Site icon আলাপী মন

অনুবাদ- বর্ণালী জানা সেন

উল্কি (হোসে বালজা )
-বর্ণালী জানা সেন

একেবারে ঘড়ির কাঁটা ধরে হাজির সাংবাদিক মহাশয়। টম উলফের প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা। তাঁকে আদর্শ মেনেই লেখালেখি চালিয়ে যেতে চান এই তরুণ সাংবাদিক ( বছর তিরিশ বয়স আর ইতিমধ্যেই দুটো ডিভোর্স হয়ে গেছে)। খবরের কাগজের রিপোর্টে তিনি কাব্য আনতে চান, নাটক আনতে চান, উপন্যাসের জাদু চারিয়ে দিতে চান যাতে মহোদয়ের রিপোর্টে পাঠকরা একেবারে খাঁটি সাহিত্যকর্মের স্বাদ পেতে পারেন। আসলে তিনি গল্পই তো লিখতে চান। কিন্তু মনে সবসময় চোরা আশঙ্কা…সাংবাদিকদের সহজাত প্রবৃত্তি বশত গল্পটি শেষমেশ খবরের কাগজের রিপোর্ট হয়ে যাবে না তো? এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব মনে নিয়ে আর তাঁর আর সাহিত্যিক হয়ে ওঠা হল না…নামী এই খবরের কাগজের কলাম-লিখিয়ে হয়েই রয়ে গেলেন। এমনিতে একেবারে অমায়িক মানুষ। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে অগাধ জ্ঞান। তারপর চোখে মুখে একটা কবি কবি ভাব। নাহ, ইনি সাহিত্যিক হওয়ার জন্যই জন্মেছেন। কেউ আটকাতে পারবে না।
সকালে এই এক ঘণ্টা ধরে আমার ইন্টারভিউ নিয়ে চলেছেন…যদিও আমি বিশেষ কিছু বলার সুযোগ পাচ্ছি না। আমি আমার সহকর্মীদের নিয়ে একটা অভিধান সম্পাদনা করেছি। সেটা নিয়েই এই ইন্টারভিউ। একদম পাঠকের দৈনন্দিন চাহিদার কথা মাথায় রেখেই এই অভিধান। তাঁরা যা চান তা এখানে একেবারে হাতে কাছেই মজুত রয়েছে। তবে সম্পূর্ণ অভিধান বলে কোনো কথা হয় না। সেটা একেবারে সোনার পাথরবাটি। অভিধান তাই সবসময়ই অসম্পূর্ণ। তবে আমার দলের সঙ্গীসাথীরা কাজটা করে খুব খুশি। পাঁচ বছর ধরে এমন একটা মহান কাজে নেতৃত্ব দেওয়ার কৃতিত্বটা অগত্যা আমাকে নিতেই হল। সবাই যখন চাইছে! খবরের কাগজওলারা তো একেবারে হামলে পড়েছে। এই কাজের অভিনবত্ব নিয়ে ( যেখানে পুরো বর্ণানুক্রম হঠিয়ে দেওয়া হয়েছে) সাংবাদিক বন্ধুটি একেবারে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আমাদের জনসংযোগ বিভাগের পক্ষ থেকে এক হপ্তা আগেই বইয়ের একটা কমপ্লিমেন্টারি কপি ওঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু উনি যে তার একটা পাতাও উলটিয়ে দেখেননি তা আমি আর কী করে বুঝব! এমনভাবে প্রশ্নগুলো ছুঁড়ে দেন যে মনে হয় বুঝি সবজান্তা। হবে নাই বা কেন! লক্ষ লক্ষ পাঠককে সম্মোহিত করে রাখার কৌশলটা যে তাঁর নখদর্পণে।
কাচের পার্টিশনটার ওপার থেকে দলের লোকজনরা আমাদের কথাবার্থা শুনছে…থুড়ি দেখছে। সুযোগ বুঝে আমার সেক্রেটারি কফির ট্রে নিয়ে হাজির। ভদ্রলোক নিজের ক্যাসেট, নোটবইট ব্যাগে গুছিয়ে নিচ্ছেন। নোটবইটা যদিও একবারও খোলেননি। কিন্তু উনি আর্টিকেলটা ঠিক কীভাবে লিখবেন? দু-এক সেকেন্ডের জন্য আন্দাজ করার চেষ্টা করি। উনি সত্যিই অভিধানটার কথা লিখবেন তো? এখন হলুদ সাংবাদিকতার যা বাড়বাড়ন্ত! অভিধানকে বাদ দিয়ে হয়তো আমার হাঁচির ধাত নিয়েই দুটো প্যারা লিখে দিলেন! ধন্দ তো একটা রয়েই যায়। ভদ্রলোককে দেখে মনে হয় ওঁর কোনো তাড়া নেই…হাতে অনেক সময় ( আমার দলের লোকজনেরা তো সাংবাদিক দেখেই গদগদ। তারা ধরেই নিয়েছে পরের দিন কাগজের একেবারে প্রথম পাতায় বিরাট করে খবর ছাপা হবে। কিন্তু সে খবর বেরিয়েছে পাক্কা দেড় সপ্তাহ পরে। তাও একেবারে ভেতরের পাতায়…দু-চার লাইন। ইন্টারভিউ শুরুর আগে হাসিহাসি মুখ করে যে গ্রুপ ফটো তোলা হয়েছে তা ক্যামেরাবন্দী হয়েই রয়ে গেছে। ছাপা আর হয়নি)।
ভদ্রলোকের স্ত্রী ( বোধহয় তৃতীয় পক্ষ) নাকি আমাদের অভিধানের প্রথম খণ্ড নিয়ে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত। তারপরই ঝুলি থেকে বেড়ালটা বেরোলো। এতক্ষণ ধরে যে কথাটা বলার জন্য উশখুশ করছিলেন সেটা পেড়েই ফেললেন। সাংবাদিকের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল গল্প লিখিয়ে হতে চাওয়া এক মানুষ। উনি এখন প্রাণপনে চাইছেন ইন্টারভিউ-দাতা হয়ে উঠতে। আমি একের পর এক প্রশ্ন করে যাব। আর উনি তারিয়ে তারিয়ে জবাব দেবেন। আকারে ইঙ্গিতে যেটা বোঝাতে চেষ্টা করছেন সেটা হল উনি নাকি একটা