বাঘের নাতি বাঘ
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়
বাঁদরিকে পেয়ারা গাছে বসে পেঁপে খেতে দেখে বাঘ বললে,
কী হলো ব্যাপারটা। পেয়ারা গাছে পেঁপে আসে কোত্থেকে?
বাঁদরি চিঁ চিঁ করে খানিকটা হেসে নিয়ে বললে,
তোমার মাথা আমার মুন্ডু। বুদ্ধু তো বুদ্ধুই রয়ে গেলে। আরে বাবা, পেঁপে গাছের পেঁপে পেয়ারা গাছে বসে খাচ্ছি। এটা শেষ করেই পেয়ারার দফারফা করবো কিনা তাই।
বাঘ বললে, আমাকেও খানকয়েক পাকা পাকা হলদে পেয়ারা দিস তো, খাবো।
বাঁদরির হাত ফসকে আর একটু হলেই আধ খাওয়া পেঁপেটা পড়ে যাচ্ছিলো। কোনরকমে সেটা সামলে নিয়ে বললে,
বলো কি! তুমি খাবে পেয়ারা? সব্বোনাশ করেছে।
-কেন সর্বনাশ কেন ?
– সব্বোনাশ নয় ; তুমি মাংস ছেড়ে ফলমূল খাওয়া ধরলে আমরা খাবো কী?
– না রে না। আমি মাংস খাওয়া ছাড়িনি।মাংস আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। বলেই ফোঁসফোঁস করে খানিকটা কেঁদে নিলে।
-বাঁদরি কিছু একটা সন্দেহ করে তাড়াতাড়ি লম্ফঝম্প মেরে গাছের আরও খানিক ওপরে চড়ে গিয়ে বললো,
দ্যাখো বাপু কেমন যেন গোলমেলে লাগছে। তুমি সত্যিই বাঘ তো নাকি ছিনাথ বহুরুপী? শুনতে পাই সে নাকি বাঘ সাজতে ভারী ওস্তাদ। বাড়িশুদ্ধু লোককে নাকানিচুবানি খাইয়ে ছেড়েছিল। ওদের বাড়ির ছেলে মেজদা । সে নিজেকে খুব মাতব্বর মনে করতো। সেও ও-ই বহুরুপীর সাজা বাঘকে সত্যি বাঘ ভেবে ভয়ে সে কী কান্ড!
`”আঁ আঁ করিয়া সেজ উল্টাইয়া চিৎ হইয়া পড়িলেন, আর খাড়া হইলেন না।” ঠাকুর্দার কাছে শুনেছিলাম।
বাঘ বললে,
হ্যাঁ রে ”সেজ” কী জিনিস ?
বাঁদরি পাঠশালার গুরুমশাই এর মতো সবজান্তা মার্কা মুখ করে বললে,
এ মা, তাও জানো না । সেজ মানে হলো পিদিম। ওতে তেল ঢেলে আলো জ্বালানো যায়।
বাঘ হালুম করে অকারণ একটা হাড় কাঁপানো ডাক ছেড়ে নিয়ে বললো,
না না। আমি সত্যিকার বাঘই বটে। চেয়ে দ্যাখ, এই আমার ল্যাজ। এক্কেবারে আস্ত। পাক্কা সাত হাত।
ছিনাথ বহুরুপীর খড়ের ল্যাজ তো মেসোমশাই কাটারি দিয়ে কাটিয়ে দিয়ে ছিল। মনে নেই ?
বাঁদরি গোলগোল চোখ বারকয়েক পিটপিট করে নিয়ে বললে,
মনে আছে, তবে মেসো নাকি পিসে ঠিক মনে নেই। তুমিও জানো দেখছি গপ্পোটা, যাকগে বাদ দাও সে কথা। এখন ঠিকঠাক বলো তো তোমার মতলব মানে, কি বলে, ব্যাপার খানা কী?
বাঘ সোজা হয়ে বসে, থাবা দিয়ে নাক চুলকে বললে,
ব্যাপারটা হলো, গরু মোষের মোটকা মোটকা হাড়গোড় চিবিয়ে চিবিয়ে দাঁতগুলোর সব বারোটা বেজে গেছে।
দু’চারটে খসে পড়েছে বাকিগুলো নড়বড় করছে। শুধু কি তাই, জ্বালা যন্ত্রণার ঠ্যালায় ভালো করে ঘুমোতেও পারছিনা। খিদে খুব। কিন্তু উপায় কী। দাঁত ছাড়া খাবো কীভাবে ? দুদিন জল খেয়ে কাটিয়েছি। কিন্তু আর যে পারিনে।
পাকা নরম পেয়ারা যদি কোঁৎ করে গিলে নেওয়া যায়, তাই বলছি,
বাঁদরি এবার সরসর করে বেশ খানিকটা নিচে নেমে এসে বললো,
কিন্তু আমি যেন কোথায় শুনেছিলাম, বাঘ না খেয়ে মরবে তবুও ঘাস খাবেনা…
বাঘ মাটিতে পা ঠুকে বললো,
আরে দূর, যত্তসব বাজে কথা। কেন খাবে না, ঠ্যাকায় পড়লে সব খাবে। ঘাস কি অখাদ্য নাকি কুখাদ্য? এই-যে আমি এদ্দিন ধরে যাদের খেয়েছি, খেয়ে বেঁচেছি, এতবড় বনবাদাড় সাফ করে ফেলেছি, তারা তো সব্বাই ঘাস পাতাই খেতো, তবে?
