দ্রব্যগুণ !
-সঞ্জিত মন্ডল
ইউনিক পার্কের যেখানে শেষ, তার উত্তর পশ্চিম কোনে শ্রীমাপল্লীর শুরু। ইউনিক পার্ক কোনো পার্ক নয়, এক বর্ধিষ্ণু অভিজাত পাড়া, অনেক গণ্য মান্য বরেণ্য ব্যক্তির আবাসস্থল। সেই তুলনায় শ্রীমা পল্লী নিতান্তই অর্বাচীন-ধানক্ষেতের মধ্যে গজিয়ে ওঠা এক নতুন পাড়া।
তা খেলার মাঠ বলতে, লাইব্রেরী, ক্লাব, ব্যায়ামাগার, ভালো স্কুল বলতে সবই ওই ইউনিকপার্ক।
কালীপূজো, দুর্গাপূজো সেও ওই ইউনিক পার্কে। পাড়াটা সত্যিই ইউনিক, তা সেখানে পার্ক থাকুক আর না থাকুক। আসলে ইউনিক ইন্সুরেন্স কোম্পানীর জায়গায় তৈরী বলেই ওই নাম।
ওদের আড্ডাটাও ওই পাড়াতে। ওরা মানে-ওই পথিক, শ্যামল, বিমল, কমল, জীবন, রতন, তারণ, রাসু, পাপুন, অরুণ, বরুণ, অমিত, সঞ্জিত, সুব্রত আর খোকন।
ওরা সবাই খুব বন্ধু। একেবারে প্রাণের বন্ধু। সমব্যাথী, সহপাঠী, সহ খেলোয়াড়, সবকিছু। একপাড়ায় না থাকলেও একই স্কুলে পড়ে, একসাথে ফুটবল, ক্রিকেট, হুশহুশ, সিরগজি, হাডুডু, দাড়িয়াবান্দা, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদি খেলে, একসাথে ক্লাবঘরে ব্যায়াম করে, বসাক বাগানের পুকুরে সাঁতরায়, বেড়াতে যায়, দুর্গা-কালী-সরস্বতী পূজা করে, চাঁদা তোলে, একটা সিগারেট ভাগ করে খায়, আরো কত কি করে।
ওদের অনেকেই ইউনিক পার্কে থাকলেও বেশীর ভাগ আসে পাশের পাড়ার। ওদের সকলেরই স্কুল কলেজের গণ্ডী পেরোনোর পর, সেবারই প্রথম ওদের কাঁধে দুর্গাপুজোর ভার পড়েছে। বাড়ির অনুশাসন ডিঙিয়ে রাত পর্যন্ত বাড়ির বাইরে থাকার অনুমতি মিলেছে। এই প্রথম বারের স্বাধীনতা সেলিব্রেট করার জন্যে ওরা কিছু একটা করবে ঠিক করলো।
বিস্তর আলোচনা, মতানৈক্য, অভিমান ইত্যাদির পর ঠিক হল বড় পূজো যখন একটু সিদ্ধি খাওয়া যেতেই পারে। আমাদের ছোট বেলায় বিজয়াদশমীর দিনে অনেক বাড়িতেই ঘুগনি, মিষ্টি আর সিদ্ধির ব্যবস্থা থাকতো। আমরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে প্রণামের বিনিময়ে সেগুলো উদরস্থ করতাম।
ঠিক হলো, বিজয়ার সিদ্ধিটাকে একটু এগিয়ে এনে সপ্তমীর দিনে ব্যাপারটাকে পরখ করলে কেমন হয় দেখা যাক। যেহেতু সিদ্ধিটা নির্দোষ নেশা বড়রা জানতে পারলেও খুব বেশী বকাবকি করবে না।
বলা ভালো, আজ থেকে দশ-বিশ বছর আগেও মদের এমন মোচ্ছব ছিলনা। পাওয়া যেতনা এমন নয়, তবে তা শুধু দুর্লভ ছিলনা তাই নয়, অল্পবয়সী কারো হাতে বোতল যেমন অসম্ভব দৃশ্য ছিল, তেমনি, স্কুল -কলেজের পাশ করা ছেলেরাও বোতল কল্পনাই করতে পারতো না। আর গল্পটা যেহেতু পঞ্চাশ বছরের পুরানো ওরা সিদ্ধিতেই সন্তুষ্ট রইলো।