নাটক লেখার কাজে হাত দিচ্ছেন ( এখন একটা কথা লোকে খুব খাচ্ছে… ঔপন্যাসিকেরা নাকি নাট্যকারদের চেয়েও অনেক ভালো নাটক লিখতে পারেন)। মোটামুটি প্লটটাও সাজিয়ে ফেলেছেন। একেবারে মারকাটারি প্লট। দুটো অংক থাকবে তাতে। সে দুটোতেই টানটান উত্তেজনা। প্লটে কিছুটা জল মেশাতে হতে পারে। নাটকের প্রধান চরিত্র হল উচ্ছৃংখল জীবনযাপনে অভ্যস্ত মদ আর ড্রাগে আসক্ত এক বিদেশি মহিলা। প্রথমে উনি বললেন গল্পটা নাকি ওঁর মাথা থেকেই বেরিয়েছে। তারপর দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরানোর পরই ( আরেকটু কফি পাওয়া যাবে?) একেবারে ডিগবাজি। প্লটটা নাকি তিনি পেয়েছেন প্লাজা সেন্ট্রালের এক বুটপালিশওলার-কাছ থেকে। লোকটার এখন অনেক বয়স। কিন্তু ১৯১০ সালেও নাকি সে নাকি ঠিক এখানেই কাজ করত। তখন তার কাঁচা বয়স। আর এই মানুষটার কাছ থেকে দুধর্ষ প্লটটা পেয়েছেন আমাদের সাংবাদিক বন্ধু। ঐ বুটপালিশ-ওলার ইন্টারভিউ নিতে গিয়েই ঘটনাক্রমে গল্পটা বেরিয়ে আসে।
তা আমাদের সংবাদিক মহাশয়টি বেশ করিৎকর্মা। নিশ্চয়ই সম্পাদককে পটিয়েপাটিয়ে সোজা প্লাজা সেন্ট্রালে চলে গেছে। ওখানেই তো যত কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীদের আড্ডা। ওখানে তাদের অনেক ঘরোয়া মেজাজে পাওয়া যায়। সেই আশাতেই বোধকরি সাংবাদিক বন্ধুটি ওখানে গিয়েছিলেন। কিন্তু কবি-সাহিত্যিকদের বদলে তিনি পেলেন ঐ বুটপালিশওলাকে। এক্কেবারে নাকের বদলে নরুণ। কিন্তু এতে তাঁর লাভ বই ক্ষতি হয়নি। নিজের জুতো পালিশ হয়ে যাওয়ার পরেই তিনি লোকটার সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা গল্প করেছেন। লোকটাকে মদের লোভও দেখিয়েছিলেন। কিন্তু সে বুড়ো তাতে রাজি হয়নি। কিন্তু সাঙ্ঘাতিক এক গল্প শুনিয়েছেন। গল্প নয়, একেবারে সত্যি ঘটনা। সেটা ঘটেছিল ১৯৩০-এর দশকে। গতকাল গল্পটা শোনার পর থেকেই সাংবাদিক মহাশয়ের মাথায় সেটা ঘুরঘুর করছে। কিছুতেই অন্যকাজে মন দিতে পারছেন না। গল্পটা শুনে ইস্তক সাংবাদিক বন্ধুটি দারুণ একটা গোয়েন্দা গল্প, নিদেনপক্ষে একটা নাটক লেখার প্ল্যান ভেঁজে চলেছেন।
ঘটনাটা নিয়ে সে সময় নাকি দারুণ একটা কেচ্ছা হয়েছিল। খবরের কাগজগুলোতে মুচমুচে…রসালো খবর বেরিয়েছিল। তা সেই বুটপালিশওলার নাকি ( ১৯১০ সালে যিনি নেহাতই বালক ছিলেন, আর এখন তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন) সে সময়কার সব কাগজের হেডলাইন মনে আছে। এই অবধি বলে সাংবাদিক বন্ধু আমার দিকে জুলজুল করে চেয়ে রইলেন। বুঝতে পারছি পেট ওঁর ফুলে যাচ্ছে। সবকথা উগরে দিতে না পারলে শান্তি নেই। কিন্তু আমি ঐ ফাঁদে পা বাড়াই না। দ্বিতীয় বার কফি আসে। তারিয়ে তারিয়ে কাপে চুমুক দিই। দেখি ভদ্রলোক কখন গাত্রোত্থান করেন। তা গল্পটা সত্যিই বুটপালিশওলার কাছ থেকে শোনা নাকি ওঁর নিজের কল্পনা তা অবশ্য হলপ করে বলতে পারি না। তবে আমি যেচে কোনও প্রশ্ন করব না। ওটা আগে গল্প বা নাটকের রূপ পাক তারপর দেখা যাবে (কাচের পার্টিশনের ওপারে আকুল চোখে তাকিয়ে থাকা সহকর্মীদের জন্য একটু কষ্টও হচ্ছিল। কত আশা নিয়ে ওরা বসে আছে। সাংবাদিক মহাশয়ের কত আগ্রহ তাদের অভিধান নিয়ে! কিন্তু সাংবাদিক বন্ধুটি যে আসলে নিজের তক্কেই আছে সে আর ওরা কী করে বুঝবে?) গল্পটা শুনতে গিয়েও মাঝে মাঝে আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে। একটা খুনের গল্পকে সুন্দরভাবে বুনতে গেলে যে মুন্সিয়ানার প্রয়োজন হয় সাংবাদিক বন্ধুটির তার ছিঁটেফোঁটাও নেই। শুধু অনাবশ্যকভাবে খুঁটিনাটি বর্ণনা। কল্পনার জাল বুনেই চলা। বিশেষ বিশেষ শব্দ চয়ন করে তার পেছনেই ঘুরপাক খাওয়া। একেবারে তিরিশের দশকের লেখকদের মতো। শেষমেশ যা বুঝতে পারলাম গল্পটা এক ফরাসি মাফিয়ার। এই তল্লাটে একেবারে অপরিচিত একটা বন্দরে এসে এক বিদেশি মহিলার পিঠে ছুরি বসিয়ে খুন করেছে। খুনটা করেছে অদ্ভূত ভাবে। মহিলার পিঠে ঠিক চোখের মনির মতো দেখতে একটা বিউটি স্পট ছিল। ঠিক তার ওপরই লোকটা ছুরি বসিয়েছে। মেয়েটাকে দেওয়ালের সঙ্গে চেপে ধরে ঐ একই জায়গায় বার বার ছুরি চালিয়েছে লোকটা । মহিলার গায়েও শক্তি কম ছিল না। কিন্তু এই হামলা এতটাই অতর্কিতে হয়েছে যে সে আত্মরক্ষার সময়ই পায়নি।
