গল্প- জীবনের জয়গান

জীবনের জয়গান
-সঞ্চিতা রায় (ঝুমকোলতা)

আজ বিশ্বকর্মা পুজো। আমাদের অফিসের সাংস্কৃতিক মঞ্চে কিছু ছোট ছোট ছাত্রছাত্রীরা তাদের নিজেদের জীবনের কথা, পরিবারের কথা, প্রতিবেশীদের কথা বলছে। না কোনো শ্রুতি নাটক, নাটিকা বা মঞ্চনাটক নয়, বাস্তব জীবনের গল্প আজ ওরা বলছে। ওদের বলা শেষ হলে করতালিতে মুখরিত প্রেক্ষাগৃহ। প্রতিবছর নাটক হয়, এবছর নাটক হয়নি বলে কারুর কোনো আপসোস নেই। এ যেন এক নতুন অভিজ্ঞতা।
ঘটনাবহুল জীবন, জীবনের প্রতিটি বাঁকে মানুষ কতরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়, যা তার পরবর্তী জীবনের পাথেয় হয়। বাসস্ট্যাণ্ডে অফিস যাব বলে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। পরপর দুটো বাস ব্রেকডাউন। আজ বোধহয় টোটো আর ম্যাজিকে করেই অফিস যেতে হবে। “দিদি একটা ফুলের মালা নাও না! বেশী দাম নেব না” রোজই ছেলেটাকে দেখি। “আজ এখন ও একটাও বিক্রি হয়নি দিদি, নাও না একটা”। কেমন যেন মায়া হলো। বেশ অনেকটাই ছোটো ও আমার চেয়ে। তাই তুইই বললাম। বললাম “আচ্ছা দে একটা” মালা নিয়ে দাম দিতে যাচ্ছি, বললো, “দিদি আর একটা মালা তোমার খোঁপায় লাগিয়ে দিই, দেখো ভাল লাগবে”। আরেকটা মালার দাম দিতে যাচ্ছি, “না না দিদি, ওটা তোমায় আমার দিতে ইচ্ছা করলো, আমার এক মাসতুতো দিদিকে আমি একসময় এই রকম মালা গেঁথে লাগিয়ে দিতাম, খুব খুশি হতো। ওই দিদি এখন কাজে খুব ব্যস্ত, আর দেখা হয় না,তাই তোমায় লাগিয়ে দিয়ে আমি আনন্দ পাবো।” এমন সরল আব্দার না মেনে না নিয়ে পারলাম না। লাগিয়ে দিল খোঁপায়।
“আরে ম্যাডাম, কি ব্যাপার আজ কোনো অকেশান আছে নাকি?” “এই নীলা কি ব্যাপার রে! সকাল সকাল সেজেগুজে?“ নানা গুঞ্জনে মুখরিত আমার অফিস।
আমার ঠাকুরদাদা বেশ অনেকটা জমির উপর বড় বাড়ি করেছিলেন। বাগান করার জন্য অনেকটা জায়গা ছিল। ঠাকুমা নানা রকম গাছ লাগাতেন। ঘুম ভাঙতো ফুলের মিষ্টি গন্ধে। কত পাখি পতঙ্গ আসতো। ঠাকুমা সকাল সকাল স্নান করে সাজি ভরে ফুল নিয়ে এসে যখন সামনে দাঁড়াতেন, পবিত্র এক অনুভূতি হতো। ঠাকুমা তাঁর রাধাগোবিন্দর জন্য মালা গাঁথতেন, গোপালের জন্য মালা গাঁথতেন। আমাকে গোপালি বলতেন, আর আমার গলাতেও মালা পরিয়ে দিতেন। আমিও গাছ লাগাতাম। ভীষণ সুন্দর ছিল দিনগুলো। ঠাকুমা দাদু চলে যাওয়ার পর আমার দুই কাকু বাড়িটা প্রোমোটরকে দেওয়ার প্রস্তাব করে। বাবা রাজী ছিল না, শেষ পর্যন্ত রাজী হয়। এখন সে বাড়ি নেই। ফ্ল্যাটে থাকি আমরা। যে জমিতে শুধু আমাদের অধিকার ছিল, সে জমিতে এখন অধিকার অনেকের। এক চিলতে বারান্দায় টবে কিছু গাছ আছে মাত্র।

