গল্প- চিনি মিনির বাড়ি ফেরা

চিনি মিনির বাড়ি ফেরা
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

হেড স্যারের টেবিলের ল্যান্ড লাইন ফোনটা বেজেই চলেছে অনেক ক্ষণ ধরে। হেড স্যারের পাশেই বসেন বাসন্তী দেবী হাইস্কুলের বর্ষীয়ান শিক্ষিকা অনুভা ম্যাম। মনে হচ্ছে উনি ক্লাস নিতে গেছেন। হেড স্যারও এসে পৌঁছাননি। সুতরাং স্কুলের হেড ক্লার্ক অনিমেষ বাবুকে বাধ্য হয়ে ফোনটা ধরতে হয়। উনি গম্ভীর স্বরে বললেন, হ্যালো…
-আমি তপন বাবু বলছি। অনুভা দিদিমণিকে একটু বলে দেবেন চিনি, মিনি বাড়ি ফিরে এসেছে। আর চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। এই কথাগুলো বলে ফোনটা কেটে দিলেন তপন বাবু। মানে অনুভা ম্যামের স্বামী।

কিছুক্ষণ বাদে যখন অনুভা ম্যাম হেড স্যারের রুমে এসে টেবিলে ক্লাস টেনের রেজিস্টার খানা রেখে চেয়ারটা টেনে বসলেন। হেড ক্লার্ক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে জানালেন তপন বাবু ফোন করেছিলেন আর বললেন চিন্তার কোনো কারণ নেই। চিনি আর মিনি ঘরে ফিরে এসেছে।

এই খবরটা শোনা মাত্রই অনুভা ম্যামের চোখদুটোতে খুশি ঝলকানি দেখা দিল। ম্যাম তাড়াতাড়ি দেওয়ালে বাঁধানো পরমহংসের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে করজোড়ে প্রণাম সারলেন। তারপর বললেন, সত্যি খুব চিন্তার মধ্যে ছিলাম অনিমেষ বাবু। দু’দিন আগে সকালে একবার এসেছিল চিনি আর মিনি আমাদের ঘরে। তারপর থেকে আর দিনে রাতে একেবারের জন্য মুখটা পর্যন্ত দেখাতে আসে নি জানেন। যাক বাবা এবার ইলেভেনের ক্লাসটা মন দিয়ে করতে পারবো। ফার্স্ট পিরিয়ডটা করতেই পারলাম না ঠিক ভাবে। মন অশান্ত থাকলে কোনো কাজ হয়? নাওয়া খাওয়া সবই করছিলাম কিন্তু সারা ক্ষণ চিনি আর মিনির জন্য মনটা অস্থির হয়ে থাকতো।
জানেন অনিমেষ বাবু ওরা দুটিতে ইলিশ মাছের খুব ভক্ত। সেই কারণে কর্তা মশাই বুধবার ইলিশ এনে বললেন, আজ তো দুজনের দুপুরের ভোজটা জমিয়ে হবে।
আমি তো রান্না মাসীকে বললাম, দু পিস ইলিশ মাছ ভাজা তুলে রাখো আগে চিনি সোনা আর মিনি সোনার জন্য। কর্তা তো সরষে বাটা দিয়ে ঝাল ঝাল করে ইলিশ মাছ খাবে।আর চিনি, মিনি ভাজা মাছ ছাড়া একদম খেতে চায় না। আমি তো রোজই স্নান পূজো সেরে ওদের দুজনের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে দুজনকে দুমুঠো ভাত খাইয়ে তবে আমি ভাত খেয়ে স্কুলে আসি।

কি বলবো অনিমেষ বাবু, বুধবার সকালে আমি ওদের জন্য খাবার বেড়ে ওদেরকে ডাকাডাকি করেই চলেছে কিন্তু ওরা আর এলো না। এদিকে আমারও স্কুলের টাইম হয়ে আসছে। আমি ছটফট করছি। একবার এ ঘরে আরেক ও ঘরে ওদের খুঁজেই চলেছি। ছোট খাটো নরম শরীর নিয়ে মাঝে মধ্যেই খাটের তলায় ঘাপটি মেরে বসে থাকে।
একে তো আমার হাঁটু ভাজ করা নিষেধ। তবুও ঝুঁকে দেখতে থাকি খাটের তলা, সোফার তলা । ভিতরে ভিতরে টেনশনটাও বেড়ে চলেছে। কিন্তু কি আর করবো আমাকে তো আমার চাকরিটাও রক্ষা করতে হবে। তাই বিষণ্ণতা আর উদ্বিগ্নতা নিয়ে দু মুঠো ভাত খেতে বসলাম। ভাতে ইলিশের ঝাল বাটনাটা মেখে মুখে পুড়লেও কোনো স্বাদ আস্বাদন করতে পারেনি সেদিন। বারবার দুটো ফুটফুটে কচি মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠছে।