বাঁদরি সব শুনে বললে,
তবে আর কি; এইতো সমাধান হয়েই গেল। নাও, নিশ্চিন্ত মনে ঘাস পাতা খেতে শুরু করে দাও।
বাঘ বিরক্তি দেখিয়ে বললে,
বোকার মতো কথা বলছে দ্যাখো, আরে, ঘাস পাতা খেতে হলে তো চিবিয়ে খেতে হবে। চিবোতে গেলে দাঁতের দরকার। আমার সেখানেই যে অসুবিধে এই সামান্য কথাটা বুঝতে পারছিস না কেন?
বাঁদরি পটপট করে গোটাকয়েক ডাঁসা পেয়ারা ছিঁড়ে নিয়ে তাতে কচ কচ করে কামড় বসিয়ে বললে,
বলছি কি আর সাধে, বলছি তোমার ভালোর জন্যেই।
বাঘ কপাল কুঁচকে বললে,
কী রকম? ঠিক বুঝলাম না তো!
বাঁদরি আধ খাওয়া পেয়ারাটা দূরে ছুঁড়ে দিয়ে বললে,
তুমি তো হাড়গিলে পাখি নও, যে গলাটা আকাশের দিকে করে কোৎ করে গিলে নেবে। তোমার কি সেই অভ্যেস আছে? গিলতে গিয়ে পেয়ারা যদি গলায় আটকে যায়, তখন কী হবে? দম আটকে মরবে যে। বাঘ হতাশ গলায় বললে,
তাও তো বটে। জীবনের ঝুঁকি রয়েই যাচ্ছে। কী উপায় বলতো?
-উপায় একটা ছিল, কিন্তু, সে কিছুতেই রাজি হবেনা। উহুঁ, নাঃ।
বাঘ খানিক ভড়কে গিয়ে বললে,
কী সব বলছিস, কিছুই বুঝছিনা।
ঠিক তখনই বাঁদরির হাত ফসকে একটি বড় পেয়ারা ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল। বাঁদরি তাড়াতাড়ি গাছ থেকে মাটিতে নেমে সেটাকে কুড়িয়ে নিলে কিন্তু আর গাছে চড়ে বসলো না। মাটিতে বসেই ডাঁসা পেয়ারা খেতে খেতে বললো,
সে অনেকদিন আগের কথা। ঠাকুর্দা কিংবা ঠাকুমা, কার কাছে যেন শুনেছিলাম,
তোমাদেরই বংশের কে যেন, একবার মাংসের হাড় গলায় ফুটে মরতে বসে ছিল। সারসকে বলেছিল তার লম্বা গলা বাঘের মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে হাড়খানা বের দিতে। কিন্তু সারসের সাহস হয়নি বাঘের মুখের ভেতর গলা ঢোকাতে। ক্যাঁক করে কামড় দিলেই তো সব ফর্সা।
বাঘ তাকে অভয় দিয়ে বলেছিল, সে এমন বেইমানি কখনোই করবেনা।
বাঘ এতটুকু শুনেই বললো,
হ্যাঁ রে বাবা জানি। আমার দাদু বাঘটা মোটেই ভালো ছিলো না। উপকারীর মর্যাদা দিতে জানতো না। নইলে এমন বেইমানি কেউ করে। ছি ছি। দাদুটা আমাদের বংশের কুলাঙ্গার। উপকারী সারসের গলা চিবিয়ে, চিরকালের জন্যে আমাদের নাম খারাপ করে দিয়ে গেছে। বড্ড বাজে ব্যাপার। ঠিকই বলেছিস, সেই থেকে কেউ আমাদের বিশ্বাস করে না।
কথা বলতে বলতে বাঘ একেবারে বাঁদরির নাগালের মধ্যে এসে গিয়েছে।
জিভের গড়িয়ে আসা জল, সুরুৎ একবার টানাও হয়ে গেছে।
থাবা বাড়ালেই বাঁদরি যাবে বাঘের পেটে।
ঠিক তখনই বাঘের মাথায় কে যেন খুব জোরে আঘাত করলো।
বাঘ, বাবা গো বলে রক্তারক্তি হয়ে ছিটকে পড়লো। আর সেই ফাঁকে সারস সাঁইসাঁই করে উড়ে গাছের মগডালে বসে চিৎকার করে বাঁদরিকে বললো,
ওহে বোকা বাঁদরি, এখনো ওখানে বসে আছো কোন আক্কেলে? গাছে ওঠো শিগগিরই , নইলে মরবে।
আচমকা ঘটনায় বাঁদরির সত্যিই আক্কেলগুড়ুম হয়েছিল। সারসের কথায় হুঁশ ফিরলো। তাড়াতাড়ি লম্ফঝম্প মেরে গাছের মগডালে সেও চড়ে বসলো।
সারস বললো,
এবার শয়তানের নাতি বুঝুক, সারসের নাতির লম্বা ঠোঁটের জোর কতো । হেঁ হেঁ হেঁ,
কথাগুলো বলেই সে যেমন আচমকা এসেছিল, তেমনই আবার সাঁইসাঁই করে উড়ে কোথায় চলে গেল, তার হদিশ কেবল সেইই দিতে পারবে।
ঘটনার আকষ্মিকতায় বাঁদরির চোখ দুটো ততক্ষণে বড়ো বড়ো পেয়ারার চেহারাকেও হার মানাচ্ছে।