বেশ কয়েকদিন তরুছায়া (আগে ওর নাম বলা হয়নি,ওর নাম তরুছায়া) আসছে না ফুল বিক্রি করতে। কেমন যেন মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছি, বারবার মনে হচ্ছে ও আসছে না কেন? সাতদিন পরে ও এলো। “কিরে আসিস নি কেন এই কয় দিন?” -”আমার দিদির পরীক্ষা চলছিল গো, আমি তাই ওর কাজটা করছিলাম, ও তো ডিম সবজি বিক্রি করে, ডিম সবজির সাথেই মালা নিয়ে বসছিলাম গো, আবার আমার যখন পরীক্ষা হবে ও আমার কাজ, ওর কাজ দুটোই করে দেবে, পড়াশোনার সাথে সাথে পেট চালাবার ব্যবস্থাও তো করতে হবে তাই না গো।”

অফিসের প্রোগ্রামের জন্য বাল্যশ্রম বিরোধী শ্রুতি নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখছি আমি। শর্মীর উপর পরেছে বাল্যবিবাহ বিরোধী কিছু লেখার দায়িত্ব । নানারকম ভাবনা দিয়ে সাজাচ্ছি লেখাকে। এটা অফিসের প্রতিযোগিতা। যে গ্রুপ সবচেয়ে ভালো করে, তারা প্রথম পুরস্কার পায়। সবাই বেশ ব্যস্ত।
“দিদি একদিন আমাদের বাড়ি যাবে?আমি মা, বাবা আর দিদিকে তোমার কথা বলেছি, ওরা তোমায় দেখতে চায়।”
-“বেশ তো নিয়ে যাস কোনো এক রবিবার” -“যাবে দিদি?” আনন্দে চকচক করে উঠলো চোখ দুটো। রবিবারের সকাল। ওর সাথে গেলাম ওর বাড়িতে।

ওর বাবা আমাকে বিনা দ্বিধায় মামনি বলে সম্বোধন করলো। কি আন্তরিকতা সেই ডাকে। ঘরে বানানো মুড়ি আমাকে খেতে দিল, লঙ্কা পেঁয়াজ দিয়ে মেখে। সঙ্গে বাগানের ধনেপাতা। সামান্য খাবার কে যে কত অসামান্য করে তোলা যায়, তা এই মুড়ি না খেলে বোঝা যেত না। ঘর সংলগ্ন ছোট্ট বাগানে কত কিছু ফলিয়েছে। এখান থেকে টাটকা সবজি নিয়ে ওর দিদি বাজারে বিক্রি করে। মুরগি পালে আর ডিম বিক্রি করে। বস্তিতে পরপর বাড়ি, সবগুলোতেই নানা সবজী, ফুল কত কি। এরা একের ফলানো সবজি অন্যকে দেয়। এভাবেই অনেকটা চলে যায়। কি অদ্ভূত একতা। আমাকে দেখতে আরো কিছু স্কুলের ছেলে মেয়ে এল। এরা সবাই কাজ করে, আবার পড়াশোনাও করে।
গাছের তলায় একটা বোর্ড। জানতে পারলাম, এখানে তো বেশীর ভাগই প্রথম প্রজন্ম পড়াশোনা করছে, তাই এরা বাবা মায়েদের পড়ায়। বয়স্ক শিক্ষার একটা ছোট কেন্দ্র যেন। শুধু পড়ায় না, বাল্যবিবাহ, পড়াশোনা ছেড়ে বাল্যশ্রম করার কুফলও এরা বোঝায় বড়দের। ছোটদের সংসার চালাতে কিছুটা কাজ করতে হলেও এরা স্বকর্মী মানে সেল্ফ এমপ্লয়েড। নিজেরাই ফুল সংগ্রহ করে, গাঁথে বিক্রি করে। সবজি ফলায় বিক্রি করে। মুরগি, হাঁস পালে ডিম বিক্রি করে। তাদের মতে নিজেদের মত করে কাজ করলে, তারা নিজেদের জন্য সময় বার করে পড়াশোনা করতে পারবে, একে অন্যের কাজে সহায়তা করে পরীক্ষার সময়ও যাতে অসুবিধা না হয় সেই ব্যবস্থা করে। উঁচু ক্লাশের ছাত্রছাত্রীরা নীচু ক্লাশের ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়ে দেয়। প্রিন্ট আউট বার করার মত অর্থ তো তাদের নেই, তাই কাগজে বাল্যবিবাহ, বাল্যশ্রমের বিরূদ্ধে লিখে গ্রামে গ্রামে বস্তিতে বস্তিতে প্রচার করে। কি অপূর্ব একতা। এই বস্তির ছেলেমেয়েরা নিজেরা নিজেদের মত করে অর্থ রোজগার করে কারোর উপর নির্ভরশীল না হয়ে। এক এক জন মা যেন সবার মা, যারা সেলাই এর কাজ জানে, নিজের ছেলেমেয়ের সাথে সাথে আশেপাশের সব ছেলেমেয়েকেই সেলাই শিখিয়ে দেয়। এরা তাই স্কুলবেলা থেকেই সেলাই করে নিজেদের পড়ার খরচ চালিয়ে নেয়। না, কোনো দোকান নেই। বাড়িতে নিয়ে এসে সেলাই করে, আবার দিয়ে আসে। সবার একটাই প্রতিজ্ঞা স্বাবলম্বী না হয়ে বিয়ে করবে না। বাল্যবিবাহ তো মোটেই নয়। যতই ঘুরে ঘুরে দেখি, ততই অবাক হই। গাছের গাছের কলম করে কেমন নতুন গাছের প্রজাতি তৈরী করেছে কেউ কেউ। কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে এরা তো পড়েনি। বাগান করে, গাছ ঘাঁটাঘাটি করে বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই এরা শিখে গিয়েছে এই সব। চারা বিক্রি করেও রোজগার করে। তবে নিজেরা যা শেখে বা জানে অন্যদের শিখিয়ে দেয়, কোনো হিংসা নেই। বাগানে হওয়া সবজী বিনিময় করে। তাদের স্বপ্ন ছেলেমেয়েরা অনেক পড়াশোনা করবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে। নিজের যা ক্ষমতা তা দিয়ে সৎভাবে রোজগার করে নিজের পরিবার শুধু নয় সমাজের মানুষের পাশে থাকবে।