কিন্তু বানাবে কে? সিদ্ধি বানাবার কায়দা আছে। দুধ লাগবে, বাদামবাটা, ডাবের জল, চিনি মায় সিদ্ধিটাও তো কিনতে হবে। আর ওদের যা বয়েস, ওদের কেউ সিদ্ধি বিক্রী করবে না।
ঠিক হল পূজোর ঢাকিকে দিয়ে সিদ্ধি কেনানো যাবে। একজন বললো সে তার পিসিকে দিয়ে বাদাম বাটাতে পারবে। দুজন ডাবের জল আর দুধ যোগাড় করার দায়ীত্ব নিল। নাপিত বাগান থেকে ডাব আর গোয়ালা পাড়ার দুধ। সিদ্ধির ব্যবস্থা পাকা হলো।
বাড়ির বাইরে বেশী রাত পর্যন্ত থাকার স্বাধীনতা উদযাপন শুরু হল রাত বারটার পর। বড় বালতির এক বালতি সিদ্ধির সরবৎ গোলা হয়েছে। প্রথমে সবাই এক গ্লাস করে নিল। স্বাধীনতার জয়, দুগগো পূজোর জয়, জয় সিদ্ধির জয়। প্রথম গ্লাসটা কেউ ঢক ঢক করে, কেউ সুরুৎ সুরুৎ চুমুকে, কেউ রইয়ে সইয়ে চুমুক দিতে দিতে স্বাধীনতা উদযাপন করতে শুরু করলো।
কিন্তু কিছুক্ষণের মধেই অত বড় বালতির সরবত শেষ। প্রথম বার পেট ভরে খাওয়ার ফলে সকলেই ব্যোমভোলা ব্যোমকেশ।
কিন্তু কারো আবার নতুন চৈতন্যের উদয় হোল। লেট নাইট বাড়ির বাইরে মানে তো সারারাত বাড়ির বাইরে নয়। তাহলে? এদিকে সকলেরই মাথাটা টলমল করছে, শরীরটা দুলে ঊঠছে, পা দুটো কোনমতেই নিজের বশে নেই। ইচ্ছা না থাকলেও হাসি পাচ্ছে। আর একবার হাসলেই কেমন যেন ভুসভুসিয়েই হাসিটা পেটের ভেতর থেকে ঠেলে উঠে আসছে। সামলানো যাচ্ছে না। আর বাড়ি ফেরার রাস্তাটাও কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। কে যে কাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে সেই নিয়ে শুরু হল ঠেলাঠেলি।
শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো, জীবন যাবে পথিককে পথ দেখাতে শ্রীমা পল্লীতে।
শ্রীমাপল্লীতে যেতে গেলে বড় একটা কাঁচা জল নিকাশি নর্দমা ডিঙিয়ে পেরোতে হয়।ইউনিক পার্কের সীমানায় এল,আই,সি, র মাঠ, তারপরে সেই নর্দমা।
এল,আই,সি,র মাঠটা অন্ধকার। দু’ চারটে জোনাকি জ্বলছে। হালকা, পাতলা একটা কুয়াশার আবরণ মাঠটাকে রহস্যময় করে তুলেছে। জীবনের মাথাটা দুলেদুলে উঠছে। দুবার চোখ কচলে নিয়ে পথিককে ভালো করে ঠাহর করে দেখে বললো, কিরে, রাস্তাটা ঠিক আছে তো?
পথিক রসিকতা করে বলে, জীবন চলেছে পথিককে পথ দেখিয়ে, সে পথ কি ভুল হতে পারে? বললো বটে, কিন্তু নিজেই সন্দিহান হয়ে গুনগুনিয়ে উঠলো, “জীবনপুরের পথিকরে ভাই কোনো দেশেই সাকিন নাই ——–”
ওরা মাঠ পেরিয়ে সেই নর্দমার কাছে এল।
পথিকের হঠাৎ মনে হল, জীবন তাকে এ কোথায় নিয়ে এলো, এইতো সেই পদ্মানদী, কেমন কুলুকুলু শব্দ তুলে এপার ওপার বয়ে চলেছে। বাবার কাছে এ নদীর কত গল্প শুনেছে সে। এই কি সেই গোয়ালন্দের ঘাট!