খুনি নিজে থেকে দোষ স্বীকার করে নিয়েছে। নিজেকে বাঁচানোর কোনো চেষ্টাই করেনি। সে আদৌ আর ফ্রান্সে ফিরতে পারবে নাকি এই বিদেশ-বিভুঁয়ে গায়ানার জেলেই তাকে পচে মরতে হবে সে নিয়েও তার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। সে ছিল আশ্চর্য রকমের নিঃস্পৃহ। সে শুধু বলেছিল, সেই চল্লিশ বছর আসে যখন সে মেয়েটিকে হারিয়েছিল তখনই তো তার আসল মৃত্যু ঘটে গিয়েছিল। তারপরে এতগুলো বছর সে তো ছিল একটা জ্যান্তলাশের মতো। তাই মরতে সে ভয় পায় না। কিন্তু যে মেয়েটিকে ছাড়া সে জীবন্মৃত হয়ে ছিল তাকেই বা সে খুন করল কেন! মেয়েটিকে সে বিয়ে করতে পারেনি। বিয়েতে বাধা ছিল। তাবলে তার ভালোবাসায় কোনও কমতি ছিল না। তার ভালোবাসা ছিল ঝর্ণার মতো উদ্দাম…পাখির গানের মতো স্নিগ্ধ। মেয়েটি যখন মারা যায়…বা মারা গেছে বলে তাকে জানানো হয় তখন তার বয়স ছিল মাত্র সাতাশ। তারপর থেকে এই এতগুলো বছর সে একাই কাটিয়েছে। সমাজ-সংসার থেকে নিজেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নিয়েছে। মেয়েটির সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে সে পেতিত ভিলাতেই থাকত। মেয়েটিকে সে ওখানেই গোর দিয়েছে। কিন্তু মার্সেইতেই তাদের ভালোবাসা ডানা মেলেছিল। এই মার্সেই-তেই জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়টা সে কাটিয়েছে। বন্দরটার জীবনযাত্রাও ছিল মেয়েটির চরিত্রের মতো… অস্থির…চঞ্চলমতি…ক্ষণে ক্ষণে তার রঙ বদলে যায়। লোকটির দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে নিজের ভালোবাসা দিয়ে মেয়েটিকে একদম বদলে দেবে। ভালোবাসা দিয়েই বুনো পাখিটাকে সে পোষ মানাতে পারবে। তার ভালোবাসা ছিল সর্বগ্রাসী..যা সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিতে পারে। কতই বা বয়স হবে তখন মেয়েটার? বড়জোর আঠেরো। আর ছেলেটির পঁচিশ। কিন্তু এই আঠেরো বছরেই জীবনের সব ওঠা-পড়া, সব ক্লেদ দেখে ফেলেছে মেয়েটি। প্রকৃত, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা সে পায়নি। আর ছেলেটি সেই অভাবই পূর্ণ করতে চায়। কিন্তু কিছুদিন পরে তারা দুজনেই বুঝে যায় দু-কূল ছাপানো যে ভালোবাসার স্বপ্ন তারা দেখছে তা অন্তত এ জীবনে আর সম্ভব নয়। মেয়টির বাবা-মা কেউ নেই, তিন কূলে কেউ নেই। ছোটবেলা থেকে শ্যাওলার মতো ভেসে বেড়িয়েছে। রোজ রাতে হাতবদল হয়েছে। তবে মাঝে তার শান্ত, স্নিগ্ধ মুখটাকে দেখলে ছেলেটির মনে হয়, ভালো সঙ্গে পড়লে মেয়েটি নিশ্চয়ই নান বা নার্সই বনে যেত। মেয়েটির কোনও মেয়েবন্ধু নেই। প্রেমিকও সেভাবে নেই। শুধু এক রাতের শরীর দেওয়া-নেওয়া। সে দুহাতে টাকা ওড়ায়, মদে চূর হয়ে থাকে। প্রতিরাতে পার্টি আর ড্রাগ। ঠিক এমন সময়েই ছেলেটির সঙ্গে তার দেখা। প্রথম প্রথম ছেলেটি ভাবে এই একটা বড় মওকা। মেয়েটিকে তো নিজের চোরা-কারবারে ব্যবহার করা যায়! মেয়েটির অনেক দোষ। বন্দরের জাহাজি আর পুলিশের সঙ্গে ঢলাঢলি করে বেড়ায়। মদ গিলে বেহেড হয়ে থাকে। কিন্তু সে কোনো নিষিদ্ধ চোরাকারবারে যুক্ত থাকতে পারে সে সন্দেহ কেউ করে না। মেয়েটা বড় বাচাল। কোনও কথা তার পেটে থাকে না। ছেলেটি ভাবে মেয়েটির এই রূপ-যৌবন ভাঙিয়ে নিজের কার্যসিদ্ধি করে নিতে হবে। মেয়েটি মানে মারি-হোস সে অর্থে ডানা-কাটা পরী নয়। কিন্তু লাস্যে…ছলাকলায় যে কোনও পুরুষের রক্তে আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে। মেয়েটির উথলে ওঠা এই ভাবটাকে অনেক সময় মেকি বলে মনে ছেলেটির। কিন্তু এটাই মারি-হোসের অস্ত্র…পুরুষ বধের হাতিয়ার। মেয়েটিও ছেলেটির সঙ্গে হাত মেলায়। মাঝে মাঝে এই বন্দর থেকে পালিয়ে ছেলেটির সঙ্গে পেতিত ভিলায় আশ্রয় নেয়। তারপর আবার ফিরে আরো সব দুঃসাহসিক খেলায় নামে। পুলিশ বা বন্দর কর্তৃপক্ষকে একেবারে ঘোল খাইয়ে ব্যবসায় একেবারে ফুলেফেঁপে ওঠে তারা। গোপন আস্তানায় কাঁড়িকাঁড়ি টাকা জমাতে থাকে। এভাবেই চলছিল সব। কিন্তু এরমাঝেই মেয়েটির প্রেমে পড়ে যায় ছেলেটি। বন্দরে গিয়ে মারি-হোস আবার খালাসিগুলোর বিছানায় নিয়ে উঠবে…রাতভর পার্টিতে