তরুছায়ার মা থালায় ভাত আলুসেদ্ধ, ঘি, বাড়ির ডিমের অমলেট, ডাল, বাড়ির বেগুন ভাজা কি সুন্দর করে সাজিয়ে এনেছে। কখন যে বেলা গড়িয়ে গিয়েছে। আমার কাছে অমৃতের স্বাদ এনেদিল এই খাবার। খাবার পরিবেশনের সঙ্গে যে অনন্ত ভালোবাসা। না বিরিয়ানি খেয়েও বোধহয় এত আনন্দ আর তৃপ্তি পাইনি, যা এই গরম গরম ঘি ভাতে পেলাম। ফ্রিজের নয়, মেটো কলসির ঠাণ্ডা জল তৃষ্ণার তৃপ্তি। সন্ধ্যা বেলায় লেবুর সরবত খেয়ে অনন্য এক অনুভূতি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। না, বাল্যবিবাহ, বাল্যশ্রম কোনো কিছু নিয়েই আর লিখে পাঠ করবো না। আমার সহকর্মীদেরও একই মত। সেই তো গুগুল টুগুল ঘেঁটে কতগুলো শুকনো জ্ঞানের কথা লিখতাম, বাস্তবের ঘটনা, প্রকৃত জীবনের আসল গল্প এরাই সামনে আনুক। স্টেজে ওরাই বলুক নিজেদের কথা। সবাই মিলে খিঁচুড়ি খাচ্ছি। শিশুদল খুব খুশি। আমাদের বাৎসরিক প্রাইজ দেওয়ার টাকায় ওদের বই খাতা পড়াশোনার সামগ্রী কিনে দেওয়া হলো অফিস থেকে- সমাজে ওদের অবদানের জন্য। ওদের নির্মল পবিত্র ও হাসিতে আমরা এক অনবদ্য আনন্দ পেলাম। সফল হোক ওদের প্রচেষ্টা। এমনি করে ওরা জীবনের জয়গান গাইতে গাইতে গাইতে জীবনের সব বাধা পেরিয়ে এগিয়ে চলুক।

Loading

Leave A Comment