সে জীবনের হাতটা ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে- জীবন, তুমি আমার বন্ধু হয়ে এতো বড় বিশ্বাসঘাতকতাটা করতে পারলে? জীবন জড়ানো গলায় বলে কি করলাম রে বাবা! পথিক বলে, যাব শ্রীমাপল্লীর ঘরে, আর তুমি নিয়ে এলে পদ্মার চরে! ভালো করে চোখ কচলে নিয়ে জীবন বলে, আরে কথায় কথায় কখন পদ্মাপারে চলে এসেছি, খেয়ালই করিনি। এই জন্যেই বলেছিলাম, বেশী নেশা করো না। পেয়েছো দুধ বাদামের সরবৎ, গিলেছ বেশ খানিকটা। এখন মনে হচ্ছে পথিক তুমি সত্যিই পথ হারাইয়াছ।
পথিক সত্যিই চিন্তিত হয়। তাই তো, রোজই কি তাহলে সে পদ্মা পেরিয়ে ইউনিক পার্কে আসে! এই দুকূল প্লাবিনী পদ্মা! এত রাতে পদ্মার ঘাটে না আছে স্টিমার-লঞ্চ,না আছে ভুটভুটি বা ডিঙি নৌকা। নিদেনপক্ষে পাল তোলা নৌকাটাতো থাকবে! শ্রীমা পল্লীর বাড়িতে কিভাবে পৌঁছাবে তার কূল কিনারা পায় না।
সেই রাতে দিগভ্রান্ত দুজন সেই নর্দমার পাশে দাঁড়িয়ে জীবনের বিচিত্র গতিপথে নদীর ভূমিকা, সভ্যতার বিকাশে পদ্মা-গঙ্গার অবশ্যম্ভাবিতা স্বাধীনতার সুদীর্ঘ ইতিহাসে গঙ্গা-পদ্মার অবদান ও ভূমিকা, সুরে, ছন্দে, গল্পে, উপন্যাসে বাংলা আর বাঙালীর আশা আকাঙ্ক্ষার তরঙ্গায়িত স্বপ্নের মেদুর কলনিনাদ এই দুই নদীর প্রবল ঘূর্ণিপাকে, প্রতিটি তরঙ্গ বিভঙ্গে গঙ্গা-পদ্মার বিমুর্ত বিভাস এমন অনায়াসে তাদের দুই পাড়ার মধ্যে কল্লোলিনী হবে এটা যেন তাদের স্বপ্নেরও অতীত।
কিন্তু এতো রাত হলেও পদ্মায় কিছুই চলবে না এটাও তাদের স্বপ্নের অতীত। এটা আগে বুঝতে পারলে ওরা মাঠের উন্মুক্ত পরিবেশে শিশির ভেজা ঘাসে ঘাসে নি:শব্দে পদচারণা করে আজ রাতটা কাটিয়েই দিত।
তুরীয়ানন্দ অবস্থাতেও পথিকের মাথায় বিবেকের বাড়ি লাগে। রাতে উন্মুক্ত প্রন্তরে শয্যা নিলে পরবর্তী কালে স্বাধীনতা অসংকুচিত হতে পারে। তাই যত রাতই হোক নৌকা বা লঞ্চ পাওয়া যাক বা না যাক, ঘরে ফেরাটাই সাব্যস্ত হলো।
দুজনে ঠিক করলো, কিছুই যখন পাওয়া যাচ্ছে না, জীবন এক ধাক্কা লাগাক পথিককে। তাতে,যতদূর পদ্মা পেরোনো যায় যাক। ওদের মাথায় হনুমান লম্ফঝম্ফ শুরু করলো। পথিক হনুমানের মতই লাফ মেরে পদ্মা পেরিয়ে যাবে। ঠিক হলো জীবনের ধাক্কা আর পথিকের লম্ফন দুয়ে মিলে পদ্মা পার। ওরা দুজন গলা জড়াজড়ি করে একপ্রস্থ কেঁদে নিলো। পথিক ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, শেষ পর্যন্ত তুমি আমাকে ধাক্কা মেরে পদ্মা পার করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবে? পথিক বলে, আমার আর ঘরে ফেরা হবে না। জীবন সিরিয়াস হয়, বলে, অন্য উপায় দেখছি না, ধাক্কা তোমায় মারতেই হবে। বলতে বলতেই সে মারে এক ধাক্কা আর পথিকও সময়মত লাফায় চোখ বন্ধ করে। কিছুপরে সে চোখ খুলে অবাক বিস্ময়ে বলে দেখ জীবন দ্রব্যগুণে একলাফে পদ্মা পার! সলিলসমাধি হয় নি আমার!!
পুনশ্চ।। সেই সেদিনের আমরা ষাটের সীমা পেরিয়েছি পাঁচ-সাত বছর আগেই, তবে আমাদের আত্মিক বন্ধন এখনও সেই আগের মতই অটুট আছে। সেই ঘটনার কথা আজও জাগরুক আছে আমাদের মনের মণিকোঠায়।
অতীতের স্মৃতি সুধায় নতুন করে অবগাহন করে রোমাঞ্চিত হলাম, আলাপী মন কে অন্তহীন শুভেচ্ছা জানাই