বেলেল্লাপনা করবে…এটা ভেবেই মনটা বিদ্রোহ করে ওঠে ছেলেটির মানে ফ্রাংকোইসের। মারিকে অন্য কারো বাহুতে দেখলেই মনে জ্বলুনি শুরু হয়ে যায় তার। কিন্তু তার হাত-পাও যে বাঁধা। ব্যবসার জন্য মারিকে কাজে লাগাতেই হবে। কিন্তু মনের জ্বালাটা তাও যায় না। মাঝে মাঝে সে মারিকে না জানিয়ে মার্সেই-তে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। মারি তাকে দেখে চোখে-চোখে গোপন শলা করে নেয়। দু-তিন দিনের মধ্যে কার্যোদ্ধার করে মারি আবার তার কাছে ফিরে আসে। সোহাগে-ভালোবাসায় একে-অপরকে ভরিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে পাখি পোষ মানে। রগরগে মেয়েটার ভেতর থেকে একটা পেলব মন বেরিয়ে আসে। চোখ-মুখ থেকে উচ্ছৃঙ্খল জীবনের ছাপ মুছে গিয়ে একটা কমনীয়তা আসে। মারিকে দেখে এখন মনে হয় যেন নিষ্পাপ…ফুলের মতো এক কিশোরী।
কিন্তু তলে তলে যে বিপদ দানা বাঁধছে তা ফ্রাংকোইস টেরই পায়নি। তার এই রমরমা কারবার দেখে আগেকার চ্যালা চামুণ্ডাদের বা শত্রুপক্ষের মাফিয়াদের চোখ টাটিয়ে যায়। তারা কড়া নজর রাখের ফ্রাংকোইসের ওপর। জাহাজে জাহাজে কীভাবে ফ্রাংকোইস চোরা মাল চালান করে তা নিয়ে সবারই একটা সন্দেহ জাগে। এই খেলায় মারি-হোস-ই নাটের গুরু তা হাতে নাতে না ধরতে পারলেও সন্দেহ তো একটা রয়েই যায়। তাই শত্রুপক্ষের নজরদারি আরো কড়া হয়। ফ্রাংকোইস সেটা বুঝতেও পারে। এমন করেই বছর দুই কাটে। ফ্রাংকোইস ছক কষেছিল চার বছরের মধ্যে কয়েক কোটি টাকা কামিয়ে নিয়ে ধান্দা ছেড়ে দেবে। তারপর সবার চোখের আড়ালে গিয়ে মারিকে নিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দেবে।
কিন্তু বিধি বাম। হঠাৎ করে মারির মৃত্যুটা তাকে একেবারে খাদের মুখে ফেলে দিল। জীবন থেকে সব রঙ মুছে গেল তার। সেই ভয়াবহ রাতটার কথা সে জীবনেও ভুলবে না। এমনিতে ফ্রাংকোইস যখন বন্দরে গিয়ে কারবার করে তখন মারি থাকে তাদের গোপন ডেরায়। সে রাতে ফ্রাংকোইস ডেরায় ফিরে দেখে সবকিছু একেবারে লণ্ডভণ্ড। পাই-পয়সা-টা পর্যন্ত চুরি হয়ে গেছে। ঘরের মেঝেতে চাপ চাপ রক্ত। তারপর মর্গ থেকে ডাক আসে। লাশ সনাক্ত করতে হবে। এ নির্ঘাত কোনো শত্রুপক্ষের কাজ। কিন্তু কারা? অনেক চেষ্টা করেও কয়েক বছরেও সে কোনো কিনারা করতে পারল না। কোনো সূত্র নেই…কোনো সন্দেহভাজন নেই! এতে মনে সন্দেহ জাগাটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু ফ্রাংকোইসের মনে কোনও সন্দেহই জাগেনি। মারির মৃতুকে তাকে একেবারে পাথর করে দিয়েছিল।
সেদিন রাতে সে ছুটতে ছুটতে ডাক্তারের চেম্বারে পৌঁছেছিল ( কিন্তু শহরে এত বড় হাসপাতাল থাকতে এই একটা ঘুপচি ক্লিনিকে কেন আহত মানুষটাকে আনা হল সে প্রশ্নও ফ্রাংকোইসের মনে জাগেনি। মাথাটা একেবারে ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল)। ক্লিনিকের লোকজনেরা অবশ্য তাকে বুলেটবিদ্ধ দেহটাকে দেখাতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রেয়সীর নিথর, ক্ষত-বিক্ষতটাকে শরীরটাকে সে দেখতে চায়নি। তার মনে মারির যে ছবিটা আঁকা হয়ে রয়েছে সেটাই নাহয় শাশ্বত হয়ে থাক। দরকারি সব কাগজ-পত্রে সে সই করে দিয়েছিল…অন্ত্যেষ্টির সব খরচ-খরচাও দিয়ে দিয়েছিল। মাসের পর মাস ছোট্ট সমাধি ক্ষেত্রটায় এসে সে চুপচাপ বসে থাকত। চোখের জলে বুক ভেসে যেত। সমাধিফলকে শুধু একটা কথাই লেখা ছিল ‘মারি-হোস’। আর কিচ্ছু না। সময় বয়ে যায়। এখন আর সে সমাধির কাছে এসে বসে থাকে না। বয়সও অনেক হল। পুরোনো ধান্দাতেই আবার জুটে গেছে। কারণ আর অন্য কিছু তো সে শেখেনি। এবার চোর, ডাকাত, খুনি যাকেই পায় তার সঙ্গে ধান্দাতেই নেমে পড়ে। কিচ্ছু বাছবিচার করে না। তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাই যখন আর নেই! এখন আর অত দাঁও মেরে কাজ নেই। নিজের দিন গুজরানের জন্য অল্প কিছু রোজগার হলেই হল। মারি যখন সঙ্গে ছিল তখন সে কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখত। এখন মারিও নেই, আর সে স্বপ্নও নেই। অনেক পরিবর্তন এল তার মধ্যে। সে এখন অনেক ভদ্র, নম্র। লোকজনেরা সমীহ করে চলে।
