায়। ফ্যাসিস্ত জমানায় ১৯২৬ থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে তিনি ছোটগল্প লিখেছেন প্রায় আশিটি। ১৯২১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর আত্মজীবনী Stella Mattutina ( Morning Star). তাঁর এই আত্মজীবনী ভীষণ ভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল। প্রকাশের সময় থেকে তাঁর আই বই বিক্রি হয়েছে প্রায় ৬০,০০০ কপি। তাছাড়া corriere Della Sera নামে যে সাহিত্য পত্রিকায় তাঁর বেশিরভাগ ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে তার পাঠক সংখ্যাও ছিল ৬ লক্ষের কাছাকাছি। তাঁর কাব্যগ্রন্থ Maternita (Motherhood) প্রকাশিত হয় ১৯০৪ সালে। তাঁর দুই কন্যার জন্ম ও তাদের বড় করার কাহিনি নিয়েই এই কাব্যগ্রন্থ। তাঁর ছোট মেয়েটি শৈশবেই মারা যায়। খেটে খাওয়া মেয়েদের হয়ে তিনি কলম ধরেছেন বার বার। তাদের জন্য লড়াইও করেছেন। সামাজের এই প্রান্তিক খেটেখাওয়া মেয়েদের কথাই তিনি লিখেছেন ‘Le Solitarie’ ( Solitary Women) গ্রন্থে। ১৯৩১ সালে অ্যাকাডেমি অফ ইতালি-র দেওয়া মুসোলিনি পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। পরে এই অ্যাকাডেমির সদস্য মনোনীত হন তিনি। তিনিই এই অ্যাকাডেমির প্রথম মহিলা সদস্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মিলানে ১৯৪৫ সালের ১১ জানুয়ারি তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
ছায়া-ছবি ( The Movies) গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় corriere Della Sera পত্রিকায়। প্রকাশকাল ১৯২৮ সালের ২৭ নভেম্বর।

Exit mobile version