কোন রকমে খেয়ে উঠে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে স্কুলে চলে এসেছিলাম সেদিন। আপনি তো জানেন আমার বাড়ি স্কুলের পাশে বলে আমি রোজ প্রায় সবার শেষে বাড়ি ফিরি। কিন্তু বুধবার লাস্ট পিরিয়ডটা অফ ছিল বলে হেড স্যারকে বলে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এসেছিলাম। বাড়ি ফিরে দেখি কর্তাও বিষণ্ণ মুখে বসে আছে। আমি বুঝলাম ওরা এখনো বাড়ি ফেরেনি।
হঠাৎ মনে পড়ল মুখার্জি বৌদির কথা। চিনি আর মিনি মাঝে মধ্যেই ওদের বাড়িতে যায়। তাই তাড়াতাড়ি করে বৌদিকে ফোন করে ওদের কথা শুধালাম।
বৌদিও বললো, না দিদিমণি দুজনের কেউই আসে নি তো।
তখন আমি হাল ছেড়ে দিয়ে ঠাকুরকে ডাকতে লাগলাম। ঠাকুর আমার চিনি আর মিনিকে রক্ষা করো। এই দুটো দিন যে আমার কি টেনশনে কেটেছে আপনাকে কি বলবো!

অনিমেষ ভ্রু কুঁচকে বললেন, দিদিমণি আপনারা তো শিক্ষিত মানুষ। আপনারা জানেন না বাড়ি থেকে কেউ মিসিং হয়ে গেলে থানায় একটা ডায়েরি করতে হয়। সেসব না করে দুদিন ধরে ঘরে বসে ঠাকুর কে ডাকতে লাগলেন। কোন যুগে বাস করেন আপনারা!

অনুভা ম্যাম খুব আস্তে আস্তে বললেন, অনিমেষ বাবু ইচ্ছে যে আমার হয় নি একেবারে তা নয় কিন্তু। কিন্তু কর্তা মশাই বললেন, থানায় গিয়ে বলবে কি?
আমি বললাম- বলবো, চিনি আর মিনিকে বুধবার সকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
তারপর কর্তা বললেন, থানার ওসি যখন জিজ্ঞেস করবে ওরা দেখতে কেমন, ওদের পরণে কি পোশাক ছিল, ওদের বয়স কত? তখন সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে তো?
এইকথা শুনে আমি আর এগিয়ে যেতে পারলাম না। দেখতে কেমন বলা যাবে, বয়স কত তাও বলতে পারবো কিন্তু পোশাক?
অনিমেষ বাবু বলেন,আপনি ওদেরকে এতো ভালোবাসেন আর খেয়ালই করেননি ওরা সকাল বেলায় কি পোশাক পরেছিল?
-আসলে অনিমেষ বাবু ওরা তো পোশাক পরতে চায় না।
প্রচন্ড রকম কৌতুহল নিয়ে অনিমেষ বাবু জিজ্ঞাসা করেন, মানে?
-ওরা তো মানুষের বাচ্চা নয়। ওরা তো আমার বিড়াল বাচ্চা।

এইকথা শোনা মাত্রই অনিমেষ বাবু হো হো করে হেসে হেড স্যারের রুম খানা কাঁপিয়ে তুললেন। সঙ্গে সঙ্গে আরো বেশ কিছু টিচার, স্টাফ এসে হাজির সেখানে। সবাই চিনি আর মিনির আসল পরিচয় পেয়ে খুব হাসতে থাকে। আর বলে, অনুভা ম্যাম বিবেকানন্দের ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’ এই বাণীটির সার্থক প্রয়োগ তো আপনারা করে দেখিয়ে দিলেন।

Loading

Leave A Comment