পাঁচ বছর আগে সেই মোক্ষম ঘটনাটা ঘটল। এক দাগি জেলখাটা অপরাধী আমেরিকা থেকে ফিরে বন্দরের বন্ধু-বান্ধবদের কথায় কথায় জানায় যে একদম মেরি-হোসের মতো এক মহিলাকে আটলান্টিকের ওপারে সে নাকি দেখে এসেছে। সেখানে এ রকম একটা বন্দরেই নাকি সেই মহিলার বাস। কথাখানা একান-ওকান হতে হতে ফ্রাংকোইসের কানেও পৌঁছয়। সে তো রীতিমতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। কিন্তু মন থেকে ব্যাপারটা কিছুতেই মুছে ফেলতে পারে না। সেদিনই বাস ধরে চলে যায় সমাধিক্ষেত্রে। তার প্রিয়তমার কবরটা শুকনো পাতায় ঢেকে গেছে। সমাধিফলকে এখনও মারি-হোস নামটা জ্বলজ্বল করছে। শুধু মারি নয় এখানে যে মাটির নীচে চাপা পড়ে রয়েছে তার সব আশা…সব স্বপ্ন। আকণ্ঠ গিলে চূর হয়ে বসে থাকে ফ্রাংকোইস।
কয়েক মাস পরে হঠাৎ করে এক পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়। এই বন্ধুটির কাছেই ঐ জেল ফেরত আসামী মারি-হোসের মতো দেখতে মেয়েটির গল্পটা করেছিল। ঐ আসামীর কাছ থেকেই ঐ বন্দরের কথা জেনেছিল ফ্রাংকোইসের বন্ধু। মহাসাগরের ওপারের বন্দরে যে মেয়েটা থাকে তার নাম নাকি মারি-ইনেস। একেবারেই বিগতযৌবনা। স্থানীয় ভাষায় চোস্ত হলেও কথাবার্তায় বিদেশি টান নাকি একটা রয়েই গেছে। ঐ জেলফেরত আসামী নাকি ঐ বন্দরে ফূর্তি করতে গিয়ে মারি-ইনেসের সঙ্গে এক রাতও কাটিয়েছে। সে মহিলার পিঠে নাকি অদ্ভূত একটা বিউটি স্পট রয়েছে…ঠিক চোখের মণির মতো।
থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে ফ্রাংকোইস। এ কী নিছক সমাপতন! চোখের মণির মতো বিউটিস্পট! না না, ওটাতো একটা উল্কি। প্রথম যৌবনের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। মারিকে দেখে দেখেও তার আশ মিটত না। মারিকে সে ইচ্ছে মতো সাজাত…একেবারে পুতুলের মতো। জাহাজিগুলোর উল্কি দেখে মারি বায়না করেছিল তারও নাকি ঐ রকম একটা উল্কি চাই। মারির কথা রাখতে তার পিঠে একটা ফুলের উল্কি করে দিয়েছিল ফ্রাংকোইস। মারির জন্য সে নিজে উল্কি করা শিখেছিল। এই দায়িত্বটা সে অন্যকাউকে দিতে চায়নি। মারির যদি বেশি ব্যথা লাগে! মারির পিঠে আঁকার আগে রীতিমতো নিজের হাতে মকশো করে সে হাত পাকিয়েছিল। মারির পিঠে সূঁচটা ঠেকানোর আগে তার একবার হাত কেঁপে উঠেছিল! এত সুন্দর শরীরটাকে ক্ষত-বিক্ষত করতে মন সায় দিচ্ছিল না । কিন্তু মারির পিঠে বাহারি ফুলটা ফুটে উঠতেই সব আশঙ্কা দূর। মারিও আনন্দে আত্মহারা। দুটো আয়না দিয়ে কায়দা করে বার বার নিজের এই বিউটিস্পট দেখেই যায়।
ফ্রাংকোইস এবার একটা নতুন খেলা শুরু করে। সত্যিটা যে তাকে জানতেই হবে। আমেরিকা থেকে জাহাজে করে যে সব পর্যটক আসে তাদের পেছনে সে ঘুরঘুর শুরু করে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে বুঝতে পারে কার কাছে গেলে সুবিধা হবে। রোদে পোড়া চামড়া, হাতের উল্কি দেখেই সে বুঝতে পারে কোন লোকটি বন্দরে থাকে। বন্দরের লোকজনেদের চোখমুখে একটা উচ্ছৃংখল জীবনের ছাপ থাকে তো! এই করতে করতেই এক ভবঘুরে ছোকরার সঙ্গে তার মোলাকাত হয়ে যায়। সে ছোকরা আবার ইউরোপীয় নয় ( এই অবধি বলে সাংবাদিক বন্ধুটি একটু জিরিয়ে নেয়… ‘তা আমি সেই বুটপালিশওলাকে জিগ্যেস করছিলাম “ এই ভেনেজুয়েলান ছোকরাটি কে? তুমি নয়তো? সে বান্দা কথাটা স্বীকারই করেনি’। আমি বলি… ‘ব্যাপারটাকে কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সেদিনকার সেই দাগী আসামী হিসাবে এখন আর কেউ ওকে চিনতে পারবে না। তারওপর চল্লিশ বছর আগেকার কথা। কথাটা একেবারে লুফে নেন সাংবাদিক বন্ধুটি… ‘তা ঠিক। যে ছেলেটা সেদিন প্লাজায় বুট পালিশ করত সেই আজ বয়স কালে গল্পটা বলছে। আর তখনকার সব খবরের কাগজের হেডলাইনও মনে রেখেছে। সুতরাং, এই মানুষটিই হয়তো সেদিনকার সেই ভবঘুরে ছোকরা। ফ্রাংকোইস আর মারি-হোসের মধ্যে যোগসূত্রটা হয়তো ঐ ছোকরাই। হওয়াটা কিছু অস্বাভাবিক নয়।)
