উপকারের পথ
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
কি ব্যাপার কুহেলি তোকে কি আজকাল রেশনের লাইনেও দাঁড়াতে হচ্ছে? আমি যতদূর জানি তোর বর তো সেন্ট্রাল গভর্মেন্টে চাকরি করে। অফিসারও তো শুনেছিলাম। তবুও তুই রেশন দোকানের লাইনে দাঁড়িয়ে চাল, গম তুলছিস।
কুহেলি শিল্পাকে কিছু বলতে যাবে তখনি পাশ থেকে ওদের পাড়ার শিবুদা বলে, বুঝলি তো শিল্পা কুহেলিদের বাড়বাড়ন্তের কারণটা।
শিবুদার কথা শুনে শিল্পা খানিক উচ্চ হাসির রোল তুললো। তারপর বলে, কুহেলি রেশনের চালের ভাত খেতে পারিস? যা মোটা চাল। আমি তো বাবা সরু, লম্বা চাল ছাড়া খেতে পারি না। হয়তো তোদের মতো এতো বড়লোক নই তবুও বাবা ভাতের চাল, রুটির আটা এগুলোর কোয়ালিটির দিকে নজর রাখি। আমার কর্তা তো বলে, দুটো ভালো খাবো বলেই তো এত মেহনত করছি। আমাদেরও রেশন কার্ড আছে। কিন্তু আমরা চাল, গম তুলতে আসি না। কেরোসিন তেলটা মাঝে মধ্যেই তুলে নিয়ে যায় কর্তা।আমি বাবা রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে ভিড় ঠেলাঠেলি করতে পারি না।
শিবুদা বলে, কুহেলি তুই না তোর বাবার ধারা পেয়েছিস একদম। দুটো পয়সায় জন্য মরে বাঁচে। কারোর ধার বাকি থাকলে তার বাড়িতে চলে যায় তাগাদা করতে।
কুহেলি বলে, পয়সা কার দরকার নেই বলো তো?
তাছাড়া কেউ যদি ধারে জিনিস খায় আর সময় মতো পয়সা না দেয় তাহলে তো তার কাছে তাগাদা করতে যেতেই হবে।
তা শিবুদা তুমিও কি রেশন তুলতে এসেছো? আমিও যতদূর জানি তোমাদেরও বাড়ির অবস্থা বেশ ভালো। তোমরা ভাইরা সবাই চাকরি করো।
শিবুদা একগাল হাসি দিয়ে বলে, সরকারি জিনিস কেন ছেড়ে দিই বলতো?
শিল্পা বলে, এটা তুমি ঠিক বলেছো। আমার উনিও তাই বলেন।
উনি তো আমাকে কতবার বলেছেন রেশনের চাল, গম তুলে বিক্রি করে দেওয়ার কথা।কত গরীব মানুষ আছে যাদের কাছে রেশন কার্ড নেই। তাদের কাছে দশ বারো টাকা কেজি দরে চাল, গম বিক্রি করলে তারা তো লাফিয়ে নিয়ে নেয়। সরকারি বিনা পয়সার জিনিস থেকেও দু’পয়সা হাতখরচা এসে যায়। তবে হ্যাঁ সময়টা বের করে লাইন দিয়ে দাঁড়াতে হবে এটাই ঝক্কি ঝামেলার।
শিল্পা, কুহেলি আর শিবুদার গল্পের মাঝে বিরতি টেনে দেয় কালী। কালীর পরিচয় ও কাজের মেয়ে। পাঁচ ঘরে ঠিকে ঘরদোর মোছার কাজ করে আর দুই ঘরে রান্নাও করে। সে দুটো বড় বড় ব্যাগ নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে এসে কুহেলির উদ্দেশ্যে বলে, দিদি এখনও তো অনেক লাইন আছে গো। আমার জন্য তোমার কাজের অনেক গোলমাল হয়ে গেল।
কুহেলি বলে, তা তো একটু হলো। তুই আমার পিছনে দাঁড়িয়ে পড়। অনেক ক্ষণ ধরে তোর লাইনটা রেখেছি।
শিল্পা বলে কি ব্যাপার বল তো কুহেলি, তুইও কি কাজের মেয়েদের কে চাল, গম বিক্রি করতে শুরু করলি?
কুহেলি কিছু বলার আগেই কালী বলে, তুমি তো কুহেলি দিদির বন্ধু। তবুও দিদিকে চিনতে পারোনি। দিদি অন্যের উপকার করতে পারলে আর কিছু চায় না। আমি যখন থেকে দিদির বাড়িতে কাজ করছি দিদি তখন থেকেই রেশনের চাল আর গম তুলে আমাকে ফ্রী-তে দিয়ে দেয়। এতে আমারও অনেকখানি উপকার হয়। মাসের আটা তো কিনতে হয় না বরং রেশনের চালগুলো আমিও মাঝে মধ্যে অন্যকে বিক্রি করে দিই।তাতে আমারও দু’ পয়সা আসে।
শিল্পা অবাক হয়ে শুনছিল কালীর কথাগুলো। কুহেলি ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বলে, সরকারের বরাদ্দ চাল, গম যদি আমাদের মতো সঙ্গতি সম্পন্ন লোকেরা না তুলি সেই ক্ষেত্রে লাভবান হয় রেশনের ডিলার। ডিলারকে লাভের ভাগ না দিয়ে যদি গরীব মানুষগুলোকে একটু লাভবান করি তাহলে কিন্তু মন্দ হয় না।
শিল্পা বলে, এটা তো কখনও ভাবি নি। সত্যি তো আমাদের রেশনের চাল, গম দরকার পড়ে না। কিন্তু আমার ভাগের চাল, গম ঠিক সরকার পাঠাচ্ছে। আমি যদি একটু কষ্ট করে তুলতে না যাই তাহলে আমার ভাগ তো রেশন ডিলারের কাছেই রয়ে যাচ্ছে। তার থেকে অনেক ভালো আমার ভাগের চাল গম তুলে গরীব মানুষদের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া। এমনিতে তো তেমন ভাবে গরীব মানুষগুলোর জন্য কিছুই করে উঠতে পারি না। শুধু একটু সময় ব্যয় করে রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে যদি ওদের উপকার হয় তা কিন্তু মন্দ হয় না।
সত্যি বলছি কুহেলি তোর মতো আমিও এবার থেকে রেশনের চাল-গম তুলে আমাদের কাজের মেয়েটাকে দিয়ে দেবো।
কালী বলে, তোমাদের দুজনের মতো সবাই যদি ভাবতো তাহলে আমাদের মতো খেটে খাওয়া মানুষগুলোর অনেক সুরাহা হতো।