যৌবনে যত টাকা ফ্রাংকোইস কামিয়েছিল ততটা আর কোনোদিনও রোজগার করতে পারেনি। তবে প্রাচুর্য না থাকলেও স্বাচ্ছল্য ছিল। খেয়ে পরে ভালোই কাটছিল। তাছাড়া কিছু সঞ্চয়ও ছিল। যে বিপজ্জনক খেলায় সে নেমে পড়েছে তাতে টাকা ঢালতেও তার কার্পণ্য নেই। পাগলে মতো ভালোবেসেছিল সে। এখন তার মনে শুধুই সন্দেহ আর ঘেন্না ( হয়তো বা কিছুটা জিঘাংসা)। ঐ ভবঘুরে ছোকরাকে সে বাড়িতে এনে তোলে। তার পেছনে দেদার টাকা ওড়ায়। তার জন্য বন্দর থেকে নিত্যনতুন মেয়ে এনে দেয়। কাঁড়ি কাঁড়ি মদ গেলায়। এই করে দুজনের মধ্যে অদ্ভূত একটা বোঝাপড়া গড়ে ওঠে (সে ছোকরারও অবশ্যি একটু যত্ন আত্তির প্রয়োজন ছিল)। তবে এটা বোঝাপড়া নাকি ব্ল্যাকমেইল তা বলা মুশকিল। আসলে টাকা ছড়িয়ে সেই ছোকরাকে কিনে ফেলেছিল ফ্রাংকোইস। আর উপকারীর উপকারে লাগতে ছোকরারও কোনও আপত্তি ছিল না। তাছাড়া ফ্রাংকোইস তাকে যে কাজটা দিয়েছিল সেটা তো একেবারে জলের মতো সোজা। শুধু নিজের দেশে ফিরে গিয়ে পুয়ের্তো কাবেলো-বন্দরে কিছুদিন কাটিয়ে ড্রাগ আর মদে আসক্ত এক বয়স্ক মহিলা খুঁজে বের করতে হবে। তারপর কোন একটা ছুতোয় তার সঙ্গে একটা রাত কাতিয়ে পিঠটা ভালো করে দেখতে হবে। এ আর এমন কঠিন কী কাজ! ফ্রাংকোইসের কাছ থেকে টাকাপয়সা নিয়ে সে ছোকরা দেশে ফিরে গিয়ে কাজে নেমে পড়ে।
এর মধ্যে পুরসভার কাছ থেকে মারি-হোসের কবরটা খুঁড়ে কফিনটা খুলে দেখার অনুমতি জোগাড় করে নেয় ফ্রাংকোইস (তারজন্য পুরসভার কেষ্টবিষ্টুদের হাতে রাশি রাশি টাকাও গুঁজে দিয়েছিল)। খুব সাবধানে পা ফেলছিল সে। এক নির্জন দুপুরে কফিনটা খুলে তার চক্ষু চড়কগাছ। কফিনের ভেতর শুধু কিছু নুড়ি পাথর আর কয়েকটা জামা-কাপড়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অনুভূতিগুলো তার মরে গিয়েছিল। কিন্তু ঠিক মুহূর্ত থেকে এক ভয়ংকর ক্রোধে সে পাগল হয়ে ওঠে। শিরায়-ধমনীতে দামাল রক্তকণাগুলো উন্মত্তের মতো ছোটাছুটি শুরু করে। যে মনে একদিন ছিল ভালোবাসা সেখানে আজ শুধু ঘৃণা আর আক্রোশ। কম বয়সের কথা মনে পড়ে যায়। তখন সে মারির জন্য জীবনের সবকিছু উজাড় করে দিতে পারত…তার পায়ে সর্বস্ব সবকিছু বিলিয়ে দিতে পারত। কিন্তু আজ সে নিজের সবকিছু উজাড় করে দিয়ে মারিকে ধ্বংস করে দিতে চায়। প্রতিহিংসার আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে চায় । আসলে মারির মতো মেয়েরা কাউকে ভালোবাসতে পারে না ( অন্য পুরুষদেরও সে নিশ্চয়ই এভাবেই ঠকিয়েছে)। ভালোবাসার রাতগুলোর কথা ভুলতে এই সব মেয়েদের এক মিনিটও সময় লাগে না। একেবারে থম মেরে যায় ফ্রাংকোইস। কয়েক সপ্তাহ সে নিজেকে একেবারে ঘরবন্দী করে রাখে। মারির সঙ্গে কাটানো পুরোনো দিনগুলোর কথা ভাবে। স্মৃতির সরণি বেয়ে হেঁটে চলে বেড়ায়। মারির সঙ্গে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত ছবির মতো ভেসে আসে তার চোখের সামনে। কিন্তু আজ সে হৃদয় খুঁড়ে দেখে যে সেখানে আর কোনো বেদনা জাগে না, জেগে ওঠে শুধু উদগ্র ঘৃণা।
সেই ছোকরার ফিরে আসা অবধি তাকে অপেক্ষা করতেই হবে। কিন্তু সে এখন নিশ্চিত যে মারি এখনও বেঁচেই রয়েছে। কিন্তু কেন এই ছলনা? কেন মারি তাকে এমনভাবে ঠকালো? তবে কার সঙ্গে সে পালাল? ফ্রাংকোইসের চোখের সামনে শত শত মুখ ভেসে আসে যাদের সে কখনো না কখনো পানশালায় মারির পাশে দেখেছে। ওকি কোনো নাবিকের সঙ্গে পালিয়েছে? নাকি একরাতের কোনো খদ্দেরের সঙ্গে? আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে ও এমন কারো সঙ্গে পালিয়েছে যাকে ফ্রাংকোইস কোনোদিন সন্দেহের তালিকাতেই রাখেনি।
রাতের পর রাত সেই মুখগুলো হাতড়ে চলে ফ্রাংকোইস। কিন্তু ঠাওর করতে পারে না। মুখের সারিগুলো প্রেতাত্মার মতো চোখের সামনে আসে…আবার বাতাসে মিলিয়ে যায়। এর মধ্যে সেই ভবঘুরে ছোকরা ফিরে আসে। সে তো মহা উৎসাহে নিজের ঝাঁপি খুলে সবে ( আসলে আগেকার গল্পটাতো তার জানা ছিল না)। ছোকরার কথা শুনে ফ্রাংকোইসের মনে আর কোনো সন্দেহ থাকে না। ঐ মহিলাই মারি হোস। অন্য কেউ হতেই পারে না। জীবনের সেরা সময়টা কাটিয়ে আসার পর সে মহিলা মুখফসকে আগেকার জীবনের অনেক কথাই মাঝে সাঝে বলে ফেলেছে। ছোকরার এক সঙ্গে একরাত কাটিয়ে বকবক করতে করতে দু-একটা গোপন কথাও বলেছে। ভাঁজ পড়া চামড়ার এই বয়স্ক মহিলাকে দেখে ছোকরার প্রথমে মোটেই ভক্তিছেদ্দা জাগেনি। নেহাতই কাজের খাতিরেই তাকে খদ্দের সাজতে হয়। কিতু যৌবন না থাকলে কি হবে বিছানায় সে মহিলার ছলাকলায় ছোকরা একেবারে কুপোকাত। মহিলা ঘুমিয়ে পড়তেই সে ছোকরা কায়দা করে পিঠে আঁকা উল্কিটা দেখে নেয়। ছোট্ট একটা ফুল… বেগুনি পাপড়ি। সে মহিলা নাকি সারাদিনই মদে চূর হয়ে থাকে। মাঝে মাঝেই খুব শরীর খারাপ হয়। প্রায়ই মার্সেই-এর কথা ভাবে। একবার নাকি সে মার্সেই-তে ফিরে এসে একজনের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার কথাও ভেবেছিল। কিন্তু পারেনি। এই ক্রান্তীয় জলবায়ুর মদিরতায় একেবারে স্থবির হয়ে পড়েছিল। একবার সে একজনের মৃত্যুর খবরও পেয়েছিল। অনেক খোঁজ খবরও করেছিল। সেই মানুষটির অন্ত্যেষ্টিতে হাজির ছিল এমন একজন সাক্ষীকেও নাকি সে পেয়েছিল।
কিন্তু এখন সে কোথায় থাকে? কার সঙ্গে থাকে? কী করে? ফ্রাংকোইসের মনে অনেক প্রশ্ন। যা খবর জোগাড় করা গেছে ছোকরা সেসবই উগরে দেয়। সে মহিলার নাকি প্রচুর টাকা। বিরাট বাড়ি। সাঙ্ঘাতিক বিলাসী। জীবনে কোনো লক্ষ্য নেই…কোনো আশা-আকাঙ্খাও নেই। শুধু প্রমোদে গা ভাসিয়ে দেওয়া। মহিলার কোনো বাঁধা খদ্দেরও নেই। যখন যাকে পায় তার সঙ্গেই গিয়ে জোটে। সাকুল্যে দুবার-কি তিনবার ছাড়া বিদেশি খদ্দেরকে সে কোঠায় তোলেনি। সে বলে, স্থানীয় পুরুষমানুষেরা নাকি অনেক আকর্ষণীয়। তাদের যা তাকত ( মহিলার সঙ্গে কয়েক রাত কাটানো ঐ কালোকোলো লোকটার মতোই। তার সঙ্গে আবার ঐ ভবঘুরে ছোকরাটার আলাপও হয়ে গিয়েছিল) বিদেশিগুলোর তার ছিটেফোঁটাও নেই।
কিন্তু কীসের জন্য? কীসের জন্য এতটা পথ পাড়ি দেওয়া? নিজের নাম বদলানো? মারি এতসব করল কেন? কীসের আশায়? ফ্রাংকোইস কোনও জুতসই জবাব পায় না। তবে এই নতুন জায়গায় এসে মারির মন বসেনি। পুয়ের্তো কাবেলোর জীবনের স্রোতে শুধু নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছে। প্রথম প্রথম ঐ ‘ভদ্দরলোক’গুলোর সতী-সাধ্বী বউয়েরা এসে শাসিয়ে যেত। কিন্তু পরে সেসব মিটেও গেছে। পরে কয়েকটা ভদ্র পরিবারের সঙ্গে তার বন্ধুও হয়ে গেছে। ছোকরা তো যা জানে সব উগরে দেয়। কিন্তু ফ্রাংকোইস-তো রয়েছে অন্যতালে। ছোকরার বর্ণনা শুনে নিজের কাহিনির শূন্যস্থানগুলো ভরাট করে নেয়। পুয়ের্তো কাবেলোর ঐ মহিলাই মারি হোস। অন্য কেউ হতেই পারে না। কিন্তু কেন সে এসব করল?
ছোকরার পেট থেকে সব আদায় করে নিয়েই তাকে পত্রপাঠ বিদেয় করে দেয় ফ্রাংকোইস। ঘেন্না, বিদ্বেষ…প্রতিহিংসা ছাপিয়ে তার মনে এখন শুধু একটাই প্রশ্ন। কেন দরকার হল এই অভিনয়ের। সে তো মারিকে জীবনের সবকিছু উজাড় করেই দিয়েছিল তবু কেন দরকার হল এই চুরির? এত বছর কেন সে এভাবে মুখ ঘুরিয়ে থাকল? এই রহস্যটা ফ্রাংকোইসকে নিজেকেই ভেদ করতে হবে। কোনও গোয়েন্দা লাগিয়ে হবে না। তবে এটাও ঠিক যে ঐ মহিলাকে পেলে একটা খুনোখুনি হবেই।
আবার নতুন করে নিজেকে গুছিয়ে নেয় ফ্রাংকোইস। তার জীবনের সবটা জুড়ে এখন মারি-হোস। মারি হোস ছাড়া তার জীবনে কিচ্ছু নেই, কিচ্ছু ছিল না, কিচ্ছু থাকবেও না। তার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ ঐ একটা বিন্দুতে এসেই মিলেছে। মার্সেই-তে যে অল্প কাজকর্ম বাকি ছিল সে মিটিয়ে নেয়। তারপর টাকাপয়সা যোগাড় করে নিজের এই চিরপরিচিত জায়গা, নিজের ভাষা আর নিজের বন্ধু-বান্ধবদের চিরকালের মতো বিদায় জানিয়ে জাহাজে গিয়ে ওঠে।
এই জাহাজেই ফ্রাংকোইসের সঙ্গে আমাদের ঐ বুটপালিশওলার আলাপ যাকে আমরা সেই ভবঘুরে ছোকরা বলে ধরে নিতেই পারি। ফ্রাংকোইসের সঙ্গে সে একেবারে পুয়ের্তো-কাবেলো পর্যন্ত যায়। জাহাজে তাদের একেবারে গলায় গলায় বন্ধুত্ব। একসঙ্গে মদ খায়, গল্প-গুজব করে। তবে ফ্রাংকোইস কিন্তু ঘুণাক্ষরেও মেয়েটির কথা তোলেনা। সে এই নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরিয়েছে তার কোনো স্পষ্ট জবাবও কাউকে দেয় না।
যাইহোক, পুয়ের্তো কাবেলোয়-পৌঁছে ফ্রাংকোইস একেবারে দিশেহারা। এই ক্রান্তীয় অঞ্চলের চড়া রোদ, আর গরমে একেবারে কুপোকাত। সে প্রকাশ্যে খুব একটা ঘোরাফেরা করতে চায় না। এর মধ্যেই স্থানীয় এক লোকের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলে। সেই লোকের হাতে টাকাপয়সা গুঁজে দিয়ে গোপন আস্তানার ব্যবস্থাও করে নেয় । সেই লোকটা তার দোভাষীর কাজ করে দেয়। রাতের বেলা তাকে নিয়ে ঘুরতে বেরোয়। কখনো পায়ে হেঁটে কখনো ট্যাক্সিতে। এই ঘোরাঘুরির একটাই উদ্দেশ্য মারিকে খুঁজে বের করা। এর মাঝেই তাকে মারি-ইনেসের বাড়ির কাছে নিয়ে আসে সেই লোক। ফ্রাংকোইস মারি-ইনেস-কে দেখে। এবার থেকে ঘাপটি মেরে থেকে মারি-ইনেসের সব গতিবিধির ওপর সে লক্ষ্য রেখে যায় । মারি ইনেস বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে…গাড়িতে উঠছে…। নাহ, এ মহিলাই তার মারি-হোস। অন্য কেউ হতেই পারে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটু পৃথুলা হয়েছে…রূপের জৌলুস কমে এসেছে…সেদিনকার সেই ছটফটে অষ্টাদশীর উচ্ছ্বলতাও আজ নেই। কিন্তু মারিকে তার চিনতে ভুল হয়নি। চেহারায় বদল এলেও সেই একই হাঁটাচলার চলার ধরণ…সেই একই বাঁকা চোখের চাউনি। ভুল করার আর অবকাশই নেই।
মহল্লার লোকজনেরা অবশ্য ফ্রাংকোইসকে দেখে কোনো সন্দেহই করেনি। বুড়ো-হাবড়া একটা লোক…সে যে খুনের মতো একটা জঘন্য কাজ করতে পারে তা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। বুড়ো মানুষটা মারি-ইনেসের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায় আর ফেলে আসা দিনগুলোর কথায় বুঁদ হয়ে থাকে। তিন দিন বাদে মারি-ইনেস থুড়ি মারি হোসের ছুরিকাবিদ্ধ লাশখানা মেলে। সারা দেহে কোনো ক্ষত-চিহ্ন নেই। শুধু পিঠের উল্কির জায়গাটা ক্ষতবিক্ষত। প্রবল আক্রোশে বার বার সেখানে ছুরির কোপ বসানো হয়েছে।
এর পরের অংশটা সেই বুটপালিশওলার সত্যিকারের গল্প নাকি আমাদের সাংবাদিক বন্ধুর উর্বর মাথার সৃষ্টি তা অবশ্য বলা মুশকিল। ফ্র্যাংকোইস কি মারির কাছ থেকে কোনও জবাবদিহি চেয়েছিল? কোন উপন্যাসে বা দুই-অংকের নাটকের কি প্রধান চরিত্রের স্বীকারোক্তি কি থাকতেই হবে? বোধহয় না। বুটপালিশওয়ালা আর আমাদের সাংবাদিক বন্ধু দুজনের বক্তব্যই এখানে এক। মারি কারো কাছে কোনও জবাবদিহি করেনি। সে নিজের মর্জির মালিক। নিজের শর্তে সে জীবন-যাপন করেছে। ফ্রাংকোইস তাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করত। সেই সুযোগটাই সে নিয়েছে। সে অন্য কারো সঙ্গে পালায়নি। অন্য কাউকে মন দেয়নি। এই অর্থে ফ্রাংকোইসকে সে ঠকায়নি। সে নিজের ইচ্ছেতে চলে গেছে। একাই। ফ্রাংকোইস যেদিন মর্গে কফিনটা আনতে গিয়েছিল সেদিন মারি মার্সেইতেই এক গোপন ঘাঁটিতে লুকিয়েছিল। শেষ মুহূর্তেও তার রসবোধ যায়নি। তাই বন্ধু-বান্ধবদের জুটিয়ে ভয়ংকর একটা মজা করতে চেয়েছিল। ফ্রাংকোইস যদি সেদিন কফিনটা খুলে দেখত তাহলেই সব ভুল-বোঝাবুঝি মিটে যেত। মারিও হয়তো মনে মনে সেটাই চেয়েছিল। সে ভেবেছিল কফিনটা খোলার পরই সে আবার ফ্রাংকোইসের কাছে ফিরে যাবে। এই বীভৎস মজাটার জন্য ক্ষমা চেয়ে নেবে। তারপর আবার নিজেদের মধ্যে বনিবনা হয়ে যাবে। কিন্তু ফ্রাংকোইস-তো কফিনটাই খুলে দেখেনি। সে তো প্রথম থেকেই ধরে নিয়েছিল যে মারি মরে গেছে। তাই অভিমানে মারিও আর তার ভুলটা ভাঙাতে যায়নি। নিজেই সরে গেছে। অভিমানী মন যে বড় অবুঝ!
লেখক পরিচিতি
হোসে বালজা ( ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৯— )
তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির সমালোচক। পড়াশোনার জন্য ভেনেজুয়েলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে আসেন রাজধানী ক্যারাকাসে। সেখানে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রি লাভ করেন।
নিজের রচনায় মূলত মানুষের মনস্তত্বের নানার পরত তিনি আবিষ্কার করে গেছেন। তাঁর মতে একই মানুষের মনে লুকিয়ে থাকে বহু সত্তা। শৈশব থেকে শুরু করে বার্ধক্য পর্যন্ত প্রতিটা মুহূর্তে আমরা নিজেরা তো বদলাচ্ছিই, সেইসঙ্গে, অন্যদের জীবনেও বদল আনছি। এই বিশেষ শৈলীই তাঁকে লাতিন আমেরিকার সাহিত্য জগতে স্বতন্ত্র করে তুলেছে। এই শৈলীকেই বলা হয় ‘সাইকোপ্যাথোলজি’।
তাঁর রচনা ইতালিয়ান, ফরাসি, ইংরেজি, জার্মান ইত্যাদি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস ‘Percusion’ (১৯৮২)। আর সবচেয়ে সাড়া জাগানো ছোটগল্প সংকলন ‘La mujer de Espaldas’ (১৯৯০)।
এই সংকলনের ‘উল্কি’ গল্পটি তাঁর ‘আ উওম্যান’স ব্যাক’ গল্পের অনুবাদ। এটি তাঁর সাইকোপ্যাথলজি ঘরানারই অন্যতম সেরা দৃষ্টান্ত।

Exit mobile version